অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
পাস আউট - ফরিদ তালুকদার

     পথটা কি হারিয়ে ফেললাম? ঠাসা বুনো গন্ধে ভরা রাস্তাটা ডানে বাঁক নেয়ার একটু আগেও তো সবাইকে দেখলাম। অবিন্যস্ত বিচরণ, অস্পষ্ট কন্ঠস্বরগুলো ভেসে আসছিলো দূর থেকে। লাল হলুদে মেশানো মনোহরি পাখিটাকে অবাক বিস্ময়ে দেখতে গিয়ে!— এতো সুন্দর একটা পাখি অথচ কি বিষণ্ণ তার কন্ঠস্বর! মনটা কেমন ভারী হয়ে উঠেছিলো! সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পেছনে তাকাতেই দেখি কেউ নেই! তাহলে কি দেরী হয়ে গেলো? জাহাজটা কি আমাকে রেখেই?— ওরা ডাকলো না কেনো? দু’ঘন্টার জন্যে দ্বীপের এই বনভূমি টা দেখবো বলেই তো সবাই জাহাজ থেকে নামলাম। সন্ধ্যাটা এতো দ্রুত নেমে এলো কি করে? অনেকটা শেয়ালের মতো দেখতে ধূসর রঙা প্রাণীটা খুব দূরে নয়। তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ। পারস্পরিক অবিশ্বাস! ভয়টা কার বেশী বোঝা যাচ্ছে না। তবে আমার শরীরে ঐ অনুভূতিটা প্রবল! দ্বৈরথটা ছেড়ে দিয়ে অবশেষে ও আঁধারে মিলিয়ে গেলো। স্বস্তি! শরীরে কেমন একটা ঘাম ঘাম ভাব। 
     কোনদিকে যাই? পেছন দিকটা একেবারেই অন্ধকার। সামনের কোথাও থেকে ক্ষীণ আলোর রশ্মি আসছে বলে মনে হলো। ঘন কুয়াশা ভেদ করে ঊষার প্রথম আলো যেমন, তেমনি ধোঁয়াটে। ওদিকেই হাঁটতে শুরু করলাম। আলোটা ক্রমশঃ উজ্জ্বল হচ্ছে। তাহলে কি এদিক থেকেই এসেছিলাম? ভয়টা ক্রমশঃ হালকা হয়ে আসছে। বনের বুনো ভাবটাও ক্রমশঃ পরিপাটি রূপ নিতে লাগল। আমার বিস্ময়ের পারদ ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠছে! এটা কি এই পৃথিবীর ই কোন জায়গা? এ তো এক রূপ কথার রূপ নগর! অপ্সরী নগরী এই বুনো দ্বীপে!? চির বসন্তের ভূমিতে মানুষ গুলোও যেন ড্রাগন ফ্লাই এর মতো নেচে নেচে বেড়াচ্ছে! অনেকে জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে। আলতো জলের ঢেউয়ে ভেঙে যাওয়া চাঁদের শরীর, এই এতোটা দূর থেকেও পরিস্কার দেখা যায়!
     আরও কাছে এলে বুঝলাম জায়াগাটা সীমানা ঘেরা। খুব সুন্দর সাজানো প্রশস্ত গেট। কেউ নেই সেখানে। ভেতরে প্রবেশের মুহুর্তেই কোথা থেকে হঠাৎ এক কন্ঠস্বর নেমে এলো!
     স্যার ওখানে আপনার প্রবেশাধিকার নেই--
     খুব চমকে গেলাম! অন্য রূপে ভয়টা আবার ফিরে আসছে মনে হলো! বললাম কেন? থাকবে না কেন? টিকেট কিনতে হবে কিংবা গেট পাস? 
     না স্যার, বিষয়টা তা নয়। ওখানে একা কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না।
     আমি তো একা নই? এই তো একটু আগেও আমার সাথে অনেকে ছিলো। হয়তো চলে আসবে এখনই। 
     তারা আসলেও হবে না স্যার। এখানে প্রেমিক-প্রেমিকা এবং ভালোবাসার হৃদয় ছাড়া কারোর প্রবেশাধিকার নেই। 
     আমার সাথে যারা ছিলো তাদের একজন আমার বান্ধবী। আমরা তো ভালোবাসি পরস্পরকে!? 
     না, আপনাদের মাঝের সম্পর্কটাকে ভালোবাসা বলে না। 
     তার মানে? 
     আপনাদের সম্পর্কের মাঝে স্বার্থের হিসেব-নিকেশটাই বেশী। তাকে সত্যিকারের ভালোবাসা বলে না স্যার। 
     আমার রাগটাকে আর থামাতে পারলাম না। বললাম, তুমি কোন তালেবর যে এতোকিছু জেনে বসে আছো? সামনে আসো?
     স্যার, আমিই একমাত্র যে দীর্ঘদিন ধরে সর্বক্ষণ আপনার সঙ্গী হয়ে আছি। 
     বললাম, হেঁয়ালি রেখে তুমি কে সেটা বলো? 
     আমি হলাম আপনার “একাকীত্ব” স্যার! আপনার মনের গহীনে আপনি আমাকেই শুধু সাথে রাখেন। তাই আমি সব জানি। 
     একাকীত্ব! আমার একাকীত্ব! মনটা কেমন দমে গেলো। বললাম, তুমি হয়তো ঠিকই বলেছো একাকীত্ব। আমি আসলে কাউকেই ঠিক চিনতে পারিনি! না তোমাকে, না আমার ভালোবাসাকে। আমার সবটাই শুধু এক ঘোর! 
     বুকের মধ্যে কেমন একটা বাউন্সি বল তুমুল বেগে ওঠা-নামা করছে। ঘরের তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু সেইজে (Chaise) আঁধশোয়া শরীরটা ঘামে ভিজে গেছে। প্রবেশ করতে না পারলেও, চিরবসন্ত ভূবনের ঐ গেটের সামনে আরও কিছুটা সময় থাকার ইচ্ছে ছিলো খুব!
     কিন্তু আমার “একাকীত্ব”!?---

ফরিদ তালুকদার। টরন্টো, কানাডা