অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
রহস্যের মায়াজাল (পর্ব —১৫) - সুজিত বসাক

     র্তের মধ্যে নেমে পড়ল রাকিব। এখন আর আলোর রেশটুকুও নেই। সামনে শুধু নিকষ কালো অন্ধকার। এই অন্ধকারে কোনো মানুষের পক্ষে চলা সম্ভব নয়। আবার আলো যে জ্বালবে তারও কোনও উপায় নেই। কারণ জ্বাললেই তার অস্তিত্ব ধরা পড়ে যাবে। আলোর প্রকাশকে সে একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে কি করে ? মরিয়া হয়ে রাকিব স্পর্শ শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করল। সামনে যে আছে তার হাতে আলো আছে , যত দ্রুত সম্ভব তার কাছাকাছি পৌঁছুতে হবে।  দু’বার পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। কনুইয়ের নীচে ঘষা লেগে ছড়ে গেল। তবুও থামল না রাকিব। নিজের ইচ্ছাশক্তিকে প্রাণপণে এক জায়গায় রাখার চেষ্টা করল। যেকোনও মূল্যে সে আজ দেখেই ছাড়বে। কিছুতেই পিছপা হবে না।
     হঠাৎ পা হড়কে গেল রাকিব। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেকটা নেমে গেল নীচের দিকে। অন্ধকারেই বুঝতে পারল সে একটা সিঁড়ির সামনে এসে পড়েছে। অন্তর ইন্দ্রিয়শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগল। বেশ কিছুটা নামার পর আবার সমতল। নজরে পড়ল আলো সমেত লোকটা। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করতে লাগল রাকিব। লোকটার হাতে ছোট একটা পেন্সিল টর্চ। সেই আলোতেই এগিয়ে চলেছে লোকটা। 
     লোকটার গন্তব্য কোথায় বুঝতে পারছে না রাকিব। উদ্দেশ্যটাই বা কী? এতরাতে কোথায় চলেছে? ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় নেই। লোকটাই বা কে, এখনও চিনতে পারেনি। যা পজিশন তাতে ওকে কাবু করে ফেলা রাকিবের কাছে খুব একটা অসাধ্য নয়। কিন্তু তাতে দুটো সমস্যা হতে পারে। এক, লোকটার আসল উদ্দেশ্য জানা যাবে না। দুই, তৃতীয় কেউ যে আশেপাশে নেই সে বিষয়েও নিশ্চিত নয় রাকিব। একই ভুল আবার করতে চায় না সে। অনেক ভেবেচিন্তে ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়াটাই সমীচীন বলে মনে হয়েছে তার কাছে।
     লোকটা এবার একটা সরু গলিপথ ধরল। একজনের বেশি সেই পথে চলা মুস্কিল। অনেকটা এঁকেবেঁকে সেই পথ উপরের দিকে উঠে গিয়েছে। রাকিব অবাক হয়ে দেখল পথটার শেষ হয়েছে দীপঝিলের পূর্ব দিকের একটা জঙ্গলের মধ্যে। এই দিকটাতে কেউ কখনো আসে না। রাজবাড়ির পিছন দিকে পুরানো ভাঙা মন্দিরের মধ্যে দিয়ে জঙ্গল পর্যন্ত সুন্দর একটা করিডর তৈরি হয়েছে। এই জঙ্গলের কথা একবারের জন্যেও মাথায় আসেনি রাকিবের। তবে কি এখানেই রয়েছে রহস্যের আঁতুরঘর ? রাকিবের শরীরের মধ্যে রক্তস্রোত দ্রুত হল।
     চাঁদের ওপর মেঘের আস্তরন, বৃষ্টির সঙ্কেত দিচ্ছে। যা দেখে মনে মনে ভীষণ হতাশ হল রাকিব। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগল এই সময় কিছুতেই যেন বৃষ্টি না আসে! লোকটা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। এদিক ওদিক তাকিয়ে সতর্ক হল যেন। কেউ তাকে অনুসরণ করছে, বুঝতে পেরেছে নাকি লোকটা? এক নিমেষে নিজেকে আড়াল করে ফেলল রাকিব।
     একটু বাদে আবার চলতে শুরু করল লোকটা। একটা ভাঙাচোরা বাড়ির ধ্বংসস্তূপের সামনে এসে দাঁড়াল। কোনও এক সময় এখানে কেউ বাস করত, এখন পরিত্যক্ত, জরাজীর্ণ। লোকটা চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে টুক করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণ আড়ালে থেকেই গতিক বোঝার চেষ্টা করল রাকিব। তারপর আর চিন্তা ভাবনা না করেই ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিছুটা এগোতেই একটা ঘরে আলোর আভাস দেখতে পেল। বুঝতে অসুবিধা হল না লোকটা ওই ঘরেই ঢুকেছে। খুব সতর্ক ভাবে ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল রাকিব। দরজা হাট করে খোলা। ভেতরটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ ভেতরে যে বা যারা আছে তারা নিশ্চিত, এই মুহূর্তে বাইরের কেউ ওদের দেখছে না। সেকথা ভেবে মনে মনে কিছুটা আস্বস্ত হল রাকিব। তার অস্তিত্ব বোধহয় কেউ টের পায়নি। 
     ভেতরে অনুজ্জ্বল একটা আলো জ্বলছে। সেই আলোতেই দেখা গেল আরও একজনকে। উল্টো দিকে মুখ করে বসে আছে সে। তবে অস্পষ্ট আলোয় মুখ চেনা যাচ্ছে না কাররই। যে লোকটাকে ফলো করে এসেছে রাকিব সে এখন বসা লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে। 
     বসে থাকা লোকটা গম্ভীর গলায় বলল — কাজটা হয়েছে?
     দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা সংক্ষেপে উত্তর দিল — হুম …।
     উঠে দাঁড়াল বসে থাকা লোকটা। বোধহয় কিছুটা উত্তেজিত। চালচলনে তেমনই প্রকাশ পেল। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের তালুতে একটা ঘুষি মেরে বলল — বহুত বড়িয়া … বহুত আচ্ছা … এবার সবকিছু আমার হবে … কোনও মাইকা লাল আটকাতে পারবে না।
     পরক্ষণেই সুর আরও খানিকটা চড়িয়ে বলল — ওদিকের খবর কী?
     সামনের জন বলল — একটু গোলমাল চলছে। আপনি তো সবই জানেন ।হীরুকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে … লা পাতা। তবে খবরটা এখনও রাজবাড়িতে প্রচার হয়নি। সম্ভবত পাতাল ঘরে ব্যাপারটা ঘটেছে। বাইরে থেকে আসা মেহেমান ছেলেটার সাথে হীরুর খুব ভাব হয়েছিল। ছেলেটাকে আমি খুব ভাল করে চিনি। খুব জিদ্দি আছে। বয়সের তুলনায় যথেষ্ট বুদ্ধিমান আর সাহসী। আমার মনে হয় … 
  —রাকিব খন্দকার … মহারাজের খাস মেহেমান। ছেলেটার উদ্দেশ্য আমিও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কী চায় ও? রাজবাড়ির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অহেতুক নাক গলাচ্ছে কেন? নজর রাখতে হবে বুঝলে। আর হ্যাঁ … মৃত্যুবনের মেহেমানদের এবার একটা বন্দোবস্ত করা দরকার। মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হচ্ছে, ওরা আমাকে খেলাচ্ছে না তো?
     এক নিমেষে চিনে ফেলল রাকিব। অম্বরলাল!! প্রথমে কথার আওয়াজ শুনে, একটু পরে চেহারাটাও স্পষ্ট হয়ে গেল। এখানে এতরাতে কী করছে অম্বরলাল? ওর উদ্দেশ্যটা কী? মৃত্যুবনের অতিথিদের নিয়ে কী করতে চায় অম্বরলাল? ওর চক্রান্তের কিছুটা হদিশ জানে রাকিব। এখন মনে হচ্ছে বড়সড় চক্রান্তের জাল বিছিয়ে রেখেছে সে, তাতে আর কোনো সন্দেহই নেই। ওর এই উপস্থিতি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। কিন্তু ওপাশের লোকটা কে? গলার স্বর চেনা চেনা লাগছে বটে, কিন্তু এই মুহূর্তে চিনতে পারছে না। অবশ্য একটু পরেই একেও চিনে ফেলল রাকিব। প্রথমে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। দেখার ভুল হচ্ছে না তো! চোখ কচলে ভাল করে দেখল। না দেখার ভুল নয়, লোকটা নিশ্চিতভাবে চমনলাল রাঠোর। কিন্তু চমনলাল রাঠোর এখানে কী করছে? তবে কি চমনলালও এইসব চক্রান্তের সাথে জড়িত? কিছুক্ষণ থম মেরে রইল রাকিব। মাথার মধ্যে অসংখ্য হিজিবিজি … সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে দিতে লাগল। আফ্রিকাতে রাকিবদের দলে ছিল চমনলাল। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ করা এক সাদাসিধা দেহাতি মানুষ। ভাগ্যের সন্ধানে একদিন ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গিয়েছিল আফ্রিকার প্রান্তরে। এইসব চক্রান্তের মায়াজালে ওর অস্তিত্ব মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল রাকিবের। কিন্তু না মানারও কোনো জায়গা নেই। নিজের চোখের সামনেই সব দেখতে পাচ্ছে। রহস্যের মাঝে নতুন আর এক রহস্য! 
     আড়ালে দাঁড়িয়ে আরও কিছুটা সময় ওদের কথাবার্তা শোনার পর রাকিব কিছুটা আন্দাজ করতে পারল ওদের এই গোপন মিটিংয়ের উদ্দেশ্য। একসময় মনে হল আর এখানে অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। পা বাড়াতে যাবে, ঠিক তক্ষুনি আরও একজনের আগমন সঙ্কেত পেয়ে সচকিত হয়ে উঠল রাকিব। এবার যাকে দেখল, তাকে দেখে পায়ের তলার মাটি সরে গেল যেন কিছু সময়ের জন্য। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিঃশ্বাস বন্ধ করে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে পড়ল রাকিব।

সুজিত বসাক। পশ্চিমবঙ্গ