অসুখ-বিসুখ - মৌসুমী পাল
রশীদ সাহেব আজ তিন দিন ধরে আইসিইউতে। আত্মীয় স্বজনরা সবাই একে একে ভীড় করছেন হাসপাতালের বারান্দায়। বেঁচে থাকতে যতই ঝগড়া বিবাদ থাকুক না কেন এই মৃত্যুর সময়টায় সবাই এক বার হলেও চোখের দেখা দেখতে আসে।
রশীদ সাহেবের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হলো না। তাছাড়া তিনি এককালে নাম করা মোক্তার ছিলেন। আশেপাশের দশ গ্রামের কেউ আইনের মারপ্যাচে তার ধারে কাছেও ছিলেন না। তার সুবাদে তার কিছু শত্রুও গজিয়ে ছিলো। একমেয়েকে তো তিনি আইনের প্যাচে ফেলেই ভাগিয়ে নিয়ে আসলেন। মেয়েটি বর্তমানে তার ছোট বিবি। বড়বিবি তার দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাড়িতে থাকেন। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় তিনি স্বামীর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন।
ছোট বৌয়ের পাঁচ ছেলে -মেয়ে। বাড়িটাকে যেন এরা সারাক্ষণ চিংড়ি মাছের বাজার বানিয়ে রাখেন। ৬০ কোটায় পা দিয়ে রশীদ সাহেব ইদানিং বুঝতে পারছেন তিনি কি ভুলটাই না করেছেন অন্যের বৌ ভাগিয়ে এনে। সারাজীবন আইনের হিসাব মিলালেও তার নিজের জীবনের হিসাবই তিনি মিলাতে পারলেন না।
এর মধ্যে ডাক্তার এসে জানালেন রশীদ সাহেবকে বেডে দেওয়া হয়েছে। অবস্থা আগের থেকে ভালো। আত্মীয় স্বজনরা দেখার পর্ব শেষ করে চলে গেলন সবাই।
রাত ৯ টা। রোগীকে খাবার দেওয়া হয়েছে। রশীদ সাহেবের ছোট বৌ খাবার তুলে খাওয়াচ্ছেন তাকে। রশীদ সাহেব মনে মনে খুশিই হলেন। ভাবতে লাগলেন মেয়েটা আসলে খারাপ না।
তুমি আর অসুস্থ হওয়ার সময় পেলে না। সামনে নির্বাচন। তোমার জন্যই তো আমার এবার ভোটে দাড়ানো হলো না - রশীদ সাহেবের স্ত্রী বলে উঠলেন।। হঠাৎ করে রশীদ সাহেব যেন ৩১৫ ভোল্টের শক খেলেন। স্বামী অসু্স্থ হয়ে হাসপাতালে আর এই মহিলার মন পড়ে আছে নির্বাচন নিয়ে।
প্যাচে ফেলে বিয়ে করলেও তিনি তার স্বামী। স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত-এরা এসব ভুলে যায় কি করে? গভীর দ্বীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রশীদ সাহেব। তার গলা দিয়ে আর ভাত নামল না।
রাতে তার ভালো ঘুমও হলো না। সারারাত বসে তিনি সারাজীবনের হিসাব কষতে লাগলেন। এককালে তার অনেক সন্মান, পতিপত্তি ছিলো। আজ তার সিকি পরিমাণ ও অবশিষ্ট নেই বলতে গেলে।
বড় ছেলেটা মারা গেল হঠাৎ করে। বড় মেয়েটাকে দেখে শুনে ভালো ঘরেই বিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু বিধিবাম। ৩ মাস যেতে না যেতেই মেয়ে আবার বাপের ঘরে। আইনের জাল বিছিয়েও কোন ফায়দা করতে পারলেন না।
ছোট মেয়েটা কিছুদিন আগে গলায় ফাঁস দিলো। মরতে মরতে বেঁচে গেলো এ যাত্রায়। তার পরের দুই ছেলের উৎপাতে এখন তার বাড়ি থেকে বের হওয়ায় একপ্রকার বন্ধ। পুরো পরিবারটাই তার আজ অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত।
অবশ্য তার এখন যে অবস্থা! বাড়ি থেকে কেন ঘর থেকেই তার এখন বের হওয়ার উপায় নেই।
সকাল বেলা হঠাৎ করে তার চোখজুড়া লেগে এসেছিলো। এর ভীতর তার স্ত্রীর চেঁচামেচিতে তিনি যেন একপ্রকার লাফিয়ে উঠলেন। এখন মরার মত পড়ে পড়ে ঘুমালে চলবে। ডাক্তার রিলিস দিয়ে দিয়েছে। এ সামান্য কথা তো সে এমন চেঁচামেচি না করেও বলতে পারতো-মনে মনে বললেন রশীদ সাহেব।
এখন তিনি বেশীরভাগ সময় মনে মনেই কথা বলেন। নিজের সাথে কথা বলতেই তার এখন ভালো লাগে। মানুষ বয়স্ক হয়ে গেলে মনে হয় এমনটা হয়। কোন বয়স্ক লোকের কাছে শুনে দেখতে হবে-মনে মনে ঠিক করেরে রাখলেন।
রশীদ সাহেব এখন তার রুমে শুয়ে আছেন। মাথার উপর শো শো শব্দে ফ্যান ঘুরছে। আর বাইরে দলে দলে লোক যাচ্ছে নির্বাচনের মিছিল নিয়ে।
তার স্ত্রী সবাইকে বলে বলে শুনাচ্ছেন এই কয়দিন তিনি কত খাটাখাটনি করে তার স্বামীকে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। (উল্লেখ্য যা করার তা শরীদ সাহেবের প্রথম পক্ষের মেয়েই করেছে।)
এর দুইদিন পর পুলিশ আসল বাড়িতে। রশীদ সাহেবের ছোট দুই ছেলেকে ধরতে। এটা আর নতুন কি। দারোগা রশীদ সাহেবের পরিচিত। রশীদ সাহেব এ ছেলেদের জন্য আর কারো কাছে সুপারিশ করবেন না।
দারোগা সেদিন সম্মান দেখিয়ে চলে গেলেন। এদিকে তার স্ত্রী মহিলা পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। কয়েকজন মহিলা সাগরেদ ও জুটে গেল তার।
রশীদ সাহেব বেশ কয়েকবার নিষেধও করেছেন। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি এসব পছন্দ করেন না। কিন্তু তার কথা কে শোনে। বয়স হলে মানুষের কোন দাম থাকে না।
তারপর কেটে গেলো আরও ১৫ দিন। রশীদ সাহেবও এ যাত্রায় সুস্থ হয়ে উঠলেন। তবে বুকের ব্যাথাটা কমলো না। একটু কিছু ভাবলেই যেন লাফিয়ে শুরু হয় বুকের ব্যাথা।
হঠাৎ করে একদিন রাতে তিনি খবর পেলেন তার দুই ছেলেকে পুলিশ এরেস্ট করেছে। খবরটা শুনে তার কোন ভাবান্তর হলো না। তিনি এমন ভাব করলেন যেন কিছুই হয়নি।
তার স্ত্রী ছোটাছুটি করেও কিছু করতে পারলেন না। চালান দিয়ে দেওয়া হলো তার দুই ছেলেকে। এদিকে পুলিশি ঝামেলায় তার স্ত্রীর মাথা থেকে ভোটের চিন্তা উধাও হয়ে গেলো। এ যেন এক ঢিলে দুই পাখি মারার মত অবস্থা।
তুমি তো একটু চেষ্টা তদবীর করতে পারো। ওরা ছোট মানুষ না হয় একটু ভুল করেছে। তোমার তো পরিচিত লোক আছে- গলায় একটু ঝাজ এনেই বললেন রশীদ সাহেবের স্ত্রী।
রশীদ সাহেব না শোনার ভান করে পাশ ফিরে শুতে শুতে বললেন ইদানিং যা গরম পড়ছে না। সিদ্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। কেননা সব সময় সব কথা শুনতে নেই। মাঝে মাঝে কিছু কথা না শুনার ভান করে এড়িয়ে যেতে হয়। আর তাই হয়ত আমাদের পরিবার, সমাজের জন্যও মঙ্গল বয়ে আনে।
মৌসুমী পাল
বাগেরহাট, বাংলাদেশ
-
গল্প//উপন্যাস
-
03-04-2021
-
-