অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
সঙ্গদান - জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

বিশ্বনাথের কিছুতেই ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে না। ওর বস মেজর সুপ্রিয় বোস অফিসে বকাঝকা আর গালমন্দ ছাড়া কথাই বলতে পারেন না। কথায় কথায় মুখে ইংরেজির তুফান ছোটান। উনি নাকি আগে মিলিটারিতে কাজ করতেন। রিটায়ার করে ব্যাবসা খুলেছেন। পোদ্দারকোর্টের সওদাগরি অফিসের চার তলার এই অফিসে সাকুল্যে পনেরো জন কাজ করে। অফিসের পাঁচ আর বাইরে বাইরে ঘোরার দশ জন লোক। দশটা- ছটা অফিস আর শনি-রবি ছুটি। অবশ্য বিশ্বনাথকে সাহেবের সন্ধ্যাবেলায় গাড়িতে চড়ে বেরোনো পর্য্যন্ত থাকতে হয়। তার জন্য কোনো ওভারটাইম নেই। দারোয়ানরা এই ভুতুড়ে বিল্ডিংয়েই থাকে বলে দেরি হলেও ওদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু তা বলে বিশ্বনাথের রোজ দেরি ওর বউ মেয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।

ব্রিটিশ আমলের বিল্ডিং। ইংরেজ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কোনো মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী কম পয়সায় বিল্ডিংয়ের মালিকানা নিয়ে ঘরে ঘরে ভাড়ার অফিস বসিয়ে দিয়েছিলেন। কারো ভাগে একটা ঘর, কারোর বা দুটো ঘর।অনেকে প্লাইউদের পার্টিশন দিয়ে ছোট ছোট কিউবিকাল  বানিয়েছে। আগে কয়েকজন ডাক্তার নাকি অনেকটা জায়গা ভাড়া নিয়ে চেম্বার করতেন। তারপর তাঁরা পরলোকগমন করলে মারওয়াড়ির ওয়ারিসরা সেটাকে বেশি টাকায় অন্যকে ভাড়া দিয়েছে। পুরোনো আমলের কাঠের প্রয়োন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে ঠকঠক করে ওপরে উঠে আসলে অনেক ছোট ছোট কোম্পানির অফিস চোখে পড়ে। ট্র্যাভেল কোম্পানি, প্লাইউড কোম্পানি, ইনকাম ট্যাক্সের উকিল, চার্টার্ড একাউন্ট এর অফিস, দাঁড়ি পাল্লার অফিস, কলের পাইপের অফিস এমনকি ইঁদুর মারার কলের অফিসও ওখানে বিদ্যমান।

বিশ্বনাথদের হলো জমি-ফ্লাটের কেনাবেচার দালালির অফিস। অবশ্য নিন্দুকেরা বলে এই দালালির ব্যবসার আড়ালে নাকি বেআইনি টাকাপয়সার লেনদেনও চলে। অফিস শেষ হবার পর অধিকাংশ দিনই মেজর বোস বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের নিয়ে বসেন। বিশ্বনাথ অবশ্য তাদের খুব একটা চেনেন না। কেবল বসের দরজার আড়াল থেকে  টুং টাং আওয়াজটা চিনতে ওনার ভুল হয় না। বসের এই একটা দুর্বলতা উনি বহুদিন থেকেই জানেন। তাতে আর কার কি এসে গেল। সন্ধ্যে হলে একপ্রস্ত হুইস্কি নেবার পর বোস সাহেব গম্ভীর অবস্থায় কেবিন থেকে বেরিয়ে অফিসের গাড়িতে চেপে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে রওনা দেন।

একবছর হলো বিশ্বনাথের পদোন্নতি হয়েছে। পদোন্নতি হবার পরদিন থেকেই কি কারণে যে বিশ্বনাথবাবু, বসের থাকা অব্দি অফিসে বসে থাকেন সেটা কেউ জানে না। বস ওনাকে থাকতেও বলেনি। তবুও বিশ্বনাথ থেকে যান এই ভেবে যে অফিসের সবচেয়ে বেশি মাইনে উনি পান। সেইজন্যই ওনার দায়িত্ব নাকি অন্যদের থেকে বেশি। এই দায়িত্ববোধের তাগিদে কখনো আটটা আবার কখনো রাত দশটায় বাড়ি পৌঁছাতে হয়। যতক্ষন না বোস সাহেবের গাড়ি চত্বর ছাড়ছে ততক্ষণ বিশ্বনাথ অফিস ছেড়ে নড়েন না। বাকি চার কলিগ বিশ্বনাথের এই ওভারটাইম বিহীন থাকাটা সন্দেহের চোখে দেখেন। অব সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো গত একবছর রোজ অফিস টাইম পেরিয়ে থাকা সত্ত্বেও বোস সাহেব কোনোদিন জিজ্ঞাসা করেননি উনি কেন থাকছেন বা মুখ ফুটে কোনো প্রশংসাও করেননি। তবে যদি কোনোদিন সন্ধ্যা ছটার পর ডেকে পাঠান তখন ওনার সুর মোলায়েম আর পরিষ্কার বাংলায় কথা বলেন। এইটাই বিশ্বনাথের চিন্তার কারণ। ঘড়ি ধরে একটা মানুষ কিভাবে পাল্টে যান সেটা ওনার মাথায় কিছুতেই ঢোকে না। যে যেন ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইডের গল্প।

সন্ধ্যে ছটার পর বিশ্বনাথ টিফিন খুলে সকালে কাটা শুকনো শসার টুকরো আর বিস্কুট চিবোন। সঙ্গে আনা জলের বোতল থেকে মাঝে মাঝে এক ঢোঁক দু ঢোঁক জল খান। মাঝে মাঝে আবার টেবিলে রাখা কম্পিউটারের কি- বোর্ডটা সরিয়ে  সেই জায়গায় মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেন।

সে দিনটা অন্য দিনের থেকে কোনো আলাদা দিন ছিল না। সারা দিন আকাশ মেঘলা। দুটো জানালা আছে অফিসে। কিন্তু সেগুলো খুললে চার ফুট দূরেই অন্য বিশাল বিল্ডিংয়ের পিছন দিক দেখা যায়। হাওয়া প্রায় খেলেই না এই অফিসে। কেবল বোস সাহেবের ঘরে এসি আছে। ওনাদের পাঁচজনকে গরমে, আদ্রতায় হাঁসফাঁস করতে হয়। শীতকালে অবশ্য খুব একটা খারাপ কাটে না।

সেদিন সন্ধ্যায় যথারীতি টিফিন খুলে শসার কুচি মুখে পুরতে যাবেন এমন সময় বড় সাহেব বেল দিলেন। বিশ্বনাথবাবু অবাক হলেন। সাহেব সাধারণত বেল-টেল দেন না। আজ কোনো গেস্টও নেই। উনি গুটি গুটি পায়ে সাহেবের কেবিনের দরজা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে বললেন "স্যার, আসতে পারি?"
" আরে, বিশ্বনাথবাবু, আসুন আসুন। নিন চেয়ারে বসুন।"

বিশ্বনাথ চেয়ারে কিন্তু বসলেন না। সাধারণত উনি এই সামনে রাখা দুটো গেস্ট দের চেয়ারে না বসে সাহেবের ডান দিকে একটু দূরে রাখা উঁচু স্টুলটাতে বসেন ডিক্টেশন নেবার জন্য। অভ্যাসবসত আজও চেয়ারে না বসে দাঁড়িয়ে রইলেন।

সাহেব একটা কাঁচের গেলাসে হালকা হলদেটে তরল ঢেলে সঙ্গে আনা ফ্লাস্ক থেকে জল মেশাচ্ছেন।
"বসুন না, একটু গল্প করা যাক। আজ আমার অনেক সময়। দুপুরে এক বন্ধু দুটো থিয়েটারের টিকিট দিয়ে গেল। চলুন মধুসূদন মঞ্চে সাতটার শোয়ে আমি আপনি থিয়েটার দেখে আসি।"

বিশ্বনাথ কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। না তো বলতে পারবেনই না, কিন্তু সাহেবের সাথে একসাথে পাশাপাশি বসে থিয়েটার দেখাটা সমীচীন হবে কিনা সেটাও বুঝতে পারছেন না। এইতো আজ সকালেই একটা ছোট টাইপের ভুলের জন্য যা নয় তাই বলে অপমান করলেন আর সন্ধ্যে বেলায় উনিই আবার ওনার সাথে থিয়েটার দেখতে যেতে বলছেন। এত বছর এই কোম্পানিতে কাজ করেও উনি সাহেবকে ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।

ডান হাতে গ্লাসটা নিয়ে বোস সাহেব এক চুমুক খেয়ে বিশ্বনাথের দিকে তাকালেন।
"ড্রিংকস নেবেন? আগে চেয়ারে বসুন তো।"
"স্যার, মানে আমি আপনার সামনে বসে মদ খাবো?"
"অবশ্যই। আপনি আমার কলিগ। কলিগের সাথে ড্রিংকস নিতে কিসের আপত্তি?"

বিশ্বনাথ চেয়ারে বসলেন। সাহেবের তৈরি করা ড্রিংকস মুখে নিয়ে বার দুয়েক হেঁচকি তুলেও নিজেকে সামলে নিলেন। মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে ওনার। নমাসে ছমাসে উনি কোনো পার্টিতে হালকা ড্রিংক নেন। পরপর দু পেগ আজ অল্প সময়ে যেন বেশি হয়ে গেল। ওদিকে সাতটার থেকে শো।

পৌনে সাতটায় সাহেবের গাড়িতে চড়ে যখন দুজনে বেরোলেন তখন দারোয়ান আড়চোখে বিস্ময়ে ওনাকে যে লক্ষ্য করছে সেটা বিশ্বনাথ ভালোই বুঝতে পারলেন।

মধুসূদন মঞ্চে গাড়ি থেকে ওনাদের নামিয়ে ড্রাইভার গাড়িটা অন্য কোথাও পার্ক করতে চলে গেল। বোস সাহেব আর বিশ্বনাথ পাশাপাশি হাঁটছেন। টিকিটদুটো সাহেবের পকেটেই হবে নিশ্চয়ই। সেটা বিশ্বনাথ তো আর জিজ্ঞাসা করতে পারেন না। বা বলতেও পারেন না যে স্যার একটা টিকিট আমাকে দিন। ওনার কাজ সাহেবকে সঙ্গ দেওয়া, সেটা উনি দিয়ে যাবেন।
"আরে বোস যে?" পিছন থেকে কারুর ডাক ভেসে এলো। দুজনেই দাঁড়ালেন। বিশ্বনাথ বাম হাতের রিস্টওয়াচ টা টুক করে দেখলেন। সাতটা পনেরো। মানে থিয়েটার শুরু হয়ে গেছে বা শুরু হবার মুখে।
" কিরে বোস, থিয়েটার দেখতে এসেছিস?" পায়জামা পাঞ্জাবি পরা মোটা ফর্সা একজন লোক, সঙ্গে এক সুন্দরী মহিলা হাসি হাসি মুখে বোস সাহেবের দিকে তাকাচ্ছেন। মোটা লোকটি বোস সাহেবকে জড়িয়ে ধরে সামনে এগোতে লাগলেন। ওঁরা তিনজন আগে আগে এগোচ্ছেন থিয়েটারে ঢোকার সদর দরজার দিকে। বিশ্বনাথ নিজের চলার স্পিডটা একটু কমিয়ে বোস সাহেব ও ওনার বন্ধু বান্ধবীকে অনুসরণ করতে লাগলেন। ওনাদের মাঝের দূরত্ব ক্রমশঃ বাড়তে লাগলো। একটা প্রশস্ত বারান্দা দিয়ে কিছুটা গিয়ে ওঁরা তিনজন হলে ঢুকে পড়লেন। বোস সাহেব একবার পিছনে ফিরেও দেখলেন না। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বনাথ হলের ভিতরে উঁকি মেরে দেখলেন থিয়েটার শুরু হয়ে গেছে। গেটে দাঁড়ানো লোকটি বিশ্বনাথকে টিকিট দেখাতে বললো। বিশ্বনাথের কাছে টিকিট নেই। বিশ্বনাথ, বোস সাহেবের সময় কাটানোর সঙ্গী হয়েছিলেন। এখন উনি অন্য সঙ্গী পেয়ে যাওয়ায় বিশ্বনাথকে ভুলে গেছেন।

বিশ্বনাথের রাগ হওয়া উচিত ছিল। ভীষণ ভীষণ রাগ। কিন্তু হলো না। উনি বস। উনি এসব করতেই পারেন। বিশ্বনাথ বারান্দাটা পেরিয়ে বাইরে এলেন। জায়গাটা আলোয় আলোয় ভরা। তবু এত আলোর মাঝে উনি আকাশের পানে চাইলেন। আকাশ মেঘে ঢাকা। না চাঁদ না তারা, কিছুই দেখা গেল না।

বিশ্বনাথ বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন শো ভাঙবে। সাহেবকে বাড়ি যাবার জন্য গাড়িতে তুলে দিতে হবে যে।


জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গ