অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
মরণ থেকে জীবনে - দীপিকা ঘোষ

   দুদিনের অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছিলো চারপাশ।  পঁচিশ বছরের এক তরুণ কাচের জানালার আড়াল দিয়ে পলকহীন চোখে সেই দৃশ্য দেখছিল।  তার মনে হচ্ছিলো, সে যেন বৃষ্টির ধারা নয়।  সূর্যহীন আকাশ থেকে পৃথিবীর সবখানে কেবলই বিষাদের পর্দা ছড়িয়ে যাচ্ছে।  জীবনের যতকিছু উল্লাস আনন্দ কিংবা স্বপ্ন, ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার যতসব পাথেয়, সবই আবৃত করে ফেলছে সেই আবরণ।   তার চোখের সামনে ধূসর রঙের আড়াল দিয়ে সেই পর্দা নিষ্ঠুর বৈরাগ্যে রিক্ত, নিঃস্ব, নির্যাসহীন জীবনের মৃত্যুময় ছবি এঁকে যাচ্ছিলো একের পরে এক।  সেখানে ফুল ফোটে না।  গান জাগে না।  প্রাণের স্পন্দন পাথরের মতো স্থির হয়ে থাকে।  অথচ কয়েক বছর আগে জীবনের নির্বিচার স্বপ্ন থরেথরে সাজানো ছিল এরিক কার্লসনের হৃদয়জুড়ে।  স্বপ্নরা তখন কুঁড়ি থেকে নিরন্তর ফুল হয়ে ফুটতো।  সে ফুল এমনই সতেজ, পরিচ্ছন্নতায় যা শুধু পুষ্পিত হতে জানে।  ঝরতে জানে না কোনোদিন।  আজ তাদের কোনোটাই অবশিষ্ট নেই।  জীবনের কোনো ফুলই আজ তাই পুষ্পিত হতে পারে না। 
     এরিকের মনের ভাব চিরকাল অবশ্য এমন ছিল না।  পঁচিশ বছর বয়সে এসে হঠাৎই জীবনের বাঁক বদলে যাওয়ায় তার মনের ভাবনাও বদলে গিয়েছিল ইউ টার্ন নিয়ে।  সেটা কিভাবে এবং কেমন করে সে কথাই নিজের আত্মজীবনীর পাতা জুড়ে সবিস্তারে লিখেছে সে ।  তখন ২০০১ সালের হিমেলভরা ডিসেম্বরের শেষ।  একদিন চিঠি এলো পেন্টাগন থেকে, আল-কায়েদা দমন করতে আফগানিস্তানের যুদ্ধে অন্যান্য সহকর্মীদের মতো এবার তাকেও যেতে হবে।  নির্দিষ্ট দিনের সুর্নির্দিষ্ট মুহূর্তে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত জীবনের জন্য সে প্রস্তুত হচ্ছিলো।  সিকিউরিটি পেরিয়ে অন্য সবার সঙ্গে একসময় চোখের আড়ালে চলেও গিয়েছিল।  কিন্তু যাবার মুহূর্তে যে দৃশ্যপাট সে ব্যাকুল চোখে দেখেছিল, সেটাই ছিল আফগানিস্তানের মৃত্যুময় পরিবেশে তার বেঁচে থাকার পাথেয়।  কতই বা তখন বয়স তার।  কুড়ি বছরের হৃদয় নিয়ে চোখ ফেলতেই দেখেছিল, স্যাণ্ড্রা পলকহীন অশ্রুভরা চোখে তখনো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে।  স্যাণ্ড্রা তার স্ত্রী।  মাত্রই পাঁচ মাস আগের বিয়ে করা বউ।  পেছনে বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাই-বোন।  বিগলিত মাখনের মতো তাদের শরীর জুড়ে অন্তরের তরল স্রোত বইছে তখন।  এরিক দেখেছিল তার গোটা পরিবার ভালোবাসার অঞ্জলি নিবেদন করে তার বিদায়মুহূর্তের বন্ধুর পথকে মসৃন করতে চাইছে।
     খুব কেঁদেছিল স্যাণ্ড্রা।  নীলাভ চোখ তুলে আকুলতা ঢেলে বলেছিল – তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় আমার দিন কাটবে এরিক! কখনো কোনো অবস্থায় ঈশ্বরকে ভুলে যেয়ো না প্লিজ!  কারণ আমার বিরামহীন ভালোবাসা তাঁকে পাথেয় করেই নিরন্তর পৌঁছুবে তোমার কাছে! রোজ প্রার্থনা করবো, তোমার ভালো থাকার জন্য! রোজ তোমার জন্য…! কথা বলতে গিয়ে রুদ্ধস্বরের স্পর্শ লাগায় কথা শেষ করতে পারেনি স্যাণ্ড্রা।
     মা সম্ভবত উত্তাল হওয়া বুকের আবেগ চেপে রাখতেই নীরব হয়ে ছিলেন। মাথায় চুমু খেয়ে শুধু বলতে পেরেছিলেন-
     ভালো থাকিস সোনা!
     বাবার চোখের গভীরতায় উথলে পড়ছিল স্নেহের জোয়ার।  তার শুভাশিষের সবটুকু শক্তি যেন সেখানেই উজাড় করে ফেলছিলেন, এমনই মনে হয়েছিল এরিকের।  আফগানিস্তানের শত্রু আচ্ছাদিত পরিবেশে যেখানে প্রতিমুহূর্তেই মৃত্যুর পরশ অস্থিরতায় ছুটোছুটি করে বেড়ায়,  সেখানেও কুড়ি বছরের এরিক অনুভব করতো, জীবনের আপাদমস্তক তখনো মখমলি ভালোবাসার স্নিগ্ধতায় মোড়া। পরিবারের শুভকামনার নিঃশ্বাসের ছোঁয়া হাজার হাজার মাইল পেরিয়েও সে অনুভব করতো শতবার।
     পাঁচ বছর পরে এরিক কার্লসন স্বদেশে ফিরেছিল।  অক্ষত অবস্থায় নয়।  দুই পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে।  কিন্তু তখনও স্বপ্নের সব ফুল ঝরে যায়নি।  বৃষ্টির আচ্ছন্নতায় তখনো সে সুন্দরের পরশ পেতো।  চারপাশের বরফঝরায় রোদের কিরণ পরশ ফেললে মনে হতো, অবাক উল্লাসে হাসছে পুরো পৃথিবী।  মনে হতো, তার জীবন আজও সুন্দরের ধ্যানে মগ্ন হতে পারে।  কিন্তু তারপর সহসাই বদলে গিয়েছিল তার পরিবেশ।  স্যাণ্ড্রার বদল আবিষ্কার করে ভেতর থেকে বেসামালভাবে ধাক্কা খেয়ে অন্তরে সে দুরারোগ্যভাবে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল।  ব্যস্ততার নানা অজুহাতে হাসপাতালে দু’দিন এসেই বহুদূরে সরে গিয়েছিল স্যাণ্ড্রা।  এরিকের অপেক্ষারত চোখ প্রতিমুহূর্তে বেদনার রসধারায় সাগর হয়ে ঝরেছে।  যন্ত্রনার চাপে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে তার হৃৎপিণ্ড।  মায়ের চোখ সবই দেখতে পেতো।  ছেলের বেদনা আকুল করতো হৃদয় ছিঁড়ে ফেলে।  বাবার স্নেহও সান্ত্বনা দিতে প্রলেপ হয়ে উঠতে চাইতো বিরামহীন।  কিন্তু এরিকের ধূসর পৃথিবী তারা কেউ সবুজ করে তুলতে পারেননি।  ততোদিনে সে জেনে গিয়েছিল, স্যাণ্ড্রা দু’বছর আগেই সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বিয়ে করেছে মাইকেল জনসনকে।  মাইকেল তাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধু।
     মা সান্ত্বনা দিয়েছিলেন–
     আমি তোকে জানাতে চাইনি সোনা!  তবে এও বলছি অতীতের জন্য দুঃখ করে জীবনে কখনো কিছু অর্জন  হয় না!  তুই তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠ! সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে!
     হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে পঁচিশ বছরের তরুণ মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে খুব কেঁদেছিল সেদিন–
     কিন্তু ও কেন এমন করলো মা? কেন দুদিনের করুণা দেখাতে এসে এতবড় অভিনয় করতে হলো তাকে? আমি কি ভালোবাসাহীন মানুষটাকে জোর করে কখনো বেঁধে রাখতে চাইতাম? আমার মতো পঙ্গু মানুষের পক্ষে সেই প্রাণহীন বোঝা টানা কি সম্ভব হতো কখনো?
     ছেলে বেঁচে ফেরায় মা তখন শক্তি অর্জন করেছেন।  তিনি তাই বলেছিলেন–
     নিজের মনকে কখনো পঙ্গু করো না এরিক! দুটো নকল পায়ে তুমি অনায়াসেই দেহটাকে সচল রাখতে পারবে!  কিন্তু মন পঙ্গু হলে বেঁচে থাকা বড় কঠিন!  জগতে অজস্র মানুষ নকল পায়ে হেঁটে বেড়ায়!  তাছাড়া তোমার পা হারানো তো কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়! সে অনেক বড় গৌরবের!  দশের কল্যাণে সৈনিক হয়ে যুদ্ধে তুমি পা হারিয়েছ!  তোমার মতো সন্তানের জন্য আমরা গর্ববোধ করি! আমরা সবাই গর্বিত!
     এরিক মায়ের অতল গৌরবের অন্তরাল সরিয়ে বুকের কষ্টটুকুই সেদিন শুধু অনুভব করেছিল।  তার ধৈর্যের সীমা পার হয়ে গিয়েছিল শিগগিরই।  দু’দিনের বৃষ্টিতে বিপুল তরঙ্গ নিয়ে বাড়ির পাশের ‘ওয়াবাস রিভার’ বইছে আজ।  জুলাই মাসের মধ্য সামারে দুই তীরের ঘন গাছপালা সবুজ পাতার সমারোহে তখন অসাধারণভাবে যৌবনবতী।  প্রাণের জোয়ারে ঢেকে ফেলেছে চারপাশ।  এরিক সবার চোখের আড়ালে পড়ন্ত বিকেলে সেই নদীর তীরে এসে দাঁড়ালো।  নির্জনতা ছাপিয়ে জীবনের অনন্ত উদ্দামে তখন উত্তাল হচ্ছে ‘ওয়াবাস’।  তার পঙ্গু শরীর এই নদী খুব সহজেই ভাসিয়ে দিতে পারে নিমেষে।  ঝাঁপ দিতে গিয়ে দু’হাত ওপরে তুললো এরিক।  কিন্তু কে জানে কেন, হঠাৎই সে থমকে দাঁড়ালো।  হয়তো বা মৃত্যুর আগে পৃথিবীকে শেষবার দেখে নিতে চাইলো কিনা তার তৃষ্ণার্ত চোখ।  তরুণ পৃথিবীর চারপাশে গভীর চোখে তাকালো।  আর তখনই তার চোখের ওপর জন্ম নিলো এক শব্দহীন কবিতার অনবদ্য গুচ্ছ।  
     সে দেখলো, একটি ক্ষুধার্ত খেঁকশিয়াল সর্বশক্তিতে তাড়া করেছে একটি লিজার্ডকে।  শিকারির শিকার মাত্রই কয়েক ইঞ্চির ব্যবধানে ছুটছে।  লিজার্ডের সামনে তখন অনন্ত প্রসারিত জলরাশি মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে গর্জন করে ফিরছে।  তবুও ঝাঁপ দিলো এক মৃত্যুর নাগাল থেকে আরেক মৃত্যুর ফাঁদে।  কারণ তখন পরিস্থিতি ভেবে বোঝার মুহূর্ত অতিক্রান্ত।  লিজার্ডের পৃথিবী জুড়ে তখন একটাই শুধু স্বপ্ন।  সে স্বপ্ন বেঁচে থাকার।  কয়েকবার তলিয়েও সম্ভবত সর্বশক্তিতে বেঁচে থাকার ইচ্ছেতেই একবার  ভেসে উঠলো সে।  তারপর জল ছুঁয়ে থাকা একটি উইলো গাছের পাতা আঁকড়ে ধরে ছোট্ট লিজার্ড কামারখানার হাঁপরের মতো হাঁপাতে লাগলো ফুসফুস ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য।  দেখতে দেখতে বিহ্বল হয়ে গেলো এরিক।  এতদিনকার দেহমনের পঙ্গুত্ব ছেড়ে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে মুহূর্তে জন্ম নিলো তার নব চেতনা।  সে চেতনা জীবন জাগরণের চেতনা।  চল্লিশ বছর বয়সে নিজের আত্মজীবনী লিখতে বসে এরিক কার্লসন লিখলেন –
  ‘জীবনে বেঁচে থাকা বড় সুন্দর।  বেঁচে থাকা তাই সাধনা।  কিন্তু বাঁচার প্রেরণা জীবনে কখন কিভাবে আসবে সেটা জানতে পারা ভারি সহজ নয়।  সেই রকমই এক অপ্রত্যাশিত প্রেরণা যখন পঁচিশ বছরের মিলিটারিম্যান এরিক কার্লসনের জীবনে এলো, তখন সেই মুহূর্ত হয়ে উঠলো তার জীবনে বেঁচে থাকার জন্য এক সর্বোত্তম কবিতা’।  নিজের আত্মজীবনী লিখে মিলিটারিম্যান এরিক শেষ পর্যন্ত কবি হয়ে উঠলেন।  সেই কবিতা ধন্য করলো বহু নিরাশাবাদীদের।  ধন্য করলো সেইসব স্বপ্নহীন মানুষকেও, যারা ঊষর জীবনের বোঝা বয়ে বাঁচার সার্থকতা হারিয়েছিলেন বহুকাল আগে।  

দীপিকা ঘোষ। আমেরিকা