অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
একুশের কবিতা: উঠান থেকে যতদূর দেখা যায় - ফজলুল হক সৈকত

মি এখন বরকতের উঠানে দাঁড়িয়ে- স্তিমিত উঠান
শিকল-দেওয়া দরোজায় চোখ স্থির করে দাঁড়িয়ে আছি
বরকত মাথা হেঁট করে ঢুকতো এই ঘরে 
শ্যামল ছেলের লম্বা দেহের ঘাড়ে সেই নত হওয়ার দাগ মনে করতে পারি
কেবল মনে করতে পারি না- কেন এই ছেলেটি মাথা উঁচু করেছিল সেদিন?
রাজনীতি-না-জানা রাজনীতির ছাত্র মধুর রেস্তোরাঁয়
শামসুলের কথায় এমন কী পেয়েছিল?
২১ তারিখে গুলি খেয়ে মরতে মরতে বরকত লিখে গেছে
রাজনীতির অলেখা ডায়েরি
এই উঠান থেকে দেখা যায়- ডায়েরির সেই পাতাগুলো উড়ছে
যেন শাদা মেঘে বেদনার নীল পতাকা।

রফিক যে উঠান দিয়ে হেঁটে হেঁটে বড় হয়েছে
সেখানে লেখা আছে তার লেখা ছোট ছোট ছড়ার কচি কচি কথা
তাঁর যুবক সমিতি আর কমার্শিয়াল প্রিন্টিঙের টুকরো টুকরো কাগজ
আজও উড়ে বেড়ায় এই উঠানের আনাচে ও কানাচে
হবু বউ পানু বিবির পান-খাওয়ার কিছু স্বপ্নদৃশ্য আজও দোল খায়-
এখানে পেয়ারা তলায় 
মেডিকেলের গেটে ২১ তারিখে মাথায় যখন গুলি লাগে রফিকের
তখন তাঁর নীল জামার বুকপকেটে ছিল সেফার্স কোম্পানির
পুরনো ফাউন্টেন পেন
তারপর, কপাল থেকে লাল কালি নিয়ে জনতা লিখে দিলো
বাংলা ভাষার নাম
কী কপাল, হায়! সেই রফিকের কবরে লেখা হলো না প্রিয় বাংলার
একটি হরফও
উঠান থেকে যতদূর দেখা যায়- সেই নামের ডানে ও বামে জমেছে
কালো কালো কালির ছোপ। 

আকিলা খাতুন জমানো ১০০ টাকায় স্বামী শফিউরের দাফনের
জন্য যে কবর কিনেছিল
তাকে যদি একটি উঠান ভাবা হয়- তাহলে আমি এখন সেই
উঠানের মধ্যখানে, মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছি
এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় ২২ তারিখ শুক্রবারের সন্ধ্যার আকাশ
হাইকোর্টের কেরানি শফিউরের সেদিন ছিল সাইকেলে চড়ার শেষ দিন
এরপর আর কখনো তাঁকে দ্বিচক্রযানে চেপে অফিসে আসতে দেখা যায়নি।
রথখোলায় মরণচাঁদের দোকানের সামনে যখন পুলিশের গুলি
শফিউরের পিঠ পেরিয়ে কলিজা ফুটো করে দেয়
তখন কি সে মিছিলে ছিল?
নাকি সাইকেল নিয়ে প্রতিদিনের মতো রাস্তা পেরোচ্ছিলো?
ডাক্তার এলিনসন যখন গা থেকে গুলি বের করার চেষ্টা করছিল
শফিউরের গলা থেকে তখন শোনা গিয়েছিল সামান্য কথা:
‘আমার মেয়েকে দেখো। আমি বুঝতে পারছি,
আমি তার কাছে আর ফিরে যেতে পারবো না’ 
আজিমপুরের উপুর-হওয়া-উঠান থেকে আজও হাওয়ায় ভেসে
বেড়ায় ৩ বছরের শাহনাজের কান্নার শব্দ!

পাক সরকারের পিয়ন নোয়াখালীর সালাম কিংবা ‘ফাহিস্তান’-বলা
মোমিনসিঙের জব্বার কি কোনো আলাদা আলাদা উঠান বানাতে
পেরেছে কখনো?
২২ তারিখে গুলিতে মরলো ১৯ হাফিজুল্লাহ রোডের রিক্সাওয়ালা
আউয়াল। তার ৬ বছরের মেয়ে বসিরন যে শহীদ মিনারের
ভিত্তি তুলেছিল ৪ বছর পর- সেটি আজ একটি স্তিমিত উঠান।

রাজমিস্ত্রি হাবিবুরের ৯ বছরের ছেলে অহিউল্লাহ?
তার কথা মনে আছে?
কী পরিচয় তার?
খোশমহলের সামনের রাস্তায় গড়িয়ে পড়লো তার দেহ-
সেই রাস্তাকেও কল্পনা করা যায়- একটি নির্মিতব্য প্রশস্ত উঠান।

এইসব উঠান থেকে যতদূর দেখা যায়-
শুধু কালো কালো কালির ছোপ ছোপ দাগ!

ফজলুল হক সৈকত। ঢাকা