ফড়িং-ধরা বিকেল (শেষ অংশ) – নূরুন্ নাহার
ফড়িং-ধরা বিকেল পঞ্চম অংশ পড়তে ক্লিক করুন
ফড়িং-ধরা বিকেল (শেষ অংশ)
ভয়ঙ্কর সেদিন
[উৎসর্গঃ সাহিত্য জগতের অগ্রদূত সত্যেন সেন, নির্মলেন্দু গুণ ও পূরবী বসু-কে]
খুব ভয়ঙ্কর সেদিনের কথা।
আমরা দু’বোন আর বাবা শীতের ছুটিতে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে। হঠাৎ টেলিগ্রাম এলো- মায়ের অবস্থা খারাপ।
বাবার এক বন্ধু করেছিলেন টেলিগ্রাম।
আমরা তড়িঘড়ি করে রাতের ট্রেন ধরেই বেনাপোলে এলাম।
এসে দেখি আমার মায়ের ডান হাতের ওপর তিন ইঞ্চি সমান পুরু জিলেপির মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ফোস্কা পড়ে আছে।
তারপর সবকিছু শুনলাম, জানলাম।
মায়ের কাপড়ে আগুন ধরেছিল। তখন ছিল সূর্য-ওঠা ভোর।
আমার পরের ভাইটা মায়ের কোলে ছিল।
শাড়ির আঁচল ঝুলে পড়েছিল চুলোয়। চুলো থেকেই আঁচলে আগুন ধরেছিল।
আমার ছোটো ভাইটিকে বাঁচাতে গিয়ে মা দিশেহারা হয়ে সেই শাড়িতে ধরা আগুন ডান হাত দিয়ে চেপে-চেপে নেভাতে গিয়েছিল।
ঐ আগুনেই ডান হাতটা পুড়ে একেবারে ঝলসে গিয়েছিল।
মায়ের হাতে বাবার দেয়া দু’টো সোনার চুড়ি ছিল।
সোনার চুড়ি পুড়ে কঠিনভাবে হাতের মাংসের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। স্বর্ণকার এনে সেই পোড়া চুড়ি বের করতে হয়েছিল।
আমাদের বাসার ভেতরে ছিল মায়ের হাতের সবজি বাগান।
মায়ের হাতে সবজি খুব ভালো হতো।
বাসার উঠোনে শাক, মটরশুঁটি, ঢেঁড়স, বেগুন আরো অনেক কিছু লাগানো ছিল।
মা তার কাপড়ে ধরা আগুন নিয়ে সেই সবজি বাগানের ভেতর পাগলের মতো ঘুরেছিল। বাগানের সব সবজি পুড়ে গিয়েছিল।
মনে হলে আজও সেই সবজি-পোড়া গন্ধ পাই,
আর বিষাদে অনেক দূরে হারিয়ে যাই!
বিহারি পরিবার
[ উৎসর্গঃ ত্রিরত্ন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বেগম রোকেয়া ও শকুন্তলা দেবী-কে ]
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে ছিলো এক বিহারি পরিবার। ঐ পরিবারের সাথে আমাদের খুব সখ্যতা ছিল। মায়ের সেই দুর্দিনে ঐ পরিবারের সবাই মায়ের জন্য যা করেছিল তা আজও মনে দাগ কেটে আছে। বিশেষ করে যিনি গৃহকর্ত্রী ছিলেন, আমরা যাকে খালাম্মা বলে ডাকতাম, তিনি আমার মাকে চব্বিশ ঘন্টা দেখাশোনা করতেন। মানুষ মানুষের জন্য যে অমন নিবেদিত হয়ে কিছু করতে পারে সেই প্রথম দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে যায়। খালাম্মাকে কৃতজ্ঞতায় আজও মনে পড়ে। সত্যি বুঝি অমন দিন কোনোদিনও আসবে না। স্মৃতিরাও কোনোদিন সরে যাবে না।
বিহারি পরিবারের দুর্দিনে
[ উৎসর্গঃ গানের পাখি লতা মঙ্গেশকর, সাবিনা ইয়াসমিন ও রুনা লায়লা-কে ]
আর একদিনের কথা। সেই বিহারি পরিবার একবার বেড়াতে গিয়েছিল ভারতে। ফেরার পথে ট্রেনে চোর ঢুকে সবাইকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তাদের সবকিছু চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সাথে পাসপোর্টও। শেষমেষ পাসপোর্টের অভাবে পুরো পরিবার বর্ডারে এসে আটকে গেলো। সেদিন বাবা তাদের জন্য অনেক করেছিলেন। মায়ের দুর্দিনে তারা যেমন করে করেছিল, সেদিন বুঝি বাবার সুযোগ এসেছিল তাদের ঋণ পরিশোধের।
বাবাকে দেখেছিলাম খুব ছুটোছুটি করে সেদিন তাদেরকে বর্ডার থেকে উদ্ধার করেছিলেন। বাবার নিবেদিত সহানুভূতি আর সুপারিশে পরিবারটি অনুকূলে এসেছিলো। মনে পড়ে, সেদিন পুরো পরিবারই আমাদের ফ্ল্যাটে ছিল। তাদের ঘরের চাবিও চুরি হয়ে গিয়েছিলো।
একেবারে খালি হাতে তাদের বর্ডার পেরুতে হয়েছিলো। তারা বার বার আতঙ্কিত হয়ে, হাউমাউ করে আমাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলেন সেদিন। আমরাও সারাটা রাত তাদের চোখের জলে ভেসেছিলাম। সেটাও ছিল এক দুঃখের রাত! তারা কৃতজ্ঞতায় সে রাতের কথা মনে রেখেছিলেন। সে রাতও কেটে গেছে। আছে শুধু সেই বুক শির-শির করা স্মৃতি! তাদের সঙ্গে আমাদের অনেকদিন যোগাযোগ ছিল। বাবা বদলি হয়ে এসেছিলেন রংপুরের ডোমারে, আর ঐ পরিবার বদলি হয়েছিলো নীলফামারিতে। তারপরেও বহুদিন একটানা যোগাযোগ ছিল এমনি করেই। স্বাধীনতা-যুদ্ধের বছরে তারা হারিয়ে গেলেন। যোগাযোগের সুতো ছিঁড়ে গেলো। কারণ তাদেরকে পাকিস্তানে চলে যেতে হয়েছিলো। হয়তো বা আর কোনোদিনও যোগাযোগের সেই সুতো বাঁধা যাবে না। কিন্তু মনের সেই দেয়া-নেয়ার জায়গাটা হয়তো কোনোদিন মুছবে না।
খেলার সাথি ফরহাদের সাথে
[ উৎসর্গঃ লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তি লালন শাহ, হাসন রাজা ও বাউল শাহ আবদুল করিম-কে ]
বেনাপোলের আর একদিনের মন-পোড়ানো কথা।
একদিন খেলার সাথি ফরহাদের সাথে বেনাপোল কলোনি থেকে কিছুটা দূরে পুকুর-পাড়ে আমগাছে আম পাড়তে গিয়েছিলো বড়ো বোন। ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল।
আগেই বলেছি, মা ছিল বেশ রাগী। বাড়িতে বড়ো বোন ফিরতে না ফিরতেই, মা দড়ি দিয়ে পেঁপে গাছের সাথে বেঁধে খুব পিটিয়েছিল। অপরাধ, কেন ফরহাদের সাথে আম পাড়তে গেল। আমার বুক-কাঁপানো খারাপ লেগেছিলো। কিন্তু করার কিছুই ছিল না। মায়ের ওপর কথা বলার সাহস ছিল না।
মায়ের অমন নিষ্ঠুর মারের কথা মনে উঠলে আজও চমকে উঠি।
সেই আম-পাড়ার সাথি ফরহাদেরও খুব শাস্তি হয়েছিলো। ভা’য়ের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো। এই অপরাধে ভাবির অভিযোগে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল। ফরহাদকে বাসা থেকে বের করে দিল তার ভাই। আমার বড়ো বোন সেদিনই প্রথম বুঝেছিলো অমন করে যখন-তখন আর কোথাও যাওয়া যাবে না।
সেদিনের পর থেকে বড়ো বোনের কোথাও আর যাওয়া হয়নি।
বড়ো অপরাধবোধে ফরহাদকে মনে পড়ে।
কিন্তু শেষমেষ ফরহাদের কী হলো তাও আর জানা যায়নি।
পাওয়ার হাউস
[ উৎসর্গঃ সুরের আকাশের শুকতারা আব্বাসউদ্দীন আহমদ, অতুল প্রসাদ ও রজনীকান্ত সেন-কে ]
বেনাপোলে আমাদের বাসার কাছেই ছিল পাওয়ার হাউস নামের একটা একটু অন্যরকম ঘর। সেই ঘরে সারাক্ষণ একটা শোঁ-শোঁ শব্দ হতো। সেখান থেকে সমস্ত কলোনির বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ চলতো।
আজ স্মৃতির সারিতে দাঁড়িয়ে সেই শোঁ-শোঁ শব্দও যেন সুরে গাঁথা ছন্দের মতো কানের পর্দা যাচ্ছে ছাড়িয়ে।
শেওড়া গাছ
[ উৎসর্গঃ স্বনামধন্য বেগম সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম ও শামসুর রহমান-কে ]
বেনাপোলে আমাদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল একটা শেওড়া গাছ। গ্রাম্য-কথায় ‘শড়া গাছ’ বলে। সেই শেওড়া গাছের পাতা এত চকচকে সবুজ ছিল যে, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যেত। পাতাগুলো ছোটো ছোটো এবং ঘন। গাছটার ভেতরে কেমন যেন একটা ভাব ছিল। জনশ্রুতি ছিল ঐ গাছে ভূত থাকে। সারাদিন যেনতেন, সন্ধে হলে গাছটির দিকে তাকিয়ে আমরা ভয়ে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে যেতাম।
কিন্তু আজ স্মৃতির পাতা খুলে দেখছি সেই ভয়-জড়ানো শেওড়া গাছও যেন আজ কত আদর-মাখানো।
যেন দূরে কোথায়
[ উৎসর্গঃ কাব্য, সাহিত্য ও সমাজ-সংস্কারের অগ্রদূত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জসীমউদ্দীন ও মহাশ্বেতা দেবী-কে ]
আবারও গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছে সেই স্মৃতির পাড়াতে। বেনাপোল থেকে ট্রেনে করে আমরা দু’বোন যে-কোনো অবকাশে নানা ও দাদাবাড়িতে যেতাম। সেখানে আমরা রাত-দিন চরে বেড়িয়েছি। আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই আমরা দু’বোন স্মৃতির মেলায় হাত ধরাধরি করে হাঁটছি আর হাঁটছি।
গ্রীষ্মের ছুটিতে নানা ও দাদাবাড়িতে আমরা যে অবকাশ যাপনে যেতাম, তা যেন ছিলো বিলেত ভ্রমণের মতো।
কখনো মনে হতো দার্জিলিংয়ে এসেছি বিনোদনের জন্য। আবার কখনো মনে হতো কল্পনার প্যারিসে হাঁটছি।
আমরা গ্রীষ্মের দুপুরে নানাবাড়িতে পুকুরপাড়ে মাদুর বিছিয়ে, গাছ থেকে আম পেড়ে, ঝিনুক ঘষে ফুটো করে সেই ঝিনুকের আঁচড়ে কাঁচা আম ছুলে খেতাম। সেই ঝিনুকে ছোলা আম মনে হতো অমৃতের মতো। বর্ষায় যখন পুকুরের চার পাড়, নদীর দু’কূল ছেপে গেছে তখন মাছের মতো করে গা ভাসিয়ে সাঁতার কেটেছি।
শরতে সাদা মেঘের ভেলায় ভেসেছি। হেমন্তে চুলোর পাশে বসে ভাঁপ-ওঠা নানির হাতের পিঠে খেয়েছি মধুর মতো করে। সাধ মিটিয়ে শীতের সকালে আগুন তাপানোর ছলে, নাড়ার আগুনে ছোলার হোড়া পুড়িয়ে খেয়েছি দু’হাত ভরে। সেই হোড়ার ছাইগুলো যেন মনে হতো হীরের গুঁড়ো। বসন্তে ছুটে গেছি আকাশ ছোঁয়া কাঁঠাল অথবা আমগাছের তলে, কোকিলের মিষ্টি কুহু ডাক শুনবো বলে।
এমনি করে ছয়ঋতুর সাথে আমরা দু’বোন খেলেছি দিনভর।
সন্ধে হলে উঠোনে বসে জোছনা আর চাঁদের বুড়ির সাথে কথা কয়েছি আনমনে।
এমনি করেই দাদাবাড়িতেও পুকুরপাড়ে, জোনাক-জ্বলা বাঁশের বনে, জোছনা-ভেজা ঝিরঝির নারকেল গাছের পাতার ফাঁকে, ঝিরঝির বাতাসের আদরে, বারান্দার বুকে শুয়ে জীবনের অনেকগুলো সন্ধে কাটিয়েছি আমরা দু’বোন।
আজও আছে সেই পুকুর-পাড়, নদীর কূল, জোছনা রাত।
কিন্তু নিঃসঙ্গ যেন সবই, সেই আমিও।
চোখ ছলছল চোখে আবার তাকিয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই।
বার বার মন ফিরে যায়
[ উৎসর্গঃ আমার জন্মভূমি। ‘…যে মাটির মায়া-মমতা আমার অঙ্গে মাখা…’ ‘…স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা…’ ]
তারপর একদিন যখন বেনাপোল কাস্টম-কলোনির সব সুখগুলো পেছনে ফেলে বাবা বদলি হয়ে গেলেন রংপুরে। বার বার মন ফিরে যায় পিছনে। বেনাপোলে থাকতেই আমাদের পরিবারে আরো দু’ভাই এসেছিলো। বেনাপোলের সেই উড়ন্ত শৈশব ছেড়ে এসে আমরা একেবারে বোবা হয়ে গেলাম যেন। স্মৃতির শহর ছিলো বেনাপোল বর্ডার।
আবার একটা না-বলা কষ্ট দানা বাঁধলো। এ কষ্টের বোঝা কাউকেই দেয়া গেল না।
বেনাপোল কলোনির মাঠ-ঘাট, খেলার সাথিরা, বর্ণমালার সাথিরা ছিল বুকের বাঁশি। সেই বাঁশির সুর কান্নার মতো করে বাজলো বুকের একেবারে শেষ বিন্দুতে। আবার একটা অন্যরকম শূন্যতা জড়িয়ে ধরলো। কিছুতেই যেন মন বসে না। বার বার মন ফিরে যায় বেনাপোলের সেই দুরন্ত দুপুরে।
এমনি করেই দিন আসছিলো, রাত যাচ্ছিলো। তারপর কখন যেন বাস্তবতার মতো কঠিন সত্যেও সব শূন্যতা সয়ে গেলো।
বড় হয়ে উঠলাম আমরা পাশাপাশি দু’বোন। জীবনবোধও নিয়মের বিধিনিষেধে বেড়ে উঠলো। কৈশোর ডাক দিলো। শূন্যতাগুলো আবার স্মৃতি হয়ে উঠলো। দায়িত্ববোধগুলো একে-একে জড়িয়ে ধরলো। কর্তব্যবোধগুলো এসে শূন্যতাগুলোকে সরিয়ে রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে সন্ধি করলো।
তবু যেন বার বার মন ফিরে যায় সবকিছুর ফাঁকে সেই সুদূরের দুরন্ত দুপুরের ঝিলে, ফড়িং-ধরা বিকেল -এ…! সমাপ্ত
নূরুন্ নাহার
ঢাকা, বাংলাদেশ।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন
ছড়া ও কবিতাঃ বর্ষা যখন – নূরুন্ নাহার
-
গল্প//উপন্যাস
-
16-11-2017
-
-