অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
কাছে আসার গল্প - জাহ্নবী জাইমা

ছোট বেলার প্রবল ইচ্ছের সাথে পাল্লা দিয়ে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতার পাঠ শেষ করি। জীবনে সাথে বাজি রেখেছি এ জীবনের অনেক বার। তবুও মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে পারিনি। ভাবনা আর বাস্তবতা দু’ইয়ে পাল্লা দিয়ে চলার নাম জীবন কিনা তা মাথায় আসে না, সব ভাবনা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নেই। প্রতিদিনের মত কর্ম শেষে ক্লান্তির বোঝা মাথায় নিয়ে বাসায় ফিরতেই জ্যোতির ফোন। ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে এত কষ্টের কি দরকার? সারাদিন ধুলা আর রোদে শরীরটা তামাটে হয়ে যাচ্ছে দোস্ত “ম্যা হু না” এই ভালো করে শুনে নে আজ পহেলা ফাল্গুন। ওর কথায় আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। আজ জ্যোতির সংঙ্গে পলাশ-শিমুল ফোটা বনে দুজনে রেল লাইনের মতো সমান্তরাল হাতে হাত রেখে দূরে বহুদূরে যাওয়ার কথা। জ্যোতিকে বলি সরি, এক্ষুণি আসছি। দোস্ত তুই আসলে আমার জীবনে একটা টাইমার ঘড়ি। সন্ধ্যা পর্যন্ত দু’জন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে সাওয়ারের পর ডিনার। ক্লান্তি শেষে নেটে ব্রাউজ করতে বসি, নেটের একটি ঘটনা মনের মধ্যো কষ্ট চাপা পড়তে পড়তে পাহাড় সমান হয়। নিজেকে চাপিয়ে রাখতে পারি না, অগ্নিয়গীরির মত হৃদয় বিষ্ফোরিত হয়। তবু নিজেকে চাপিয়ে রাখতে চেষ্টা করি।
মধ্যপ্রাচ্যের একটি নারীর ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষিতার নাম রাহেলা। পথ থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পাশবিক নির্যাতনের পর ক্ষতবিক্ষত রাহেলা এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ঘড়ির কাটায় আঁধারের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে, এক সময় রাত পেরিয়ে সকাল হয়। সূর্য উঠে সূর্যের সাথে ফিরে জ্ঞান। নিজের দেহটা নিজের কাছে ভারী হয়ে ওঠে রাহেলার। তবুও ক্ষতবিক্ষত শরীরে থানায় গিয়ে মামলা করে “ধর্ষণের মামলা”।
পুলিশের দয়ায় চিরুনী অভিযানে ধরা পড়ে দু’দিনেই ধর্ষকের দল। ওদের মধ্যে একজন ছিল ক্ষমতারক্ষীর আদরের বখে যাওয়া দুলাল। ঘটনার সূত্রপাত সেখান থেকে। ক্ষমতারক্ষীরা দিনকে করে রাত রাতকে করে দিন। আসে না ফিরে রাহেলাদের ঘরে সুবাতাস, বাড়ে কষ্টের দিন। সাজানো হয় নতুন ঘটনা। রাহেলা নিজ ইচ্ছায় বন্ধুর সাথে আদিম খেলায় মিলিত হয়। সাক্ষী হয় নতুন চরিত্রের একজন বিনিময়ের সীল মোহরে। পাশ্চাত্য আইন অনুসারে রাহেলার জন্য সাজা হয় বালিতে অর্ধ পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মারা, মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত। (রজম আরবিতে বলে)।
আমি জোহানা একজন নারী, মনের মধ্যে সেই নারীর জন্য মানবতার শক্তি কাজ করে। নেটে মানবাধিকার সংস্থাগুলির কাছে লিখি রাহেলার জন্য প্রতিবেদন।

“জাগ্রত হও মনুষত্ত্বময় মানুষ বেজে উঠুক সত্যের ডংকা, 
রাম হয়েই যাব আজ রাহেলাদের থাকবে না, রাবনের শংকা
মৃত্যুপুরী থেকে আনবো ছিনিয়ে কলুসিত মুক্ত হবে আজ লংকা
সত্যের হবেই জয়, মিথ্যা সে তো অপশক্তি হবে হবেই পরাজয়।

অপশক্তির হাতে যদি আজ রাহেলা যায় মরে 
সত্য আর কোনদিন জাগবে না পৃথিবীর তরে 
কোটি মানুষ মানবতার হাত দাও বাড়িয়ে।
কলঙ্ক কুলসিত মিথ্যাকে পায়ে যাব মাড়িয়ে।”

দুঃচিন্তার বোঝা মাথায় নিজের প্রতি ঘৃণা সমাজের অবহেলা নিয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না। এলোমেলো ভাবনাগুলি ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙতে অনেক দেরী হয়। দেরীর কারণে বাহিরে বেড়াতে ইচ্ছে হয় না। জ্যোতি সকালের ফ্লাইটে ব্যবসার কাজে আমেরিকা চলে গেছে, ফিরবে তিন মাস পর। ফেসবুক খুলে বসে দেখি প্রতিবেদন পেজটিতে হাজারো মানুষ অসংখ্য মানবাধিকার সংস্থা কমেন্ট করেছে। মাসউদ সাহেব একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রধান তিনি সবার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় রাহেলাকে উদ্ধারের ব্যপারে। সবার সাহায্য হৃদয়ে জমে থাকা ব্যথার পাহাড় বরফের মত গলে হাল্কা হতে থাকে। মন আনন্দে নেচে উঠে। বিধাতা হয়ত আমার ডাকে সাড়া দিয়েছে। 
যেন মরা গাছের ফুল ফোটে রাহেলার জীবনে। রাহেলাকে উদ্ধার করে মানবাধিকার কর্মীরা, তবু বেঁচে যায় বখাটে দুলালরা, হয়তো তারাও একদিন আইনের আওতায় আসবে, সেদিন বেশি দূরে নয়। রাহেলার ঘটনার সূত্র ধরে মাসউদ সাহেবের সঙ্গে আমার বন্ধুত গড়ে ওঠে।
ধীরে ধীরে আমাদের দেয়ালের মাঝে শূন্যতে মিলাতে থাকে শেয়ার করি দু’জন দু’জনকে সুখ-দুঃখ আনন্দ বেদনার কথা। 
মাসউদ পেশায় একজন উদীয়মান চিত্রশিল্পী। ছোট বেলায় বাবার কর্মস্থলের সুবাদে অনেক দেশ ঘুরতে হয়। নতুন দেশ নতুন মানুষ নতুন সমাজে ঘুরে ঘুরে একদিন যৌবনে পা ফেলে। মাসউদের বাবা মেরিনার, তার স্নেহের বাধন মায়ের আঁচলের মমতা দু'য়েই তিনি। সেই স্নেহের বাঁধনে কত দেশ কত সমাজ তাকে চিনতে হয়েছিল, সত্যিই কিন্তু মন পড়ে থাকতো জন্মভূমিতে। শীত এলেই যেমন পুরনো বাতের ব্যাথা বাড়ে ঠিক তেমনই বাড়তে থাকে হৃদয়ে ব্যথা মায়ের সমাধি মাতৃভূমির কথা ভেবে। উচ্চশিক্ষার জন্য শেষ ডেড়া গাড়ে আমেরিকায় ফাইন আর্টে পিএইচডি করেন নিউইয়র্কের কুইন্সে। রাহেলার জন্য প্রতিবেদন করে কাজের সাফল্যের সঙ্গে বোনাস হিসেবে পাই মাসউদের মতো একজন ভালো বন্ধু। চার বৎসরের জল বাস্প হয়ে গর্ভবর্তী মেঘে পরিণত হয়, বৃষ্টির অপেক্ষায়।

‘দুই’
রাহেলাকে মানবাধিকার কর্মীরা উদ্ধার করে নিয়ে যায় আমেরিকায় পুনর্বাসনের জন্য। 
মাসউদের সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর থেকে গভীরতর হয়। তার চিন্তা “সুস্থ মনুষত্ব বিশুদ্ধ সমাজ”। পারিবারিক কথার ফাকে বাবা মাসউদের কথা বলে, ওর সাথে আমার শুধুই বন্ধুত্ব, না কি সে সম্পর্কের আড়ালে আরো কোন দেয়াল আছে কিনা তা জানতে চায়। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে তাই বাবার সামনে মাসউদের সম্পর্কের কথাটা সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। বাবাকে বলতে পারিনি সে আমার স্বপ্নের উচুঁ চূড়ায় দাঁড়িয়ে। তাকে ঘিরে হাজারো স্বপ্ন সংসার ফুটফুটে সন্তান। সে স্বপ্ন মাঝে মাঝে ঝাপসা হয় জ্যোতির তীব্র আলোর ছটায়, তবুও  স্বপ্ন মনের মাঝে সাত রঙ্গে সাজে। বাবার প্রশ্ন বৈশাখী ঝড় হয়ে সব তছনছ করে দেয়, তবুও মন বলে ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে গড়ে তুলবো নতুন ইমারত। জ্যোতির কাছে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায় ভিক্ষুকের মতো, জ্যোতি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, যে জীবনের জন্য এ জীবন এত সুন্দর সে জীবনকে সুন্দর করাইতো এ জীবনের ধর্ম হওয়া উচিত। দীর্ঘশ্বাসের সাথে যেন হৃদয়ের সব আলো নিভে যায় লোড শেডিংয়ের মত, এ হৃদয় অন্ধকারে হারায়। জ্যোতির কথার পূর্ণাঙ্গ অর্থ না বুঝলেও বুঝেছি সে আমার জন্য সব করতে পারবে। জ্যোতির কথার জ্যোতিতে এ হৃদয়ের অন্ধকার সরে আলো আসতে থাকে। মাসউদের বাবার কথায় মনে সাহস পায় শত গুণ। মনের মধ্যে ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। বাবাকে মাসউদের ব্যাপারে সব খুলে বলবো। তবুও ভয়ে মৃদু কম্পনে হৃদয় কেঁপে ওঠে বারবার। সাহস করে বাবাকে মাসউদের কথা বলতে শুরু করি। বাবা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে গতবার নিউইয়র্কে অফিসের কাজে গিয়েছিলাম, সেখানে মাসউদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আমার এক কলিগ। তখন তার ছবি প্রদর্শণী হচ্ছিল। প্রদর্শণীতে গিয়েছিলাম খুব ভালো ছবি আঁকে। জীবন্ত ছবি জলের মতো স্বচ্ছ সুন্দর হয় তার তুলিতে। কিন্তু... 
কিন্তু কি বাবা ?
মাসউদ আমার মেয়ের উপযুক্ত নয় তা বলবো না। আমার মেয়ে তার উপযুক্ত কি না সে একটা ব্যাপার। কারণ হিসেবে বলবো সে আধুনিক একটু বেশি। তাছাড়া তুমি তাকে চেন কতটুকু? মূল কথা হচ্ছে তুমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড় তখন তোমার মা তোমার বিয়ের কথা পাকা করে গেছে আমার প্রিয় বন্ধুর ছেলের সঙ্গে। ছেলের বাবা এদেশের একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। ছেলেও হ্যান্সাম অভিজাত সম্পন্ন। তার চেয়ে বড় কথা তোর পছন্দের একজন সে। যে নাম শুনলে তোর হৃদয় আনন্দে আলোকিত হয়। জ্যোতি তোর অযোগ্য নয় রে মা। কথাটা শুনে হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হয়, জ্যোতির জন্য হৃদয়ের মাঝে ভালোবাসার টান অনুভব হয়। দুকূল ভাঙনের মাঝে কষ্টের চর জেগে উঠে।
জ্যোতি, জোহানার বাবার কাছে শুনতে পায় মাসউদ জোহানার ঘটনা। জ্যোতি বলে, আংকেল জোহানা যেন বাসার বাইরে না যায়। আমি দেশে না ফেরা পর্যন্ত।

‘তিন’
জোহানার বাবা জ্যোতির কথা নিজের ইচ্ছা দুইয়ে এক করে হয়ে ওঠে দজ্জাল বাবা।  জ্যোতি অন্তর্জালায় জ্বলতে থাকে। জোহানার বিশ্বাস জ্যোতি তার পথ চলার ভালো বন্ধু, জ্যোতি আমার মনের অবস্থা অবশ্যই বুঝবে। মাসউদ আর জ্যোতির কথা ভাবতে ভাবতে দু’নয়ন লোনা প্লাবনে ভেসে যায়। জোহানাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে হঠাৎ জ্যোতি এসে চমকে দিয়ে বলে, জোহানা! জোহানা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। জ্যোতি বলে, তোমার বাবা বাসায় নেই জানি, আমার উপর ভরসা থাকলে এ হাত ধরো, তোমার ভালোবাসার অমর্যাদা কখনো হতে দিব না। চোখের প্লাবনে নিজেই ডুবে যাব কিন্তু তোমাকে...।
জোহানা জ্যোতির কথা কেড়ে নিয়ে বলে, সময় নষ্ট করার সময় এটা নয়। জ্যোতি বলে, “ম্যায় হু না” দু’জন দু’জনের হাত শক্ত করে ধরে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। জ্যোতি এলোমেলো ভাবনায় হারিয়ে যায়। 
যে হৃদয় একদিন স্বপ্নের ডানায় ভালোবাসার পৃথিবীতে যুগল বলাকা হয়ে উড়ে বেড়াতো, সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে নতুন আকাশে উড়ে যেতে চায় তার-ই ডানায় ভর করে। আগ্নেয়গিরিও একদিন শীতল হয়, তবে কেন এ হৃদয় শীতল হবে না। একদিন যে সাগরে যুগল হংস হয়ে সাঁতার দিতাম, আজ সে সাগরের লোনা জলে দুই তীর বারবার প্লাবিত হয়। জ্যোতি হৃদয়ের উর্বরতা হারাতে থাকে, চৈত্র খরায় চৌচির হয়ে যায় হৃদয় পাঁজর। আমার হৃদয় পথে তোমার পায়ের চিহ্ন আর কোন দিন ভালোবাসার সিলমোহর তুলিতে আঁকা হয়ে আসবে না, ফেস্ট্রিভ্যাল কিংবা ক্যানভাাাাাাাাাাাাাসে।
জ্যোতির দুঃখ চেপে অন্যের সুখে জোহানার হাত ধরে পথের গন্তব্যে ছুটে চলে রানারের মতো। নিজের দুঃখ কষ্ট বুকে কাঁধে নিয়ে চলে প্রাপকের ঠিকানায়।

জাহ্নবী জাইমা। ঢাকা