অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
কৃষ্ণতিথি - শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর

নেক চেষ্টা করেও রতনকে বাঁচানো গেলোনা। সুবেহ সাদেকের আগেই রতন ইহলোক ছেড়ে পরলোকের পথে যাত্রা করলো। রতনের বাবা কুসুমহাটি হাইস্কুলের হেডমাস্টার মহোদয় বুক ভরা আশা নিয়ে রতনকে গৌরীপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন এই ভেবে যে, ছেলেকে উন্নত চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন; কিন্তু রতনের বাবার সে আশা আকাঙ্ক্ষাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে রতন চলে গেলো অনন্তের দেশে।  

রতন আর আমি একই স্কুলে পড়তাম। কুসুমহাটি হাইস্কুলে রতনের মতন ডানপিটে আর দ্বিতীয়টি ছিলোনা। পড়াশোনায় যেমন তুখোড় ছিলো রতন, তেমনি ছিলো খেলাধুলায় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও। স্কুলের কাব্যতীর্থ শিক্ষক রাধা নারায়ণ স্যার প্রতিদিন ক্লাসে ঢুকে রুটিনমাফিক প্রায় মিনিট দশেক রতনের প্রশংসা করতেন। রতনকে কাছে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন-
আহা ! একটা হীরের টুকরো ছেলে বটে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাট, সবকাজেই সিদ্ধহস্ত আমাদের রতন।

বাস্তবিকই স্কুলে খুব সুনাম ছিলো রতনের। তবে অস্থির স্বভাবের কারণে হেডমাস্টার মহোদয় রতনকে এতপরিমাণে বকতেন যে, সে তুলনায় কাব্যতীর্থ স্যারের প্রশংসা ছিলো নস্যি।

ম্যাট্রিকে ভালো ফলাফল করায় গৌরীপুর ছেড়ে রতন আর আমি ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হলাম। আমরা একই মেসে থাকতাম। দুজনেই সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত ছিলাম, কিন্তু বছরখানিক না যেতেই রতন পরিবর্তনের সোঁতে গা ভাসিয়ে দিলো। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় কলেজে রতনের বন্ধুর কোনো অভাব ছিলোনা। মাঝেমধ্যে রতন আমাকে ঠাট্টা করে বলতো-
সাজু, তুই পুরনোই রয়ে গেলি ! আমি ম্লান হেসে মাথা নেড়ে রতনের কথার জবাব দিতাম।

যতই দিন গড়াতে থাকলো, ততোই রতনের পরিবর্তনগুলো প্রকট হতে লাগলো। গভীর রাতে মেসে ফেরা, রাত জেগে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে দুপুর বারোটা অবধি ঘুমানো- এগুলো একসময় রতনের নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হলো। 
একদিন রতন আমাকে আগ্রহভরে বলল-
সাজু, আজ বিকেলে তোকে আমার সঙ্গে এক জায়গায় নিয়ে যাবো ভাবছি। সময় হবে তোর?
আমি বিনাবাক্যে রতনের কথায় সম্মত হলাম। আমার সম্মতি পেয়ে রতন বেশ খুশি হলো।    

বিকেলে রতন আমাকে নিয়ে রেললাইনের ধারে একটি খুপরির সামনে এসে দাঁড়ালো। রতনকে দেখে একজন মধ্যবয়সী স্ত্রীলোক খুপরি থেকে বেরিয়ে এসে ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে রতনের হাতে একটি কাগজে মোড়ানো পুটলি ধরিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে দ্রুত সরে পড়লো। স্ত্রীলোকটির আচরণ দেখে আমার মনে ভীষণ কৌতূহল জাগলো। অস্ফুটে জিজ্ঞাসা করলাম- 
গাঁজাটাজা ধরেছিস নাকি, রতন?
রতন আমার কথা শুনে ফিক্ করে হেসে দিলো। হাসি থামলে বলল-
নেশা বলতে এখনো গাঁজাকেই বুঝিস, তাই না সাজু?  
-এজন্যই তোকে বলি, আপডেট হ। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিখ। নইলে চিরকাল ভাঁটি অঞ্চলের সাজু হয়েই থাকতে হবে, বুঝলি?
আমি কথা বাড়ালাম না। রেললাইন ধরে নীরবে রতনের সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম।
একটা নির্জন জায়গায় এসে পরিত্যক্ত রেললাইনের স্লিপারে বসে রতন পুটলিটি খুলতে খুলতে আমাকে বললো-
নেশার জগতে এটার আগমন একেবারেই নতুন বলতে পারিস। একবার খেলে ক্লান্তি তোর ধারের কাছে ঘেঁঘবে না। সারারাত জেগে পড়তে পারবি, সাজু।
রতনের কথায় আমি বিস্মিত হলাম। এ আমি কোন রতনকে দেখছি? ও কি সত্যিই কুসুমহাটি হাইস্কুলের  রাধা নারায়ণ স্যারের হীরের টুকরো ছেলে? 
নতুন আগন্তুক বিস্ময়কর বস্তুটি গ্রহণে রতনের আহ্বান আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। দেখলাম, রতনের তাতে কোনো ভাবান্তর হলোনা। নেশা টেনে রতন বুঁদ হয়ে বসে রইলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে রতন আমাকে বিদায় দিয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটতে লাগলো। মেসে ফিরে এসে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে রতনের এরূপ কৃতকর্ম সম্পর্কে আমি আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম।

দিনে দিনে রতনের মাদকাসক্তি বেড়েই চললো। কোনো রকম বুঝিয়েও রতনকে আসক্তি থেকে নিবৃত্ত করতে পারলাম না। ক্রমেই রতন অসহিষ্ণু ও হিংস্র হয়ে ওঠলো। রতন আমাকে শাসালো, এসব বিষয়ে যদি ওর মা বাবাকে বলি, তাহলে রতন আমাকে খুন করে ফেলবে। বস্তুত, ওর বাড়াবাড়ি চরমসীমায় গিয়ে পৌঁছেছিলো। 

পড়াশোনায় সাংঘাতিক অমনোযোগিতার কারণে সে বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় রতনের ফলাফল বিপর্যস্ত হলো। আমি ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে ঢাকায় চলে এলাম। রতনের খবর নেয়া হয়নি অনেকদিন। রতনকে একরকম ভুলেই গেলাম।  

হঠাৎ হেডমাস্টার মহোদয়ের ফোন পেলাম। হেডমাস্টার মহোদয় আমাকে ফোন দিয়ে রতনের অসুস্থতা এবং ঢাকায় নিয়ে এসে রতনকে হাসপাতালে ভর্তির কথা জানালেন। ব্যস্ততার কারণে রাতে আমি রতনকে দেখতে যেতে পারিনি। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেই রতনকে দেখতে গেলাম। হাসপাতালের ওয়েটিংরুমে হেডমাস্টার মহোদয় বসেছিলেন। আমাকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হেডমাস্টার মহোদয় বললেন-
সাজু, সব কিছু শেষ হয়ে গেছে, বাবা! 

হেডমাস্টার মহোদয়ের কথা শুনে দ্রুত ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে কর্তব্যরত ডাক্তারের কাছে জানতে পারলাম, দীর্ঘদিন মাদক গ্রহণ করার কারণে মারাত্মক লিভারসিরোসিসে ভুগছিলো রতন। অসুখটা একেবারে শেষ ধাপে চলে আসায় কোনো অবস্থাতেই আর তাকে ফেরানো গেলো না। 

রতনের লাশ গাড়িতে তোলা হলো। হেডমাস্টার মহোদয়ের সাথে আমিও গিয়ে বসলাম গাড়িতে। গাড়ি তুফানের গতিতে ছুটে চললো গৌরীপুর অভিমুখে। কুসুমহাটি হাই স্কুল মাঠে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামানো হলো রতনের লাশ। জানাজা শেষে রতনদের বাড়ির পেছনে জারুল গাছের নিচে রতনকে সমাহিত করা হলো। কৃষ্ণতিথির মতোই আলো আঁধারের মধ্য দিয়ে রতনের জীবননাট্যের পরিসমাপ্তি ঘটলো। 
সবকিছু ছেড়েছুড়ে রতনের এই অকাল প্রয়াণ মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। দারুণ কষ্টে ক্ষত-বিক্ষত হলাম। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে রতনের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। 
তারপর চোখের জলে ভিজে রতনকে বিদায় জানিয়ে রাতের ট্রেনে আবার ঢাকায় ফিরে এলাম।

শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর। ঢাকা