অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
মৃৎশিল্পী – জাহ্নবী জাইমা

হেমন্তের বিকেলে সূর্যটা টুপ করে ডুবে যায়, দেখতে দেখতে নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে যাবে গাঁ, সেই আলো আঁধারির সুযোগ নিয়ে হাজির হয় সরমা, দ্বিজুর সৎমা। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হাতের মাটি দিয়ে পাঁচটা আঙুল গড়ে শিশুটার, মুঠোর মধ্যে বসিয়ে দ্বিজু দেখে নেয়, কাজ প্রায় শেষ। বাকি রইল শুধু তেল রং করাটা, দ্বিজু মুখ তুলে বিকেলের আকাশ দেখে ভাবতে থাকে, মা বেঁচে থাকতে এই সময়টা তার খুব ভালো লাগতো। সারা দিনের কাজ শেষ করে ওর কাছে এসে বসত মা। ছোট্ট একটা কাঠের জলচৌকির উপর ছেলের সেই দিনের বানানো পুতুলগুলো দেখে মায়ের আশা মিটত না। ‘তর হাতে মনে লয় মাটি যেন জাইগ্যা উঠে’। দ্বিজুর বুকটা ভারী হয়ে আসে। বড় করে একটা নিশ্বাস নেয়, আস্তে করে পুতুলটা চৌকির পাশে নামাতে যাবে এমন সময় একটা অষ্পষ্ট নিশ্বাসের আওয়াজে একটু অবাক হয় দ্বিজু, আর একটু হলে পুতুলটা হাত থেকে মাটিতে পড়ে যেত।
     দ্বিজু এদিক ওদিক তাকায়, সরমা তো এত তাড়াতাড়ি আসে না, আর একবার দেখে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয় দ্বিজু। সরমা এখনও আসেনি। কিন্তু নিশ্চিন্ত ভাবটা তৎক্ষণাৎ চলে যায়। অন্য একটি চিন্তা তাড়া করে ফিরে তাকে। ওছাড়া এখানে আর কেউ নেই। তা হলে আওয়াজ এলো কোথা থেকে?
     সৎ মায়ের জ্বালায় এবার বুঝি দ্বিজু সত্যিই পাগল হতে চলল, গ্রামের লোক পাগলা বলে ডাকে বটে, কিন্তু সে তো আহ্লাদ করে। দ্বিজুর মনটা আজ খুব ভারী। মনে পড়ে যে কোনও সমস্যায় মা বলত, একটু জল খা খোকা... জল খেলে ভালো লাগবে।
     শুশুনিয়া পাহাড়ের গায়ে একখানি ছোট্ট ঠিকানাঃ গ্রাম- গোবর ডাঙ্গা, জেলা-বাঁকুড়া, প্রদেশ পশ্চিম বঙ্গ। গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ মানুষ একবেলা মাঠে আরেক বেলা কুমোর শালায় কাটায়, মহিলা সম্প্রদায় সন্তান সন্ততি মানুষ করে। পুরুষদের জন্য রান্না বান্না করে, পুতুল গড়তে সাহায্য করে, গোবর ডাঙ্গা গ্রামের নিকটবর্তী বড় শহর মুকুট মনিপুর, কিন্তু গ্রামবাসীর সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। উল্টো বড় শহরের বড় বড় বাবুরাই হাটে আসেন, কিনে নিয়ে যান মাটির পুতুল। গ্রামবাসীদের তরফ থেকে মাসান্তে একবার বড় হাটে গিয়ে বিক্রি করে আসলেই হল। কাহিনীর পত্তন এখানেই। দ্বিজুর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে গ্রামে বেশ কিছু গুঞ্জন চালু আছে। বৃষ্টি বাদলার মাস নয়, শুকনো খটখটে  দিনের আকাশে এক ফোঁটা মেঘের চিহ্নও ছিল না। সেই  কাকভোর থেকে ঘরের কাজ করে দ্বিজুর পোয়াতি মা মায়া মন্ডল। পড়ন্ত বিকেলে ঘরে ফেরার বেলায় ক্লান্ত স্বরে তারা বাগচিকে  বলেছিল, ‘পেটের শত্তুরটা নড়াচড়া করে বড় জ্বালায় লো, দিবা রাত্রি বড়ই নড়াচড়া করে’। পুতুল গড়তেছে লো, ছেলেটা পুতুল গড়তেছে, প্যাটে আর মাটি লাই, তাই হাকর পাকর করতেসে বাইরে আসবার তরে। সই তারা বাগচি বলেছিল, আরও তিন তিনটা মাস  লো! সবুর সইবে তো? মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘বাপটাও কবে থেকে শহরে, মনটা ভালো ডাকছে না সই’।
     কথিত আছে, মা আর মায়ের সখীর কথা শুনতে পেয়েছিল ছেলেটা। সন্ধ্যের দিকে যেই না ঘনঘটা করে আকাশ সেজে বসল, অমনি বের হওয়ার জন্যে হাঁচড় পাঁচড় শুরু করল কচিটা। গোবর ডাঙায় এক চিলতে জমি অনেকেরই আছে, এই গ্রামে সেটা তেমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয়। যাদের আছে তাদের আছে, যাদের নেই তারা মালিকের সঙ্গে লাঙল দেয়, ঝড় বৃষ্টিতে এক সঙ্গে বীজ বপন করে, তার পরে যখন ছোট ছোট চারাগুলো তির তির করে হাওয়ায় কেঁপে বড় হয়, সদ্যোজাত শিশুর উপযুক্ত যত্নে সেই চারা একটা একটা করে তুলে নিয়ে বপন করে। পাকা ধান কাটা থেকে মাড়াই, সমস্ত কিছুই গ্রামের নারী পুরুষেরা একসঙ্গে করে। এই কারণে গোবর ডাঙায় কোন দিন কারো ঘরে তালা চাবির প্রয়োজন হয় না। ঘর তৈরির সময়ে ঘরে শিকল যোগ করা হয় মাত্র। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ অনাহুত কারও ঘরে ঢোকে না।
     গোবর ডাঙ্গার জীবন মাটি ভিত্তিক। একাধারে এই মাটি যেমন ধান ফলায়, অন্য ধারে এই সরেস মাটি ছাড়া কুমোরপাড়া এখানে গড়ে উঠত না। তবে কার্তিক কুমোরের ছেলে দ্বিজু কুমোর সেই সম্পর্ককে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। এই তল্লাটের চৌদ্দ পুরুষের স্মৃতিতে এই রকম মাটির পুতুল গড়ার ক্ষমতা কারো দেখা যায়নি। দ্বিজু এই গ্রামের পুতুল গড়ার ইতিহাসে  এক কিংবদন্তি, কথাটা বললে দ্বিজুর অসাধারণ সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। গ্রামের বয়স্ক সম্প্রদায় দ্বিজুকে নিয়ে গর্বিত। 
     শুনেছি, নাকি কার্তিক মন্ডল শহরে গিয়ে আবার একটা নতুন সংসার ও ফেঁদেছে, তার নাম নাকি সরমা। সত্যি বলতে কি, সেই ছেলেটাও আর ছোটটি নেই। দেখতে দেখতে ‘এক কুড়ি পাঁচ-ছয় ‘বয়স হয়েছে। দুর্ভাগা ছেলেটা, ছোটবেলা থেকে একা একা বড় হল, বাপের ভালবাসার ছিটেফোঁটাও পেল না। 
     সড়কের ধারঘেষে গলি, গলির শেষের ঘরটা দ্বিজুর। টিনের ছাউনি দেওয়া দুটো ঘর, একটিতে দ্বিজু অন্যটি পুতুল ঘর। শোয়ার একটা চৌকি, দ্বিজুর দিন চলে যায়। ঘর থেকে অনতিদূরে টিউবওয়েল, দ্বিজুকে জলের জন্য বেশি দূরে যেতে হয় না। জ্বালানী, ঘর সংলগ্ন বাঁশঝাড় থেকে আসে। মাসান্তে একবার হাটে যায়, সারা মাসের তৈরি করা পুতুল বিক্রি করে সমবায়কে পাওনা টাকা দিয়ে বাকিটা দিয়ে বাজার করে, রং তেল, ছোট খাটো টিনের গয়না (পুতুল সাজাতে কাজে লাগে) কিনে। স্বাধীনতার পর পরই এই গ্রামে কিছু উন্নয়ন হয়েছিল, তার মধ্যে গ্রামের চারটি কোনে চারটে টিউবওয়েল বসানো ছাড়াও কয়েকটা স্যানিটারি টয়লেট ও একটি সমবায় সমিতি। প্রত্যেক কুমোর পুতুল বিক্রির কিছু টাকা এখানে জমা রাখে। দ্বিজুুর অবদান সব থেকে বেশি। মায়া মন্ডল বেঁচে থাকতেই শুরু হয়েছিল, এখনও তাই চলছে। দ্বিজু জানে গ্রামবাসী তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। মাসের শেষে টাকা বেঁচে গেলে সেই টাকা দিয়ে বীজ কেনা হয়। 
     দ্বিজুর ভিতরটা মুচড়ে ওঠে এক অব্যক্ত বেদনায়। গ্রামের কেউ জানে না কী দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে পাঁচ বছর ধরে। শীতের সময় রাতের বেলা মায়ের জন্য বুকের ভিতরটা হুহু করে ওঠে, ভালো করে ঘুম হয় না কতো রাত। দিনের বেলা নীরবে পুতুল গড়ায় ডুবে না থাকলে দ্বিজু হয়তো বা শোকে মরেই যেত। কয়েক রাত্রি নিদ্রাহীন ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। শহুরে এক মহিলা, তার মায়েরই বয়েসি হবে। কে, কে আপনি? আরে ছ্যেকড়া, দিনের বেলা জেগে দিবাস্বপ্ন। তর ছোটলোক বাপটা আমারে ফেল্যে চলে গেল, তাই আমি এখানে চলে এলাম। না না এতো হতেই পারে না, আপনে আমার মায়ের স্থানে কিছুতেই লিতে পারেন না, দ্বিজু বলেছিল। সদ্য পুতুল বিক্রির কয়েকটা নোট দ্বিজুর কোমরের খুঁতিতে বাঁধা ছিল সে দিন। কিছু না ভেবেই তাড়াতাড়ি এগিয়ে দিয়েছিল টাকাগুলো। একটা একটা করে গুণে আঁচলায় বাঁধতে বাঁধতে বলেছিলেন, ‘আবার পরের মাসে আসব। সেই থেকে শুরু, সৎ মা প্রথম প্রথম মাস কাবারি আসতেন, টাকা নিয়ে চলে যেতেন। টাকা নিয়ে সরমা কী করে তা জানতেও চায় না দ্বিজু, কিন্তু এখন ওঁর আগমন দ্বিজুর পক্ষে এক অত্যাচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেলা শেষে আসবেন, এসেই নানা জমা খরচ কৈফিয়ত চাইবেন, কটা পুতুল হল, সংখ্যা পছন্দ না হলে আলসেমি কমাতে উপদেশ দেবেন, তীব্র সমালোচনা করবেন। তিরষ্কার যেন নিত্য দিনে সকালের নাস্তা। একলা মানুষ, সে প্রতিবাদ করতে পারে না, বুদ্ধিমতী সৎ মা সেটা জানতে বাকি নেই। দ্বিজুর এই লজ্জা কারও কাছে প্রকাশ করার মতো নয়। মাস শেষ হতে চললো, এক হপ্তা বাদে হাটবার, সরমার আসার সময় এসেছে। সন্ধ্যের পরে কাজ করতে অসুবিধে মেলা, লন্ঠন জ্বালানো হ্যানো-ত্যানো, তাই দিনের আলোতে যতটা কাজ করে ফেলা যায় ততই ভালো। অন্য মনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে শিশু পুতুলটা তৈরি করছিল দ্বিজু। কৃষক রমণী পিঠে ছেলে নিয়ে গ্রামের রাস্তায় চলেছে কিংবা মায়ের পিঠে শিশুর মূর্তি, গ্রামের পথে অহরহ দেখা যায়, কি কারণে এই ধরনের মূর্তি শহুরে বাবু বিবিদের খুব পছন্দ, না জানা থাকলেও ভালো দামে বিকোয়। শিশুমূর্তি তৈরীর কাজ শেষ, মামূর্তি তৈরি করছে, এমন সময়ে অষ্পষ্ট দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ এলো। আত্মগ্লানিতে নিমজ্জ দ্বিজু চৌকির পাশে মাটি তেল রং তুলি ছড়িয়ে রেখে চৌকি থেকে নেমে পড়ে। মা বলতো, ‘জল খেলে সব অসুখ সেরে যায়’।
     কুজ্যের জলটা বেশ শীতল। জলটা মুখে দিতে বুঝতে পারে তেষ্টাছিলো বেজায়। আরও অনেকটা জল গড়িয়ে যায়। লন্ঠন জ্বালিয়ে বিছানার ধারে রাখে। ছোট একটা কুপি জ্বালায় উঠোনে, জলচৌকির ধার থেকে পুতুলটা তুলে নিয়ে বিছানায় বসে। নিশ্বাসের শব্দটা এবার আরও একটু ষ্পষ্ট। হঠাৎ একটা ঠান্ডা কনকনে অনুভূতি দ্বিজুর শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায়। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হয়েছে ছোট্ট মাটির পুতুলটা আওয়াজ করছে। ‘না’ আজকে আর কুনো কাজ হবেক না। ‘মামূর্তি কাল বানাব’। অজানা হতাশা দ্বিজুকে ছেয়ে ফেলে, বেশি রাত না হওয়ায় একটু কাজ করে। সড়কধারে লক্ষ্মী পালের মিষ্টির দোকানের পাশে বড় একটা গাড়ি, অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেটা প্রথম লক্ষ্য করে লক্ষ্মী পালের ছেলে নাতু। এই অঞ্চলে একটাই মাত্র সিমেন্টের তৈরি দোকান। নাতু ঘর থেকে বৃদ্ধা পিসিমাকে ডেকে আনে। গ্রাম্য মহিলাকে গাড়ির সামনে দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে কলকাতা পত্রিকার রিপোর্টার রিকি মল্লিক, প্যান্ট শার্ট পরিহিত শহুরে তরুণী। জার্নালিষ্ট মহিলাটিকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নাতুর পিসি। প্রশ্ন করে মাসি এথায় কি কিছু প্রয়োজন আছে? 
     হ্যাঁ... না... করে বলে, এইটা কি গোরবডাঙ্গা গ্রাম? 
     ... হ্যাঁ গা মাসি, কেনো?
     ... তোমাদের মানে, আপনাদের এখান থেকে অসাধারণ সব মাটির মূর্তির চালান যায় শহরে, এই গ্রামকে নিয়ে একটা আর্টিকেল... মানে খবরের কাগজে লিখতে চাই। এখানে কেবা খপরের কাগজ পড়ে ! তা এখানে বস্যি থাকলে হবেক লাই, আমাদের গোপালকে ধরো ওই সব জানে। রিকি মল্লিক মাথা নেড়ে বলে, ও জানে। গাড়ি থেকে খাতা পেনসিল বের করে আনে রিকি, মহিলাকে দেখিয়ে দেখিয়ে নোট করে নেয়। তার পরে লালমাটির ধূলো উড়িয়ে মুকুটমানি পুরের সস্তার হোটেলের পথ ধরে। 
     অন্য দিনের মতোই সূর্য ওঠা ভোরে দ্বিজুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। বিছানার পাশে এখানে ওখানে ছড়ানো মূর্তি, কয়েকটার রং বাকি, কয়েকটা আগুনে পোড়ানো বাকি। দ্বিজু নিজের মনে হাসে, কাল রাত্রে শিশু পুতুলটাকে নিয়ে একটি মজার স্বপ্ন দেখেছে। হাসতে হাসতে খিড়কি খুলে দেয়। সকালের সূর্যরেখা তখন উঠোনে এসে পড়ে, ওর ভালো লাগে। হাতমুখ ধূয়ে মাটির তাল নিয়ে বসে পড়ে। অন্যমনস্ক, চোখে পড়ে কাল রাত্রে যেখানে রেখে গিয়েছিল শিশু পুতুলটা সেখানেই আছে। দিনের আলোয় পুতুলটাকে যেন আকারে একটু বড় মনে হয়। কাজ করতে করতে মাঝে মাঝেই কৌতুহলী চোখে তাকায়, না মনের ভুল। পুতুলটার থেকে উলটো দিকে ফিরে কাজে ডুবে যায় দ্বিজু। 
     দুপুরের রোদ এসে মাথায় পড়েছে, খিদেও পেয়েছে, উঠতে হবে। খানিকটা কৌতুহল নিয়েই দ্বিজু পুতুলটার দিকে ফিরে তাকায়। সকালবেলা যে রকম দেখেছিল, ঠিক সেই রকমই আছে। আরও একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য কাছে গিয়ে দেখে। নিজের অজান্তেই হাতে তুলে নেয়, একটু উষ্ণ লাগে পুতুলটা এতক্ষণ রোদে পড়ে ছিলো, তেতে গেছে, দ্বিজু নিজেকে বোঝায়। দ্বিজু ঠিক করে, এই অশান্তির পুতুল তৈরির কাজটা যদি একেবারে শেষ করে দেওয়া যায়, তা হলে আর চিন্তা করতে হবে না। রং তেল কালি নিয়ে দ্বিজু বসে পড়ে।
     বাড়ির সামনে বিরাট বটগাছের ছায়ায় যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, তখন দ্বিজুর খেয়াল হয় সকাল থেকে নাওয়া খাওয়া কিছুই হয়নি। সারা দিনের ক্লান্তি চোখে জড়ো হয়, ভাবতে ভাবতে কিছু খেয়ে ঘুমনোর জন্য তৈরী হয় দ্বিজু। কী মনে করে পুতুলটাকে সদর দরজার বাইরে রেখে শিকল লাগিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করে।
     অন্য দিনের মতো রান্না ঘরে ছোট্ট কুপিটা বিছানার পাশে জ্বালিয়ে রেখে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে দ্বিজু। হেমন্তের রাত, আর পাঁচটা রাতের মতোই কুয়াশাচ্ছন্ন, ভারী নিস্তব্ধ। আচমকা ঘুম ভেঙে যেতে দ্বিজু একটু অবাক হয়। কিছুক্ষণ বিছানা থেকে না উঠেই ভাঙা ঘুমটাকে জোড়াতালি দিতে চেষ্টা করে, এমন সময় আওয়াজটা আবার। ঠাহর করে, ঠিক করাঘাত নয়, নিঃসন্দেহ ভারী একটা জিনিস নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দরজার উপর এসে পড়ছে। দ্বিজু উঠে পড়ে, কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে কুপি নিয়ে দরজা খুলতেই, একরাশ হিমেল হাওয়ায় কুপিটা দপদপ করে ওঠে, তার মধ্যেই দ্বিজু দেখে নিয়েছে। আকারে এক বছরের সাঁওতাল শিশুর মতো, সকালের শিশু পুতুলটা। যেন ওর ঘুম ভাঙানোর জন্যে গড়িয়ে গড়িয়ে দরজায় এসে পড়েছে। ওর মনে পড়ে সকালে চোখমুখের সব কাজ শেষ করে মিশকালো রঙে চোবানোর সময় পুতুল যেন নড়ে উঠেছিল। দ্বিজু হাসে, গলার স্বর নামিয়ে ঘুমজড়ানো গলায় প্রশ্ন করে, ঠান্ডা লাগছে? হাতের কম্বলটা ছুড়ে দেয় নিজের অজান্তে ওর একটা নাম দিয়ে ফিসফিসে গলায় বলে ওঠে, বলাই রাতদুপুরে আওয়াজ করিস না, সবাই ঘুমায়। দরজাটার শিকল আরো ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে ঠান্ডায় কুঁকড়ে মুকড়ে শুয়ে পড়ে। 
     রিকি মল্লিক গোবরডাঙ্গা গ্রামের বিখ্যাত কারিগর দ্বিজুর নাম, তার শৈশবের গল্পকথা শুনেছে। রিকি বুঝেছে, এমন একজনের সাক্ষাৎকার নিতে পারলে তার সাংবাদিক জীবনের প্রথম প্রতিবেদন বেশ সাড়া ফেলবে। যে দু-তিনজন গ্রামবাসী রিকির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছে, তাদের মাধ্যমে রিকি বুঝেছে, দ্বিজু পাগলাকে ইন্টারভিউর জন্যে রাজি করানো প্রায় অসম্ভব। রিকিকে দ্রুত পরবর্তী পদক্ষেপ চিন্তা করতে হবে। মুকুটমনিপুরে বেশিদিন পড়ে থাকা চলবে না।
     রিকি তথ্য নিয়ে জানে, দ্বিজু মাসে একবার হাটে আসে। ভোরবেলা দরজা খুলে দ্বিজু আবিষ্কার করে বলাই দু’দিনে বেড়ে দু’বছরের সাঁত্ততালি ছেলের মতো দেখতে হয়েছে। দ্বিজু ওকে ঘরে নিয়ে আসে, অন্য আর চারটে পুতুলের সঙ্গে না রেখে  বিছানার পাশে একটা মাদুর বিছিয়ে তার জায়গা করে দেয়। পুতুলটা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। ওকে অগ্রাহ্য করে দ্বিজু অসম্পূর্ণ কৃষক রমণী মাতৃমূর্তি তৈরি করার কাজে মনোনিবেশ করে। দু’দিন বাদে হাট তার আগে অন্তত চার পাঁচটি মূর্তি তৈরি করা দরকার। বসন্তের শুরুতেই নতুন ধানের বীজ লাগবে। কিন্তু তার থেকেও বড় দুর্ভাবনা, হাট শেষেই সরমা এসে উপস্থিত হবে এবং পছন্দ মতো মাসকাবারি তোলা না পেলে তীক্ষè কটুক্তি করবে। সরমার নিজের বিলাসে কার্পণ্য মেনে নেবে না। সেটা দ্বিজুর পরিস্কার স্মরণে আছে। আগের মাসেই সরমা এক তাল মাটি ছুড়ে ওকে মারতে এসেছিল। কিন্তু বলাইয়ের উপদ্রবে দ্বিজুর কাজ বেশি দূর এগোতে পারেনি। দ্বিজু ওর দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলে, বলাই চুপ কর। 
     বলাই অন্য সব মাটির মূর্তির মতোই চুপ করে বসে আছে। ওর ঠোঁটের কোণে এক তৃপ্তির হাসি। একমাত্র কম্বলটা তখনও বলাইয়েরই গায়ে, দ্বিজু নিতে গিয়েও হাত সরিয়ে নেয় আশঙ্কায়, কম্বল সরাতে গেলে বলাইয়ের ঘুম ভেঙে যায় যদি। পরিত্যক্ত একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে সারা দিনের অভূক্ত দ্বিজু ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়ে।
     সূর্য এখন দিক চক্রবালের অনেক নিচে। দ্বিজুর ঘুম ভেঙে যায়। অপরিসীম ক্লান্তিতে দুচোখের পাতা বুজে এসেছিল। দুহাতে চোখ রগড়ে দ্বিজু বলাইয়ের দিকে ফেরে। এই চার দিন ধরে একটা নিদারুণ দুঃস্বপ্ন দেখেছে, এমন একটা আশার মুহূর্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আজ হাটে গিয়ে, কাল সন্ধের সময় এসে উপস্থিত হবে। আধো-আলো অন্ধকারে দেখেছে ওর বিছানার পাশে বলাই বসে আছে, প্রায় যেন একটা পাঁচ বছরের খোকার আকারে।
     অনূভব করে যেন ওর মাথা চোখ বেয়ে একরাশ কালো ডেয়ো পিঁপড়ে হেঁটে চলেছে, ওর শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণু গলধঃকরণ করে। এমন সময় দুম দুম করে সদর দরজায় করাঘাত, দ্বিজু সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। 
     কী র‌্যা ছেকড়া ঢ্যামনা, কবে য্যে আবার ছেকল লাগাচ্ছিস হ্য। ভাবখানা যেন ছেকল দিয়ে সরমাকে আটকাবি? দ্বার খোল, ঘাটের মড়া কোথাকার। সরমার অনবরত ধাক্কায় আদ্দিকালের মরচে পড়া শিকল ভাঙতে দেরি হয় না। সাহস কম না আটকুড়ির বেটা। ঘরের ভিতরে পা রেখেই মারমূর্তি সরমা সহসা চুপ করে যায়। দ্বিজুর রক্তবর্ণ চোখ, ছড়ানো ছিটানো রং কালি, লণ্ডভণ্ড বিছানা, সব মিলিয়ে একটা অন্য রকম ভাব সরমার নজরে পড়েছে। কী করছিলি? সরমা সুচালো চোখে দ্বিজুকে দেখে। দ্বিজু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সাধারণত সরমা হাটের দিন পার করে আসে। 
     সময় পাইনি কোনরকমে মুখ তুলে বলে দ্বিজু, সরমা মাদুরের উপর বসে আছে। এই এত্ত বড় একটা খোকা বানালি কেন, তাও দেখো ছ্যেনার চোখ ট্যেরা, মরণ। দ্বিজু, সরমার নজর বলাইয়ের কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করে। সরমার অভিযোগ মিথ্যে নয়। বলাই নিদারুণভাবে ট্যারা, ওর দু’চোখের দৃষ্টি বিপরীত দিকে নিবন্ধ, ভালোবেসে নিজ হাতে গড়াতো, ট্যারা তবুও মনে হয় লক্ষ্মীট্যারা। 
     গত মাসে ফাঁকি দিয়েছিস, কত টাকার মাল যাচ্ছে হাটে দেখা আগে। সরমার দৃষ্টি এখন পুরোপুরি বলাইয়ের দিকে। অ্যা আবার মাদুর পাতা হয়েছে, ট্যেরা চোখের মাল দু’পয়সাতেও বিকোবে না। দে দেখি এক্কেবারে নিকুচি করে আসি। বসে থাকা দ্বিজুকে ডিঙিয়ে এক ঝটকায় বলাইকে তুলে নিয়ে বাইরের শক্ত মাটিতে ছুড়ে ফেলার জন্যে সরমা হন হন করে বাইরে বেরিয়ে যায়। আর একটু পরেই সূর্য়োদয় হবে।
     রিকি ফেরার পথ ধরে। যদিও ক্লান্ত লাগছে, জ্যোৎ¯œার আলো অন্ধাকারে শুশুনিয়া পাহাড়ের রূপ দেখে রিকির মন ভরে গিয়েছে। রিকি ঠিক করে লোকজন উঠে পড়ার আগে গ্রামের রাস্তায় কোথাও দাঁড়িয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। সেদিক দিয়ে দেখলে গ্রামের উত্তর পূর্ব কোনটা সব থেকে সুবিধেজনক। উপরন্ত ওই দিকটাতেই দ্বিজু থাকে। দেখাই যাক না সাতসকালে গিয়ে হাজির হলে তাড়িয়ে দেবে না নিশ্চয়ই। আজ হাটের দিন, গ্রামের শুভ দিন, উৎসবের সঙ্গে রিকির মন দ্বিজুর ঘরের দিকে পথ ধরে।   
     রিকি দ্বিজুর ঘরের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। এখনও ভালো করে সূর্য ওঠেনি। সাতসকালে শহুরে কোন বাবুর গাড়ী, একজন মহিলা বাচ্চার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক দ্বিজুর ঘরের পাশে। এই শীতের সকালে বাচ্চাটার পরনে একটা সুতোও নেই। রিকি অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করে। কিছুক্ষণ আগের পরিতৃপ্তভাব অন্তর্হিত হয়ে যায়। নিজেকে সামলে, রিকি ছোট্ট একটা হর্ণ দেয়। গাড়ির হেড লাইট উচুঁ করে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে বাইরে বেরিয়ে আসে। ষ্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে মজা হচ্ছে? কথাটা মুখ থেকে বের হওয়ার আগেই রিকি মুখচেপে থেমে যায় হাহড্রোলিক ব্রেকের মতো।
     দ্বিজুর ঘরের সামনে মানুষাকারের মাটির প্রতিমা, দিদিমার হাত ধরা সাঁওতালি বাচ্চা। অপূর্ব কারিগরি দক্ষতা। যেন রিকির গাড়ির আলো পড়ার আগের মুহূর্তে জীবিত ছিল দুটো মানুষ। ভীতিমিশ্রিত শ্রদ্ধার অনুভূতি আপ্লুত, রিকি মাটির রাস্তায় বসে পড়ে। অভিজ্ঞতা থেকে রিকি জানে, আন্তর্জাতিক সংগ্রহ শালায় সঠিক মূল্যায়ন হবে এই দিদি-নাতির যুগল প্রতিমা।
     এই অজপাড়া গাঁয়ে, গ্রাম্য কুশলী হাতের স্পর্শ দিয়ে মাটিতে এমন প্রাণের ছোঁয়া এনেছে তার সঙ্গে দেখা না করে রিকি মল্লিক কলকাতা ফিরছে না। দ্বিজুর ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে রিকি মল্লিক। উঠোনের উপর বসা মানুষটা যেন ওরই মতো অবাক হয়ে ফ্লাডলাইটের আলোয় নিজের সৃষ্টির দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। 
     রিকি মল্লিক গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে। দ্বিজুর দিকে ঘুরে তাকায়। ক্ষণিকের জন্য, গ্রাম্য সরল চেহারার মুখটা সহজ হাসির আভাস খেলে যায়। গাড়ি থেকে টেপ রেকর্ডার ক্যামেরা নোট বই বার করে রিকি।

জাহ্নবী জাইমা। ঢাকা