অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
ছায়া বীথি - জাহ্নবী জাইমা

 মার বড় আয়েসের দিন তাই ঘুম থেকে দেরি করে উঠি। শোওয়ার ঘরের পিছনে মাঝারি একটা ঝুল বারান্দা আছে। তাতে রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েসটাকে জায়েজ করে বসি। পশ্চিম থেকে সকালের রোদ আসে না, তাই অনেক ক্ষণ বসে থাকা যায়। এদিকটা লোকালয় থেকে একটু দূরে বলে বেশ নির্জন, দিব্যি লাগে। চোখের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউ খেলানো শস্যভূমি, তার মধ্য দিয়ে লাল সুরকির রাস্তা রঙিন ফিতার মতো বেঁধে রেখেছে। ছড়ানো ছিটানো গাছপালা। ছোট একটা টুলে চা রেখে যায় জিলুর, মৌজ করে খাই আর পুরনো পেপার পড়ি বেশ সময় নিয়ে। কাজ যে একেবারে থাকে না এমন নয়। বাংলাদেশের শেষ সীমান্ত অঞ্চল, টেকনাফ। সেখানেই শাহ্ পরীর দ্বীপে হেলথ সেন্টারে ডাক্তার হয়ে এসেছি। চব্বিশ ঘণ্টাই ডিউটি আওয়ার্স এখানে। সাগরের অগনিত ঢেউয়ের মতো অগনিত রুগী। দু’দণ্ড জিরোনোর অবকাশ নেই। না, দোষ দিচ্ছি না। মানুষগুলি করবেই বা কি? আগে পিছে মাইলের পর মাইল শাহ্ পরীর দ্বীপের কোথাও কোন আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই।
     সেই লাইসেন্সধারী কোয়াক ডাক্তারই একমাত্র ভরসা। জীবন জীবিকার মানে মৎস্যচাষ, সাগরে মাছধরা প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা। ইদানিং একটা পাকা সড়ক হওয়ার তোড়জোড় চলছে, অবশ্য জল পথই সচারচর ব্যবহারে সুবিধাজনক। মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মতো নারীরাও প্রকৃতির মতো নির্মল সরল সুন্দর। গ্রামের মান্যগণ্যদের নিয়ে একটা কমিটিও তৈরি হয়েছে। আমাকেও কমিটি ভুক্ত করতে চেয়েছে, কৌশলে এড়িয়ে যাই।
     যা হোক, খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে কাপে চুমুক দিতে যাব ঠিক সেই সময় মোটর বাইকের ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে চেঁচামেচিতে চায়ের কাপ ঠোঁটের কাছে ধরেও রেখে দিলাম। দেখি একটা বুড়ো ঝিরকুটে লোককে রাস্তার উপর ফেলে বেধড়ক মারপিট করছে দু’টি ছেলে। লাল গেঞ্জি পরা মাতব্বর গোছের লোকটি মনে হলো গুণ্ডা-পাণ্ডা। বাইকে আসীন হয়ে এক পেশে লড়াইয়ের নির্দেশ দিচ্ছে। আমাদের মধ্যখানে গাছ-গাছড়ার কিছু আড়াল থাকায় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি, কিছু বলবো কিনা ভাবছি। পাণ্ডাটি দেখে ফেললো আমাকে। মনে হলো চেনে আমাকে। চেঁচিয়ে বলল খুব খারাপ হারামি টাইপের লোক, ছিনতাই করে পালাচ্ছিল। লোকটা অবশ্য প্রতিবাদে কিছু একটা বলল গোঙিয়ে। বুঝলাম না। মনে হলো আদিম ভাষা। এর মধ্যে জিলুর এসে পড়েছে বারান্দায়। দেখলাম ছেলেগুলো এবার অসমরণে ভঙ্গ দিল। বাইকে চড়ে পড়লো চটপট। তারপর যেমন এসেছিল তেমনি বিকট শব্দে বাইক জোরে হাঁকিয়ে চলে গেল উল্টো পথে। ছিনিয়ে নেয়া দ্রব্যটি উদ্ধার হলো কি না বুঝলাম না।
     জিলুর বলল ভিতরে চলুন স্যার। এসব ঝামেলায় থাকবেন না। পচারি পাড়ার ছেলে ওরা, খুব খারাপ। পচারিপাড়া নামটা এখানে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই জেনেছি। গঞ্জের সীমানায় কয়েকটা কাঠ চেরাইয়ের কল আছে সেটা পেরিয়ে একটা আদ্যি কালের একচালা ভাঙ্গা বাড়িকে নিয়ে একটা মহলা গড়ে উঠেছে। টিনের কয়েকটা ঘর। রং মাখা মেয়ে মানুষদের বসতি। বিগত যৌবনা থেকে শুরু করে সদ্য রজঃস্বলা দুর্ভাগা কিশোরি, পুরুষের রিরংসা মেটাতে সকলেই মজুত। পচাই বা বাংলা মদেরও ঠেক আছে একটা। নামটা হয়তো সেটা থেকেই গজিয়েছে। কয়েক দিন আগে একটি এনজিও সংস্থার উদ্যোগে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছিলাম সেখানে। সে এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা। সে কথা থাক, এই মুহূর্তে লোকটিকে ফাস্ট এইড না দিলেই নয়। জিলুর যথারীতি আমাকে নিষেধ করলো। কিন্তু আমি আবার একটু সেকেলে টাইপের। যতই হোক, মানব সেবার শপথ নিয়ে ডাক্তার হয়েছি। বিবেক মানবতা এসব প্রাগৈতিহাসিক শব্দে এখনও হোঁচট খাই। বেসরকারি চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে এই সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসেছি সেই মূল্যহীন কারণে। অতএব মুমূর্ষু একটি মানুষকে রাস্তায় কীভাবে পড়ে থাকতে দেখি। উল্টো জিলুরকেই ঠমক দিলাম। সে ভয়ে নিমরাজি। তবে কথা শুনলো রাস্তায় গিয়ে পাঁজাকোলে করে লোকটিকে নিয়ে এসে নিচের বারান্দায় শুইয়ে দিল। দেখলাম বেশ ভালো মতোই হাতের সুখ করা হয়েছে বেচারার উপর। নাক থেকে রক্ত পড়ছে। ঘুসি খেয়ে বা চোখে মারাত্মক রক্ত জমাট ক্ষতো। পরনে একটা সাদা হাফ হাতা শার্ট। তার পকেটটা ছিঁড়ে ঝুলছে। জামার একটি বোতামও আস্ত নেই। কঙ্কালসার বুকের সবকটি পাঁজর উন্মুক্ত উপহাস করছে। খাকি প্যান্টের পিছনটা ঘঁষটে গিয়ে শরীরের কিছু অংশ বেরিয়ে এসেছে। সেখানেও লাল রক্তের ছোঁপ। বয়স খুব বেশি মনে হলো না, ষাটের এধার ওধার হবে। তবে জিলুর লোকটাকে নিয়ে এল বটে। কিন্তু ধরে রাখা যাচ্ছে না। ভয়ে বা সংকোচে হোক সে কিছুতেই বসবে না। পাগলের মতো বিড়বিড় করে মাথা নেড়ে কেবলি উঠে পড়তে চায় দু’হাতে ভর করে। শেষে জিলুরের ধমকে একটু স্থির হলো। ঘোলাটে চোখে কেমন তীব্র দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ জরিপ করলো আমায়। তারপর অনেকটা যেন বাধ্য বিড়ালছানার মতোই চুপটি করে সেবা নিতে লাগলো। ততক্ষণে আমি তুলোয় ঔষধ লাগিয়ে ফাস্ট এইড শুরু করে দিয়েছি। জিলুর এ অঞ্চলের লোক নয় তবু দেখলাম লোকটিকে চিনে। জিলুর বলল, পচারি পাড়ার ওধারে একটা শ্মশান আছে, ওখানেই পড়ে থাকতে দেখেছে। হয়তো ভিক্ষে করে খায়। হতে পারে পেটের টানেই কিছু চুরি-টুরি করেছে, ধরা পড়ে অমন বেমক্কা ধোলাই খেলো। যে দেশে যেমন নিয়ম আর কী।
     কী আর করি মোটামুটি একটু চিকিৎসা এবং কিছু খাবার-দাবার দিয়ে লোকটিকে দাঁড় করলাম। সুস্থ্য হতেই নির্বাক চলে গেল সে। কিন্তু দেখলাম আমাকে ভোলেনি সে। কৃতজ্ঞতা বসেই হোক কী ক্ষুণ্নিবৃত্তির আশা হোক, বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। আমার সঙ্গে চোখা চোখি হয়। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কেমন যেন। মনে হয় কিছু বলতে চায় অথচ বলে না।
     ইতিমধ্যে একদিন সালেম ভাই এলেন। বাষট্টি তেষট্টি বছর বয়স। এ অঞ্চলের গণ্যমান্য ব্যক্তি। পেশায় ব্যবসায়ী নানা রকমের কারবার। ইদানিং জনসেবাও শুরু করেছেন। শুনছি আগামী বছর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ভোটে দাঁড়াবেন। পচারি পাড়াতে তাঁর উদ্যোগেই মেডিকেল ক্যাম্পিং বসেছিল। গ্রামের উন্নয়ন কমিটির সভাপতি তিনি। আমার কাছে এসেছিলেন রক্তচাপ মাপতে। জিলুর আবার লোকটিকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। মিছরি মুখের পিছনে ছুরি নিয়ে ঘোরে না কি?
     আমারও অবশ্য তেমনি মনে হয়। অকারণ অমন বিগলিত হাসি নিয়ে কথা বলা। আর দু’চোখের অমন জম্বুক নজর। ওসবের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত আমি। তখন চৈত্রমাস, সন্ধ্যে প্রায় শেষ। আকাশে কেমন কালো দমকা বাতাস বইছে। কাল বৈশাখীর পূর্বাভাস টের পাচ্ছি। সালেম সাহেব এসেছেন মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে। এ চরে এটাও একটা উন্নয়নের লক্ষণ। সাইকেল থেকে মোটর সাইকেল। তার অবশ্য একটি টয়োটা করলাও আছে। তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর একটু খেজুরে আলাপ করলেন। এই যুবক বয়সে একলা একলা থাকি কীভাবে? একটা টিভি পর্যন্ত নেই। চাইলে সব ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। এমনকি, পার্ট-টাইম শঙ্করীরও। আমি দার্শনিকের হাসি হাসলাম। এই এলাকার মাতব্বর তিনি। চটানো ঠিক হবে না। এই হেলথ সেন্টারে ডাক্তারি করি। ঔষধও তেমন নেই রুগী অনুযায়ী। তার সহযোগিতা প্রয়োজন হবে আমার। হাসপাতালের স্বার্থে চুপ থাকতে হবে। সুতরাং কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো সালেমদের সুনজরে থাকতেই হয় আমাদের। চলে যাবার পথে সেই আধ পাগল বুড়ো লোকটির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। গেটের মুখে রাস্তার ওপারে একটা ঝাঁকড়া পলাশ গাছ, বেশ ফুল এসেছে। লোকটি গাছ তলায় নীরব বসে আছে। সালেম ভাইকে দেখতে পেয়েই সে উঠে দাঁড়ালো ঝটাস করে। চোখের দৃষ্টি পাল্টে গেল তার। কোটরে বসা গালদুটো একেবারে ইস্পাত কঠিন। ঠোঁট নড়ছে অনবরত। সালেম ভাই বললেন খুব জ্বালাচ্ছে দেখছি। পাগলটা এখানেও এসে জুটেছে। সাবধান থাকবেন ডেঞ্জারাস লোক। শুনে আশ্চর্য হলাম। তবে সালেম ভাইয়ের কথায় প্রত্যয় হবো এতটা মুর্খ নই আমি। সে যে মাঝে মধ্যেই এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সে তথ্য গোপন রেখে বললাম, আপনি চেনেন নাকি? শুধু আমি, এই এলাকার সবাই চেনে। সালেম ভাইয়ের কণ্ঠে কিঞ্চিৎ উপহাস! পাগোলটা একদিন ভিস্তিওয়ালা ছিল। পানি সাপ্লাই করতো পচারি পাড়ায়। এখন আর তাগদ নেই। এদিক সেদিক ঝেড়ে ঝুড়ে পেট চালায়। খতরনাক লোক। রসও শেষ হয়নি। এই বয়সেও পচারি পাড়ায় গিয়ে হামলা করে।
     শুনে কেন জানি বিশ্বাস হলো না, তবুও উনার কথাতেই সায় দিয়ে বললাম, থানায় খবর দিলেই তো হয়। তাই দিতে হবে। এখনতো সরকারি কাজেও বাধা দেওয়ার তাল করছে। সরকারি কাজে মানে? আরে এই রাস্তার কাজে। শ্মশানের ধার দিয়ে যাবে রাস্তাটি। হারামজাদা ওখানে একটা কৃষ্ণচুড়া গাছের নিচে থান গেড়ে বসেছে। বললাম না এই বয়সেও রস খুব। একটা শঙ্করীও আছে সঙ্গে। বলে কিনা রাস্তা ঘুরিয়ে দিতে হবে গাছ কাটা চলবে না। ভাবুন তো কী আস্পর্ধা। আমি বললাম, তা রাস্তা একটু ঘুরিয়ে নিলে ক্ষতিই বা কী? সালেমের মুখে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠে, স্টার্ট দিতে সজোরে বাইকে লাথি কষালো। খোলস থেকে বেরিয়ে বলল, আপনি মাইরি, শিক্ষিত হয়ে এসব বলেন কী করে। থান, মাজার এসব মানলে চলবে? যতো সব পুরোনো সংস্কার। আপনার সংস্কার আগে নাকি উন্নয়ন? তাছাড়া রাস্তা ঘুরলে অসুবিধা আছে। পচারি পাড়াটা তুলে দিতে হয়। এতোগুলো পেট চলছে, তারা আছে তাই আমাদের মন ভালো থাকছে। পচারি পাড়া উঠে গেলে তাদের দায়িত্ব নিবে কে? আপনি? তা বটে, এবার আমি খোলসে ঢুকলাম। সালেম চলে যাবার সময় চোখ টিপে বললেন, ফালতু বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ব্যাচেলর মানুষ, একলা আছেন এনজয় করুন জীবনটাকে। একটাই তো জীবন। কিছু দরকার হলে বলবেন আমাকে। আমি আবার সেই দার্শনিকের হাসিটা মুখে ঝুলিয়ে দিলাম স্ক্রিন সেভারের মতো। ইঞ্জিনের বিকট শব্দে চলে গেলেন সালেম। পরক্ষণেই ঝড় উঠলো। শুকনো পাতার সঙ্গে লাল ধুলোর আবির। এক ছুটে নিজের ডেরায় ঢুকে পড়লাম। 
     পরদিন রুগী একটু কম ছিল। কী মনে করে পচারি পাড়া পেরিয়ে শ্মশানের দিকে হাঁটতে লাগলাম। ইচ্ছে করেই সাইকেল নিলাম না। স্যান্ডেলে লাল ধুলো মাখতে মন্দ লাগে না। আমি না চিনলেও অনেকেই আমাকে চেনে তাদের কৌতুহলী চোখের নজরেই বুঝতে পারছি সেটা। এদিকে একটা তিরতিরে ঝরণার পানি বয়ে চলেছে উপরের পাহাড়ের গা বেয়ে। চারপাশে শুকনো বালি। গ্রীষ্মকালে অবশ্য তা বিলিন হয়ে যায়। যা হোক, কাঠ চেরাইয়ের কল ছাড়িয়ে শ্মশান পেরতেই হঠাৎ সেই লোকটিকে দেখতে পেলাম, সাগরের তীর থেকে উঠে আসছিল তার হাতে ঝরনার পানি ভরা দুটো বোতল। আমাকে সে দেখেছে বলে মনে হলো না। একদিকে ভালোই হল। পিছু নিলাম, আমার আসল গন্তব্য তার ডেরার উদ্দেশ্যেই ছিল। দেখি কিছুটা হেঁটে একটা লম্বা কৃষ্ণচুড়া গাছের কাছে থামলো সে। গাছের নিচে খড়ের একটা ঝুপড়ি। শীর্ণতনু প্রৌঢ় মহিলা উবু হয়ে বসে আছে। শাড়ি পরার ধরনে হরিজন মনে হলো। লোকটি পৌঁছতেই মহিলাটি উঠে দাঁড়িয়েছে, তার পিছনে আমাকে দেখে মহিলা অপ্রস্তুত। কৌতুহল নিয়েই এসেছিলাম। ওদের দেখে কৌতুহল আরো বেড়ে গেল। কিন্তু এখন কী করবো বা বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। শেষে লোকটিই আমাকে উদ্ধার করলো। বোতল দুটি মাটিতে নামিয়ে হাত নেড়ে সেই আদি ভাষায় কি সব বলল মহিলাটিকে। মহিলা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল আমার সামনে। হাতজোড় করে বলল, “বাবুজি আপনাকে হামি চিনি, খুব বড়া ইনসান আছেন। হামাদের বাঁচান বাবুজি।”
     মহিলাটি বুড়োর বউ হবে। দেখছি সে আমার দয়াবান হৃদয়ের বিষয়ে ইতিপূর্বেই অবগত। ভনিতা না করে সরাসরি আর্জি জানিয়েছে তাই সমস্যাটি কী অনুমান করতে পারি। সালেম আগেই বলে রেখেছে। তবু জিজ্ঞাসা করলাম। প্রৌঢ়া মহিলা ফুলন্ত কৃষ্ণচুড়া বৃক্ষের দিকে জীর্ণ হাতটা দেখিয়ে বলল, বাবুজি এই যে গাছ দেখছেন। এ হামার জান আছে বাবু। মানুষ বলছে নতুন সড়ক হবার পর এটা কেটে নেবে। তাতে ক্ষতি কী? অন্য গাছ লাগিয়ে দেব বরং তোমাদের জন্য চেয়ারম্যনকে পাকা ঘর বানিয়ে দিতে বলবো আমি।
     বুড়ো বুড়ি একসঙ্গেই হাউমাউ করে উঠলো। বুড়ি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল গাছের গোড়ায়, দেখি একটা শিবলিঙ্গের মতো পাথর, মাটিতে গেঁথে তার উপর ফুল ছড়ানো রয়েছে। জানো বাবুজি এটা কী? ন্যূব্জ শরীরে যতটা পারা যায় ঋজু হয়ে সোজা আমার চোখের দিকে চেয়ে যা বলল, তাতে বুঝলাম গল্প আছে কিছু। সত্যি বলতে শুনতেই তো আসা। কৌতুহল দেখিয়ে বললাম, কী করে জানবো, তুমিই বলো। আপনি জানেন না? মহিলার চোখে বিষ্ময়। মাথা নাড়লাম, বললাম, কী করে জানবো আমি তো নতুন এসেছি এখানে। মহিলা একটু ভাবলো। স্থির দৃষ্টিতে চাইলো আমার চোখে। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে একটু উদাস গলায় বলল, তবে শুনুন, ত্রিশ বছর আগের নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম। কেউ মেনে নেয়নি। তাই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে ছিলাম। এখানে এসে ঘর বাধি। পেটে সন্তান আসলো। বাচ্চা হতে গিয়ে মরে যাচ্ছিলাম। ভগবান বাঁচিয়ে রাখলেন, একটি কন্যা সন্তান জন্মালো। ডাক্তার বলল আর কখনো মা হতে পারবে না। দুঃখ পেলাম না, আমার মেয়েটা এতই সুন্দর হলো মন ভরে গেল, নাম রাখলাম রাণী। “একদম রূপ কী রাণী”। দিন ভালোই যাচ্ছিল। আমি মানুষের বাসায় কাজ করতাম। ও জেলেদের সাথে মৎস্য শিকারে যেতো। রাণী বড় হতে থাকে আর আমাদের খুব ভয় হচ্ছিলো। গরিবের এতো সুন্দর কন্যা কী মানায়? কী বলবো বাবুজি, যে ভয় করতাম একদিন তাই হলো। আমার মালিক ছিল সালেম সাব, তার ছেলে একদিন রাণীকে নিয়ে পালিয়ে গেল। সালেম সাব বলল চিন্তা করিস না। বিয়ে করে ফিরে আসবে। এক মাস পর মালিকের ছেলে একা ফিরলো ঘরে কিন্তু রাণী ফিরলো না। আমরা পঞ্চায়েতে শালিস বসালাম, পুলিশের কাছে গেলাম, কোন লাভ হলো না। রাণী হারিয়ে গেল। আমি কাজ ছেড়ে দিয়ে খুঁজতে লাগলাম রাণীকে। পেটের দায়ে পানি বিক্রি করে আমার স্বামী পচারী পাড়ায়। কি বলি বাবুজি, ওই পাড়াতেই রাণীর সাথে দেখা হলো। এভাবে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল। কিন্তু রাণীকে আনতে পারলাম না।
     গ্রামের চেয়ারম্যান, থানা, পুলিশ সব করলাম রাণীকে কেউ ফিরিয়ে দিল না। তার উপর গুন্ডারা এসে আমার স্বামীর জিহ্বা কেটে ফেললো বাবুজি! থামলো, সে কাঁদছে না। কোটরাগত চোখ দূরের নদীর মতো শুষ্ক। জোরে বাতাস বইছে হঠাৎ। মাথার উপরে গাছ থেকে ফুল ঝরছে। উড়ে উড়ে পড়ছে মাথার উপর। ঘরে ফেরা কয়েকটি পাখি কিচিরমিচির করছে। লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম। গাছটির মতই নির্বাক। দুচোখে সেই অদ্ভ‚ত দৃষ্টি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। দেখতে পারছি না আর লোকটিকে। মগজের মধ্যে একটা মাইন ফুটিয়ে দিয়েছে বৃদ্ধা। তার পর কী হলো জানতে চাও বাবুজি। মহিলা বিরবির করে আবার বলতে শুরু করলো। এক দিন সালেম সাব পচারি পাড়ায় গিয়ে রাণীকে বলে, এই খাবার খেয়ে নাও তোমাকে তোমার বাবা-মার কাছে দিয়ে আসি। সে খুব অত্যাচারি লোক সে কথা রাণী ভুলে যায়। রাণী বুঝতেই পারেনি সেটা ছিল বিষ মিশানো খাবার। রাণী বাড়ি ফেরার আনন্দে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলো, তারপর ঢুলতে ঢুলতে বাড়িতে এলো। রাণী মুখে সাদা ফ্যানা উঠে মারা গেল। সালেম রাণীকে ঠিকই ফিরিয়ে দিল। আমরা পেলাম লাশ। তার পর সালেম শাসিয়ে গেল যদি কেউ জানে তোদের দুজনকেও মেরে ফেলবো। রাণীর লাশ ছুঁবে না কেউ, পতিতা ছিল তাই। ওই নদীর কিনারে আমরাই পোড়ালাম তাকে। একটু ভাবো বাবুজি রাণীর এই অবস্থা কে বানালো নির্লিপ্ত গলায় বলছে মহিলা। আমি পুরো স্ট্যাচু। স্থবিরের মতো শুনছি। চোখে পানি না এলেও মহিলার গলায় এখন জমাট বাষ্প। ঢোক গিলে বলল, আপনি বিশ্বাস করবেন না বাবুজি, যে মেয়েকে জিন্দা পাইনি আমরা জানতাম তবুও বেঁচে আছে। যাকে পাঁচ বছর ধরে চেয়েছি কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। মরে যেতেই আমরা পেয়ে গেলাম আমাদের রাণীকে। আমার সত্যি শরীর কেমন ছমছম করছে। বুড়ো আচমকাই কী একটা বলে উঠলো গোঙিয়ে। মহিলা সেদিকে একটু নজর দিয়ে বলল, জানেন নতুন অনেক সুন্দরী কিশোরি, তরুণীদের ওরা নিয়ে আসে জোর করে পতিতাবৃত্তি করায়। রাণীর বাবা গিয়ে হামলা করে মেয়েদের বাঁচাতে, কেউ এগিয়ে আসে না তার সাথে। পুলিশও তার কথা শোনে না। আপনি তাদের বাঁচান।
     যখন ইচ্ছা তখন সালেমের গুন্ডারা রাণীর বাবাকে ধরে মারে, কখন যে মেরে ফেলে ভয়ে থাকি সবসময়। আমি চুপ করে ভাবছি কী করা যায়। লোকটিকে সেদিন পেটানোর কারণ পরিষ্কার হলো এতক্ষণে। আপনি শুনছেন তো বাবুজি? মহিলা বলেই চলেছে, হ্যাঁ শুনছি মাথা দোলালাম আমি, মহিলা সেই পাথরটার দিকে হাত দেখিয়ে বলল, রাণীকে পুড়িয়ে দিয়ে ছাঁইয়ের সাথে যা কিছু ছিল সব পুঁতে দিলাম এইখানে। তারপর এই পাথর চাপিয়ে দিলাম ভগবান শিব লিঙ্গের, রাণীর আত্মার শান্তি চেয়ে। তখন এই গাছ ছিল না, রাণীর বাবাই ঐ কৃষ্ণচুড়ার গাছ লাগিয়েছিল। বড় সুন্দর ছিল আর ফুলের মতো নরম কোমল ছিল সে। এখন এই গাছের নিচেই কেমন জীবন্ত রাণী। আবার চুপ করে পরম মমতায় কৃষ্ণচুড়ার গুড়িতে হাত বোলাচ্ছে, সে কেঁদে উঠলো। তারপর আচমকা বসে পড়লো মাটিতে। এতক্ষণে দেখলাম তার দুচোখ ভেসে যাচ্ছে পানিতে, তবুও দম নিয়ে বলল, আপনি বলেন বাবুজি এই গাছ আমি কীভাবে কাটতে দেই। যে গাছের নিচেই আমার রাণী শুয়ে আছে। আপনি কিছু করেন, দ্বিতীয় বার রাণী থেকে আমাদের সরিয়ে দিবেন না। আচ্ছা দেখবো বলে ফিরে এলাম ডেরায়। আজও স্বপ্নে দেখি অপরূপ এক পরী এসে বলছে বাবুজি আমি রাণী, ঘুম ভেঙ্গে দেখি দু’চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

জাহ্নবী জাইমা। ঢাকা