অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
বিহঙ্গ কথা - রেজওয়ান আহমেদ

  চিরচেনা অদ্ভুত এক বিরক্তি পেয়ে বসেছে ম্যারুকচিকে। অদ্ভুত এক ভালো লাগেনা রোগ। কিছুই ভালো লাগেনা। কিছুই না। সব ছেড়েছুড়ে উড়ে যেতেও ভালো লাগেনা। সম্ভব হতো যদি, নিজের পাখনা আর ঠোঁট জোড়া হিসেবে কেটে বিক্রি করে দিতো কোনো লোকালয়ের বাজারে। বেয়াড়ার মতো একেকটা মুহূর্ত আসে, থাকে, ঘণ্টাখানেক যন্ত্রণার কিচিরমিচির বাজিয়ে চলে যায়। 
     সশব্দে ডানা ঝাপটায় ফুশুকপি। ম্যারুকচির পছন্দের পাখি। পাখিশাস্ত্রমতে ম্যারুকচি ফুশুকপির সাথে যা করছে, তা ঘোর অন্যায়, অধর্ম। চি কখনো পি এর সাথে মিশতে গেলে তাতে চি এর জাত যাবে। অধর্ম বটে! তবে ম্যারুক এসবের ধার ধারেনা। জন্মের দশ মিনিট পর থেকেই ডপেনচির হুকুম - ছেলে যেন পাখিসমাজে বাপকে ছোট না করে। ম্যারুকের সেই থেকে বাপের সাথে দূরত্ব। এ সুর কিঞ্চিৎ চোখ গরম করেই দিয়েছিলো ডপেন। যে পাখি ছেলেকে রেগে সোজা করতে চায়, সে কেমন পাখিবাপ? সুরগুলো অন্যভাবে সাধলেও পারতো। রাগটা এত বেশি কেন এর? এ কি পাখি? না পশু?
     শব্দ বেশি নিতে পারে না ম্যারুক। বিরক্তি বাড়ে। নিজেও ডানা ঝাপটে ভাব বিনিময় করতে আগ্রহী হয় না সে। তাই ঠিক হয় সাক্ষাতে কথা হবে ফুশুকের সাথে। হতে পারে এলাকার সোনালি ব্যাংকের পুরনো ভবনের ছাদে অথবা মেইন রোডের পাশে গোলাপি বাসাটার কোনো একটা জানালার কার্নিশে।
     এ পাড়ার মানুষের ছেলেপেলে বেশিরভাগই বখাটে। গুলতি মেরে সেদিন ম্যারুকের পা ফুলিয়ে দিয়েছে ওদেরই কেউ। এতটা হাতসই?! বাবা! সে ডাকে বাবা ছুটে আসেনি ম্যারুককে বাঁচাতে। মনুষ্যপিতা হলে নিশ্চয়ই হাত ধরে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেত। মাঝে মাঝে মানুষ হতে খুব ইচ্ছে হয় ম্যারুকের। হয়তো একটু ভালো থাকা যেত এর থেকে তাহলে। আর ইলেকট্রিক তারে পা রেখে ঠায় নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না তবে। সেভাবেই নিজের কষ্টের কিচিরমিচির ফুশুককে শুনিয়ে চলছিলো ম্যারুক। হঠাৎ মাথা সোজা করে বাঁদিকে তাকিয়ে দেখলো ফুশুক নেই। অবশ্য না থাকাটাই স্বাভাবিক। এসব পচা সুর শুনতে কার ভালো লাগবে? কারোই লাগেনা, কারোই লাগেনি। ফুশুকের আগেও তিনজন উড়ে গেছে। চারবারই কিচিরমিচিরে এতটাই মজে ছিলো ম্যারুক, যে ছটফটিয়ে উড়ে যাওয়ার শব্দ তার কানে ঢোকার সুযোগই পায়নি।
     এক, দুই, তিন বা চারজনের উড়ালে কিছুই হয়না। হারানোর তালিকাটা এক জীবনে কম বড় নয়। এক এক করে ছেঁড়া পালক জুড়ে সুস্থ করলে সে উড়েই যাবে। পোষ আর মানবে না। পোষ মানায় জীবন নেই, উড়ালেই জীবন। কারো কিচিরমিচির শুনতে গেলে দিনমান আঁধারে হারায়। আঁধার পড়তে পড়তে সব পাখি নীড়ে ফিরবে - এটাই পাখিসমাজের রীতি। উত্তরাধুনিক পাখিরা সে সমাজের বাইরে। এমন নিঃসঙ্গ উত্তরাধুনিকদের জন্য দুচারটা চলে যাওয়া এমন কিছু নয়। এরা আরো গভীর নিঃসঙ্গতার পূজারী।
     দলবেঁধে কতো পাখিই ত উড়ে বেড়ায় একই আকাশে। পাখিদের আকাশের কোনো আন্তর্জাতিক সীমারেখা নেই, নেই জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন অথবা গ্রাম সীমারেখা। আকাশবদলে আকাশের নীল বদলায় না। নিচে তাকিয়ে দেখলে বদলে যায় সোনালি ব্যাংক অথবা গোলাপি বাসা। এ পর্যন্তই। এরপর মাথা ঘুরে কোনো লাল অথবা ধূসর মাটি। এক জীবনের ক্লান্ত উড়াল শেষে হঠাৎ শূন্য। শূন্য মানেই সুখ, সুখ মানেই শূন্য।

রেজওয়ান আহমেদ
পটুয়াখালী, বাংলাদেশ