নাকফুল - ফজলুল হক সৈকত
ছোট্ট একটি মেয়ে মধুখালি গ্রামের, পাশের চাঁইপাড়ার, হিন্দুপাড়ার নারী-পুরুষ-আবালবৃদ্ধবণিতার মন জয় করেছিল হাসি আর প্রাণখোলা উদারতা দিয়ে। যেদিন সে মারা গেল, তার মৃতদেহ একনজর দেখবার জন্য বাড়িতে নেমেছিল মানুষের ঢল। এমন কেউ ছিলো না যে সেদিন কাঁদেনি তার জন্য। যখন কাফনের কাপড় পড়ানো মুখটি সামান্য সময়ের জন্য খোলা রাখা হয়েছিল, শেষবারের মতো দেখাবার জন্য, তখন মুক্তার মতো মেয়েটির নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল তাজা রক্ত। ডাকাতদের হাত থেকে এই মেয়েটি আপন বুদ্ধিমত্তায় নানির দেওয়া, তার জন্মের মাস সাতেক আগে মারা গিয়েছিলেন নানি সৈয়দী নেছা, নাকফুলটি বাঁচাতে পেরেছিল ঠিকই; কিন্তু তার নাক থেকে গড়িয়ে-পড়া লাল রক্তের স্রোত ঠেকানোর কোনো শক্তি এই সামান্য বালিকার ছিলো না। কে জানে, আজও হয়তো নীরবে কারো কারো মনে কোনো অবসরে ভেসে ওঠে ওই মেয়েটির নাকের নদীতে সরুরেখায় বয়ে-চলা স্রোতটির লাল আভা!
মেয়েটি বছর পঁচিশেক আগে এই পৃথিবীর সকল মায়ার বন্ধন ছিঁড়ে অজানার দেশে পারি জমিয়েছে। ডিফথেরিয়া নামক প্রায় অচেনা রোগের নৌকায় চড়েছিল সে। নৌকা থেকে নামবার আগেই, আরোহনের মাত্র ঘন্টাখানেকের মধ্যেই, ডুবে গিয়েছে পানির অসীম গভীরতার অতলে। এককালে না-কি ডিফথেরিয়া অনেকের প্রাণ নিয়েছে। কিন্তু যখন এই মেয়েটি মারা গেল, তখন ওই রোগের নাম অনেকেই ভুলে গিয়েছিল। এমনকি তার ডাক্তার বাবাও টের পেয়েছিলেন সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর। তার মৃত্যু হয়েছিল পঁচিশে রমজানে। আমরা প্রায় সকলে, এদেশে যারা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি, ইংরেজি কিংবা বাংলা সাল অনুসরণ করি। কিন্তু এই মেয়েটির ক্ষেত্রে হয়েছে হিজরি সালের হিসেব। প্রতি বছর মাহে রমজান মাসে, ঈদ-উল-ফিতর আসার মাত্র দিন চার-পাঁচেক আগে, আচমকা মেয়েটি কারো কারো মনের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে যেন বাইরের আলো-বাতাসে নেমে আসতে চায়।
তার বড়ো নাম ছিল মনিরা আক্তার। স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার সেকেন্দার স্যার বলতেন: ‘মনিরা আক্তার। বাপ তার ডাক্তার।’ তার ডাক নাম মুক্তা। মুক্তার মতোই ছিল বারো বছরের মেয়েটি। মৃত্যুর পর তার কোনো ফটোগ্রাফ পাওয়া যায়নি। তার কোনো ছবিই তোলা হয়নি। কী দুর্ভাগ্য তার পরিজনের! তখনও স্কুলে ভর্তির সময় ফটোগ্রাফ জুড়ে দেওয়ার নিয়ম চালু হয়নি। একটা ছবিতে না-কি তাকে দেখা গিয়েছিল, তার নানাভাইয়ের ছোটভাইয়ের জানাজার আগে উঠানে তোলা একটি গ্রুপ ছবিতে। কিন্তু পরে ওই ছবিটিও আর উদ্ধার করা যায়নি।
জন্ম হয়েছিল রাজশাহী জেলার পুঠিয়া থানার ঝলমলিয়া গ্রামে। বিদ্যুতের আলোয় না, গ্রামটি না-কি (গ্রামের প্রায় মাঝখানে ছোট একটি বাজারও ছিল; আছে এখনও) মানুষের আনন্দ আর ভালোবাসায় সারাক্ষণ ঝলমল করতো। মৃত্যুর আগে বলা চলে প্রায় বারোটি বছর তার একটানা কেটেছে একই থানার অন্তর্গত মধুখালি গ্রামে। এটি ছিলো ওই জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম। পাশের গ্রামে, নাটোর জেলার অধীনে, বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়তো মেয়েটি; কিন্তু স্কুলটির নাম ছিল (এখনও আছে) চন্দ্রকলা হরিকালিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশের গ্রাম চন্দ্রকলার হিন্দুরা এই স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে চলা হোজা নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দিত; আর এই ঘাটেই ছিল তাদের শ্মশান। হয়তো হিন্দুপ্রভাবের কারণেই মুসলিম অধ্যুষিত বালিয়াডাঙ্গায় গড়ে উঠেছিল হরিকালি স্কুল। স্কুলের পশ্চিমকোণে নদী আর খালের মোহনার পাশে বিশালাকার বটগাছের তলায় প্রায়শই চোখে পড়তো সিঁদুরমাখা কলা আর কলাপাতায় রাখা কিছু বাতাসা বা সন্দেশ। দেবতার জন্য রাখা এইসব প্রসাদ মুসলমান ছেলেরা প্রায় প্রকাশ্যে চুরি করে খেয়ে ফেলতো। মুক্তার মৃত্যুর বিশ বছর পূর্তিতে এই স্কুলপ্রাঙ্গণে মুক্তার নামে একটি গণপাঠাগার তৈরি করতে গিয়ে, নিজের প্রচেষ্টায় কিছু বই-এর বন্দোবস্ত এবং এক বন্ধুর সহায়তায় একটি বই রাখার তাক প্রস্তুত হওয়ার পরও, তার বড়ো ভাই ব্যর্থ হয়েছে ভিলেজ পলিটিক্সের নোংরা ছোবলে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান লাইব্রেরিটির নাম রাখতে চেয়েছিল তার বাবার নামে।
বকুল ফুলের একটি মালা গেঁথেছিল মেয়েটি। মরবার দিন কয়েক আগে। মালাটি তাদের শোবার ঘরের পলেস্তরা-খসা দেয়ালে টাঙানো ছিল প্রায় বছর পাঁচেক। শুকিয়ে গেলেও গন্ধ ছড়াতো। বাড়িটি ছেড়ে তার পরিবার নাটোরে বনলতা সেনের দেশে (তারা বাড়ি বানানোর বেশ কিছুকাল পর পাশে গড়ে উঠেছে বনলতা ফিলিং স্টেশন) পাড়ি জামাবার দুই বছর পর তার একমাত্র বড়োভাইয়ের হাতের সামান্য ছোঁয়ায় ঝড়ে পড়েছিল মালাটি ধুলোজমা মেঝের ওপর। মুক্তার মতো ঝলমলে এই মেয়েটির মৃত্যুর সাথে আরেকটি কষ্টও হয়তো এই পরিবারটিকে স্থানান্তরে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। ডাকাত পড়েছিল বাড়িতে। মেয়েটি মরবার মাসতিনেক আগে হবে হয়তো। ডাকাতরা বাড়ির দামি অলঙকারাদিসহ ঘটি-বাটি-মশারি-বদনাও না-কি লুট করেছিল। আসলে তারা ডাকাতি করতে আসেনি; তাদের লক্ষ ছিল মেয়েটির বাবাকে মেরে ফেলা। এখানে সামান্য রাজনীতির ব্যাপার ছিল। মেয়েটির বাবা ছিলেন জিউপাড়া ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। কোনো এক নিকটাত্মীয় না-কি ওই চেয়ারে বসার স্বপ্নে বিভোর হয়ে জ্ঞাতি ভাইকে হত্যা করার জন্য ভাড়া করে লোক এনেছিল দূর গ্রাম থেকে। ডাকাতরা তার বাবাকে চিনতে পারেনি। ঘর থেকে দৌড়ে পালাতে গিয়ে তিনি পথের ওপর হোচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। অচেনা ডাকাতরা তাকে ধরে বাইরের উঠানে আম গাছের সাথে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছিলেন- এ বাড়ির কেউ নন তিনি; বেড়াতে এসেছেন পাবনা থেকে। সেদিন মেয়েটি ভারি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল। তার নাকফুল যখন ডাকাতদের একজন খুলে নিতে গেল, সে বলেছিল: “এইডা আমার নানি দিছে, আমি এইডা আপনাগো দিবো না”- কী দুঃসাহসের কথা! আর বলেছিল- “আমার আব্বা বাড়িতে নাই।” মেয়েটির ওপর হয়তো মায়া জন্মেছিল ডাকাতদের। তারা নাকফুলটি নেয়নি; মরবার পর সেইটি তার মৃতদেহ থেকে কে খুলেছিল কিংবা আদৌ খুলতে পেরেছিলো কি-না, তা বোধহয় আজ আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু অনেককাল তার এই নাকফুল রক্ষার গল্পটি মুখে মুখে গল্প হয়ে ফিরেছে। আর ডাকাতরা কেন যেন, তার সরল মনের টানে হয়তো, তাকে বিশ্বাস করেছিল। তার বাবাকে না পেয়ে তারা ফিরে গিয়েছিল।
তারপর গ্রাম ছাড়লেন ডাক্তার কাম ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবুল হোসেন। গ্রামের সকল স্মৃতি আর মমতাকে ছেড়ে, জীবিত এক কন্যা, দুই পুত্র আর বিবি মমতাজের হাত ধরে। সংসারের অবশিষ্ট ঘটি-বাটি পিতার ভিটামাটিতে ফেলে রেখে। রাজনীতি ছেড়েছেন তিনি। প্রায় বছর দশেকতো নিজের ডাক্তারি থেকে কামানো পয়সা, বাবার দেওয়া সম্পত্তি থেকে আয়ের পয়সার সিংহভাগই ব্যয় করেছেন ওই রাজনীতির পেছনে। আর কতো! ছেড়েছেন মধুখালি গ্রাম। বাড়িটির বদলে বড়োভাইয়ের কাছে যে নারকেল বাগানটি নিয়েছিলেন, তাও খুইয়েছেন এইতো বছর দুয়েক আগে- বড়ো মেয়ের ফ্রিডম না-কি ইনডিপেন্ডেন্ট কোম্পানির শেয়ারের ক্ষতি শোধ করবার জন্য। পেছনে পড়ে আগে কেবল মুক্তার ধসে-পড়া কবর। পঁচিশে রমজানে মসজিদে কিছু বাতাসা বিতরণ আর মাঝে-মধ্যে কবরের পাশ দিয়ে যাবার সময়, যদি কোনো কারণে যাওয়া হয় ওদিকে, দাঁড়িয়ে কিংবা ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছু দোয়াদরুদ- এইটুকু জমা আছে মুক্তার মতো মেয়েটির জন্য। মধুখালি মসজিদের পশ্চিমে পারিবারিক গোরস্থানে তার পাশে শুয়ে আছেন তার দেখা পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ দুই সদস্য দাদা আলহাজ্ব আনোয়ার আলি আর আদরের দাদি আহিমজান।
মাইলখানেক দূরের আগদিঘা হাট থেকে শুক্রবার কিংবা মঙ্গলবারে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে, তরি-তরকারির ব্যাগ হাতে নিয়ে, বাড়ি ফেরার সময় হাটফেরত লোকদের সাথে কতো কথা যে বলতো মেয়েটি! এই গ্রামের, ওইগ্রামের, ওপাড়ার কতো কে যে ছিল তার পথচলার গল্পবলার সাথী! কথা বলার জন্য পরিচয় থাকাটা তার কাছে কোনো জরুরি ব্যাপার ছিল না; কথা বলতে বলতেই পরিচিত হয়ে উঠতো সে।
মাঝে মাঝে এমন হয়েছে, পাকা আম কাটছে- সবাই খাবে বলে, বড়ো বটিতে শরীরের হালকা ভার চাপিয়ে আম কাটছে ছোট মেয়েটি। পাশে বসে তার বড়ো ভাই, ছোট ভাই খাচ্ছে পাকা আম। তাদের আঙুলের ফাঁক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আমের রস। মাছি উড়ছে চারপাশে। আম কাটা শেষ হলে দেখা গেল মেয়েটির খাবার জন্য এক চিলতে আমও অবশিষ্ট নেই। অবশ্য তাতে তার কোনো কষ্ট ছিলো না। হাসিমুখে বলতো: “থাক। আমি পরে খাবো।” গ্রীষ্মকালে পুকুরে পানি শুকিয়ে উঠলে কলতলায় কতোজনের গোসলের পানি তুলেছে সে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা করা যায় না। এই মেয়েটি, যে কি-না অপরের জন্য নিজের কষ্টকে কষ্ট মনে করেনি, একদিন একটা সামান্য কষ্টে কেঁদেছিল খুব। এই যে, যে দাদাজান তার পাশে ঘুমাচ্ছেন এখন, মুক্তার মৃত্যুর বছর দুয়েক কি তিনেক আগে সংসারের হাড়ি-পাতিল আর জমি-জমা, বাগানাদি সন্তানদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়েছিলেন। কী যে তার বিচার- কাঁঠাল বাগান আর আম বাগানটা দিয়েছিলেন বড়ো ছেলেকে। ছোট ছেলে আবুলের জন্য, তার সন্তানদের জন্য রাখেননি ফল খাবারে কোনো ব্যবস্থা। ছোট ছেলে আবুলকে জমিজমা ভাগ-বাটোয়ারার সময় ঠকানোর পেছনে ছোট একটা ইতিহাস আছে। নিঃসন্তান ছোটভাই আলহাজ্ব আনোয়ার আলির কাছ থেকে তার ছোট ছেলে আবুলকে শৈশবে পালক নিয়েছিলেন। কিন্তু অল্পকাল পরেই মারা গেলেন তিনি। পালক মাও সংসার ছাড়লেন- নতুন কোনো সংসারের সন্ধানে। শিশু আবুল রয়ে গেল নিজের মায়ের কাছে। সেই থেকে না-কি আবুলের ওপর বাবার মায়া-মমতা ছিল কম। অবশ্য মা তার ছেলেকে নিজের করেই ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কাম-কাাঁঠালের দিনে একদিন ঝড়ের সময় আমবাগানে আম কুড়াতে গিয়েছিল মুক্তা। ঝড়ের বাতাস সামলে নিয়ে আম কুড়াচ্ছিল বড়ো চাচার বাগান থেকে। দাদাও ছিলেন তখন বাগানে। হঠাৎ তিনি মুক্তাকে বললেন- ‘তুই এখানে আম কুড়াস কার হুকুমে?’ কিছু না বলে সোজা বাড়ি এসে মায়ের কাছে কেঁদেছিল মেয়েটি। আর জিজ্ঞেস করেছিল: ‘আমাগো আম বাগান নাই ক্যান?’
সইপাতানো অনুষ্ঠানের কথা আজও হয়তো মুক্তাদের গ্রামের অনেকের মনে আছে। দুই গ্রাম ওপারের রুয়েরভাগের জবান আলি একবার ভীষণ অসুস্থ হলেন। তার চিকিৎসা করলো ডা. আবুল হোসেন। সুস্থ হয়ে জবান আলি এক আব্দার করলেন ডাক্তার সাহেবের কাছে- তাকে তিনি আত্মীয় বানাতে চান। তার বড়ো মেয়ে মুক্তার সাথে ডাক্তারের মেয়ে মুক্তার সই পাতাতে চান তিনি। এই সামান্য আব্দারে কী আর না বলা চলে? চলে না। আবুল হোসেন রাজি হলেন। ধুমধাম করে দুই বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে, দুইতিন মাইক বাজিয়ে গরু-মহিষের গাড়ি ভর্তি করে এবাড়ি-ওবাড়ি গিয়ে খোশ-আনন্দের মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হলো দুই মুক্তার সইপাতানো অনুষ্ঠান। তখন দুজনের বয়স ছিল নয়-দশের মধ্যে। একজন বোধহয় এক বছরের বড়ো ছিল। কে ছিল ছোট আর কে-বা বড়ো সে প্রশ্ন আজ অবান্তর। যাদের মধ্যে তুলনা করা চলতো, তাদের একজনতো কতোকাল আগেই গত হয়েছে। আর যে এখনও বেঁচে আছে- সংসার করছে পরাণমাঝির সাথে। পরাণমাঝি সংসার-নৌকার বৈঠা ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। কে জানে কোথায় গিয়ে দেখা মিলবে মুক্তার মতো সেই মেয়েটির সাথে! আজও হয়তো পরাণমাঝির বউ খুঁজে ফিরছে তার ছোটবেলার সইয়ের মুখ!
‘সুনীলের মা’ নামে এক বিধবা বৃদ্ধার সাথে মনিরা আক্তার মুক্তার দারুণ সখ্যতা ছিল। সুনীলের মা ছিলেন হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা। জাতিতে চাঁড়াল। তার দুই ছেলে সুনীল-সুশীল আর দুই মেয়ে ললিতা আর আরেকজনের কী যেন নাম- মুক্তাদের বাড়িতে কাজ করতো। সুনীল-সুশীল গরু-মহিষ দেখাশোনা, আর মাঠের যত কাজ তদারকি করতো; বাড়ির কাজের দায়িত্ব ছিল তাদের বোন দুটির ওপর। বাপ মরার পর থেকেই এরা চার ভাই-বোন ডাক্তার কাকার বাড়িতে আসন গেড়েছিল। ঈদ কিংবা পূজা এই চাঁড়াল পরিবারটির জন্য সমান আনন্দ বয়ে আনতো। পিতৃহারা এই কমবয়সি সন্তানগুলোকে কখনো কোনো ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির ঘোরতর অন্ধকারে পড়তে হয়নি। বুড়ি প্রতিদিন আসতেন মুক্তাদের বাড়িতে। সারাদিন থেকে-খেয়ে, গল্প করে, রাতের খাবার আর মেয়ে দুটিকে সাথে নিয়ে তবে সন্ধ্যের দিকে বাড়ি ফিরতেন। ছেলে দুটো থাকতো তাদের এই ডাক্তার কাকার বাড়িতেই। বাড়ির গিন্নিকে এমন করে কাকিমা বলে ডাকতো তারা, শুনে কারো বুঝার উপায় ছিলো না যে ধর্মের কিংবা জাতির ভিন্নতা রয়েছে এদের মধ্যে!
সুনীলের মা না-কি মুক্তা মরার পর প্রতিদিন এ বাড়ির বারান্দায় বসে মেয়েটির জন্য কেঁদেছেন- যতদিন না ডাক্তারের পরিবার অনত্র শিফট করেছে। শোনা যায়, সুনীলদের মা না-কি মরবার আগের দিন পর্যন্ত, নিয়মিত, মুক্তাদের তালাবন্ধ ঘরের সামনে, উঠানে বসে বসে কেঁদে গেছেন। পাড়ার লোকদের কাছে জানা যায়, বুড়ি কেবল বিলাপ করতেন: ‘আহা, মুক্তা মাইয়াডা আমারে পোতিদিন জিগাইত- আমি খাইছি না-কি, থালে কইরা ভাত দিতো, পাশে বইসা বইসা কতো রাইজ্যের কথা যে কইতো মাইয়াডা। এহন আর আমারে খাওনের কথা কে জিগাইব? কে জিগাইব?
ফজলুল হক সৈকত। ঢাকা
-
গল্প//উপন্যাস
-
13-11-2020
-
-