অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
বিসর্জন - ডঃ গৌতম সরকার

  ড়ের সাথে আটবছরের ঝরিয়ার অনেকবার মোলাকাত হয়েছে। ঝড়ে তাদের ঝুপড়ি দুবার উড়ে গেছে, তবে বাবা ঘরে থাকলে ঝড়কে অতটা ভয় পায়না ঝরিয়া৷ বাবা ঘরে নেই, সবাই বলাবলি করছে দুয়েকদিনের মধ্যে ভয়ংকর ঝড় আসছে। ওদিকে বাবা, শনিচাচা, মদন চাচা, গোপালদাদু আরো অনেকে বেশ কয়েকদিন আগে সমুদ্রে মাছ ধরতে গেছে। বলেই গেছে এবারে ফিরতে দেরি হবে। ওরা যখন যায় তখন ঝড়ের কোনো খবর ছিলোনা। গভীর সমুদ্রে মোবাইলের টাওয়ার কাজ করেনা। তাহলে এই ঝড়ের খবর ওদের কাছে পৌঁছবে কি করে! ঝরিয়া খুব ভয় পেয়ে গেল। এদিকে মায়ের শরীরটাও কদিন ভালো যাচ্ছেনা। কাল বিকেলে যখন বিমলা, শাকিলা, বৈজয়ন্তীর সাথে সমুদ্রের পারে বুড়ি ছোয়াঁ খেলছিল তখন এক পুলিশ কাকু মাইকে করে ঝড়ের খবর হাঁকছিলো; সবাইকে সমুদ্রে যেতে বারণ করছিল, যারা গেছে ফিরে আসতে বলছিল। কিন্তু যারা অনেকদূর চলে গেছে, যাদের কানে পুলিশকাকুর মাইকের আওয়াজ পৌঁছবে না, তাদের কি হবে!  সবাইয়ের বাবাই সমুদ্রে গেছে, তাই খেলা জমলোনা। যতক্ষণ প্রচার চললো তারা পুলিশকাকুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলো। সন্ধ্যেবেলা বস্তিতে ফিরে দেখলো খবরটা সবাইয়ের কানে গেছে, বস্তির মানুষগুলোর চিন্তায় আর আতঙ্কে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। 
     গভীর সমুদ্রে জেলেবস্তির মরদগুলো যায় ইলিশ মাছ ধরতে। এবারে চারটে নৌকায় মাছ ধরার সরঞ্জামের সাথে দিন পনেরোর খাবার আর জল নিয়ে বস্তির প্রায় সব পুরুষমানুষই বেরিয়ে গেছে। এখন বস্তিতে মূলতঃ মেয়েরা আর বাচ্চারাই আছে। এখন ভয়ংকর ঝড়ের খবরে সবাইয়ের মুখ শুকিয়ে গেলো, কান্না পেলেও মানুষগুলোর অকল্যাণের ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে কাঁদলোনা।
     পরের দিন সূর্য ওঠার আগেই মেয়ে-বুড়ো-বাচ্চারা সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলো। সূর্য না উঠলেও চারদিকে হালকা একটা আলো ছড়িয়ে পড়েছে। সমুদ্র এখন শান্ত, কোনো ধরনের অসংযমের চিহ্ন শান্ত ঢেউগুলোয় চোখে পড়ছেনা; তবে এই ভোরবেলাতেই একটা গুমোট গরম  টের পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ির মেয়েরা যে যতটুকু উপচার পেরেছে নিয়ে এসেছে সমুদ্র দেবতার পূজোর জন্যে। এটা এখানকার রীতি, ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে বাড়ির মানুষগুলোকে রক্ষা করার প্রার্থনা জানায় তাদের দেবতাকে, বিশেষতঃ এই রকম হঠাৎ হঠাৎ বিপদের সময়। আতপচাল, কলা, প্রদীপ, ধুপকাঠি, বুনো ফুল কাঠের বা পিতলের বারকোশে সাজিয়ে বালিতে গর্ত করে প্রদীপ জ্বালিয়ে সবাই একসুরে সমুদ্র দেবতার গান গাইতে লাগলো।
     অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে পড়েছে ঝরিয়া। মায়ের শরীর খারাপ, কিন্তু ঝরিয়ার ওঠার শব্দে মায়েরও ঘুম ভেঙে গেল। ঝিল্লিকে আর ওঠাতে হলনা, মা নিজে নিজেই উঠে পড়ে। স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে তারাও সমুদ্রের ধারে চলে এসেছে। স্তব গান শেষ হলে পূজো শুরু হলো, ঝিল্লি মাকে হাতে হাতে সব এগিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ কি হলো, মা বসা অবস্থায় পিছন দিকে সটান উল্টে পরে গেল। ঝরিয়া ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলো৷ পাশে বসা ফুল্লরা কাকিমা আর নন্দু পিসি মাকে তুলে বসালো, মায়ের চোখ বোঝা, মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে। কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে মাকে বাড়ি পৌঁছে দিলো। আসার সময় ঝিল্লি পিতলের রেকাবিটা, প্রদীপ আর কটা ফুলের পাপড়ি নিয়ে আসতে পারলো, বাকি সব সমুদ্রের ধারে বালিতে পড়ে রইলো৷
     বিকেল চারটে থেকে এলোপাথালি হাওয়া শুরু হলো। দুবার ঝুপড়ি ভেঙে যাওয়ার পর সমুদ্র থেকে একটু দূরে একটা উঁচু ডাঙার পিছনে ঝুপরিগুলো সকার থেকে নতুন করে বানিয়ে দিয়েছে; ইঁটের দেওয়াল আর মাথায় অ্যাসবেসটস। এখন ঝড়ের বেগের দাপট সরাসরি বাড়িগুলোর ওপর পড়েনা। বাইরে ঝড়ের গর্জন বাড়তে লাগলো, বাড়তে বাড়তে মনে হলো কতকগুলো খ্যাপা ষাঁড় উন্মত্ত আক্রোশে চিৎকার করতে করতে তাদের ঘরগুলোর দিকে ধেয়ে আসছে। মাথার চালটা যেন  হিংস্র কোনো দৈত্য আসুরিক শক্তিতে উপড়ে নিতে চাইছে। ঘরের এক কোনে বসে থরথর করে কাঁপতে লাগলো আট বছরের ঝরিয়া। মা বিছানার এককোনে চোখ বুজে পড়ে আছে। গায়ে আগুন জ্বর ছিল সকালবেলা; ঝরিয়া বৈজয়ন্তিকে নিয়ে এককিলোমিটার দূরের হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিয়ে এসেছে। সেই ওষুধ খাওয়ার পর থেকে মা সমানে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। মাঝে একবার জোর করে তুলে নন্দু পিসীর দিয়ে যাওয়া দুধটা খাইয়েছিলো। বাইরে বাজ পড়ার প্রচন্ড আওয়াজ হলো আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ তাদের ঝুপড়ি ফালাফালা করে কেটে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বেরিয়ে গেল। ঝরিয়া চমকে উঠলো; প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের আওয়াজ আর সাথে বজ্রপাত তাকে মূহুর্মূহু চমকে দিতে লাগলো৷ 
     ঝরিয়ার বাবার কথা ভেবে খুব ভয় করতে লাগলো। বাবা এখন কোথায়! গভীর সমুদ্রের ওই ভীষণ উথাল পাথালে বাবাদের নৌকা ডুবে যায়নি তো! ঝিল্লির গলা দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইলো, মায়ের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে বহু কষ্টে নিজের গলা নিজেই চেপে ধরলো। হঠাৎ একটা অশুভ চিন্তায় আটবছরের একরত্তি মেয়েটার সারা শরীর আতঙ্কে কেঁপে উঠলো। সকাল থেকে মায়ের শরীর খারাপের চিন্তায় এটা এতক্ষণ ওর মাথাতে আসেনি। এখন এটা মাথায় আসতেই ভয়ে, আশঙ্কায় ঝরিয়া কুঁকড়ে ঘরের দেওয়ালে গুটিয়ে যেতে লাগলো। সবাই সমুদ্র দেবতার পূজো করলেও তার মা তো পূজো শেষ করতে পারেনি! তাহলে তো সমুদ্র দেবতা তার বাবাকে রক্ষা করবেনা। তাহলে তার বাবা কি..... ! আর ভাবতে পারলোনা মেয়েটা, দুচোখ ভরা জল নিয়ে মায়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। বাইরে তখন প্রলয়মাতন ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হয়ে উঠেছে। সাঁ সাঁ সোঁ সোঁ আওয়াজে কান ফেটে যাচ্ছে আর সাথে সাথে বিদ্যুতের ভয়াবহ চমকানি। আস্তে আস্তে মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। মায়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে গেল দেওয়ালে টাঙানো ঠাকুরের পটের সামনে। কুলুঙ্গিতে সকালের প্রদীপ, কিছু শুকিয়ে আসা ফুল আর পিতলের রেকাবিটা পড়ে আছে। পাশের প্লাস্টিকের কৌটো খুলে দেখল তলায় কয়েকটা ভাঙাচোরা বাতাসা দেখতে পেল, কিন্তু আতপচাল আর নেই। সে বাতাসাগুলো রেকাবিতে ঢাললো, তারপর রান্নার জায়গা থেকে দেশলাই নিলো, ধুপ, প্রদীপ আর বাতাসার থালাটা নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো।
     বাইরে তখন অন্য পৃথিবী, পৃথিবীর এরূপ বাচ্ছা মেহেটি কখনো দেখেনি। দানবীয় আক্রোশে ঝড়ের মাতন বয়ে যাচ্ছে সারা এলাকা জুড়ে। বালির ঝড় মুহূর্তের মধ্যে ঝরিয়াকে ছিটকে দূরে  ফেলে দিলো। আশেপাশে যে কটি গাছ ছিল কে যেন পৈশাচিক আক্রোশে তাদের ঘাড় মটকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে, কোনো কোনোটাকে মাটি থেকে সপাটে উপড়ে দিয়েছে। সেগুলো এখন মাতাল হাওয়ায় যেন পাখনা মেলে চারদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে। কোনো রকমে উঠে দাঁড়াতে খুনে হাওয়া ঝিল্লির চুলের গোছা নিয়ে প্রলয় মাতন শুরু করলো, মুহূর্তের মধ্যে তার চোখমুখ ধুলোয় আর বালিতে ভরে উঠলো, বালিঝড়ের প্রচন্ড ঝাপটা চাবুকের মতো আছড়ে পড়তে লাগলো সারা শরীর জুড়ে, আর হাত- পা- মুখ ক্ষত বিক্ষত হতে লাগলো, পরনের ফ্রক পতপত করে পতাকার মতো ফুলে ঢোল হয়ে গেল। বাতাসের সাথে অসম যুদ্ধ করতে করতে চোখ বন্ধ করে বাবার মুখটা ভাবতে ভাবতে ঝরিয়া চেষ্টা করলো প্রানপনে সমুদ্রের পাড়ে পূজোর জায়গাটায় পৌঁছতে। দামাল ঘূর্ণি হাওয়ায় হাত থেকে ধুপ, প্রদীপের বাতি কোথায় উড়ে চলে গেলো, ভাঙা বাতাসা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ধুলোবালির ঘূর্ণিস্রোতে মিশে কোথায় মিলিয়ে গেলো। আবার পাগলা উন্মত্ত ঝড় ঝরিয়াকে কয়েক হাত উড়িয়ে সজোরে আছাড় মারল বালিতে, ডানহাতে প্রচন্ড ব্যাথা পেলো মেয়েটি। তারপর ঝড়ের সাথে লড়াই করতে করতে বুকে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে গেলো। চোখ বুজে দুই হাত শূন্যে ছুঁড়ে তীব্র হাওয়ার সাথে লড়াই করতে করতে উঠে দাঁড়ালো। এক হাতে পিতলের রেকাবি আর অন্য হাতে কয়েকটা ফুলের পাপড়ি আঁকড়ে ধরে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে আট বছরের একরত্তি মেয়েটা ছুটে চললো।
     এত বছর ধরে মাছ ধরছে, কিন্তু সমুদ্রের এই ভয়াল-রুদ্র ভয়ংকর রূপ আগে কখনো দেখেনি। এই নৌকায় ওরা পাঁচজন আছে। গত দশ ঘন্টা ধরে যমে- মানুষে যুদ্ধ চালাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্যেও কেউ হাল হাতছাড়া করেনি। গতকাল সন্ধ্যাবেলায় যখন আচমকা ঝড় শুরু হলো, পালটা খোলার সময় পর্যন্ত পায়নি। মুহূর্তের মধ্যেই ভয়ংকর হাওয়ায় পালটা শতছিন্ন হয়ে তাদের নৌকাটা মোচার খোলার মতো ছিটকে কোনদিকে চলে গেল কেউ ঠাহর করতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে হাতের জাল ফেলে দিয়ে পাঁচজনে নৌকার খোলের মধ্যে যে যার জায়গা নিয়ে নিয়েছে। সেই থেকে একমুহূর্তের জন্যেও তারা জায়গা ছেড়ে ওঠেনি। ইষ্ট নাম জপ করতে করতে অমানুষিক পরিশ্রমে তারা যুদ্ধ করে চলেছে এই ভয়ংকর সমুদ্র আর অসুরসম ঢেউয়ের সাথে। ঠান্ডা হাওয়া এবং জলের সাথে কুস্তি করেও তাদের শরীর থেকে সব শক্তি ঘাম হয়ে বেরিয়ে গেছে। কেউ কারোর দিকে তাকানোর ফুরসতও পায়নি, শুধু চিৎকার করে একে অন্যকে সাবধান করে গেছে। তারা দিক হারিয়ে ফেলেছে, নিজেরাও জানেনা কোন দিকে চলেছে ! পাড়ের দিকে, না আরো গভীর সমুদ্র অভিমুখে! এসব ভাবনা চিন্তা করার বোধগুলোও হারিয়ে গেছে। শুধু বেঁচে থাকার উন্মুখ বাসনায় তারা দেহের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করে চলছে এই সর্বসুখ লুণ্ঠনকারী, প্রলয়ঙ্কর বাতাসের সাথে। এখন আর হাত চলছেনা, পা দুটো কেউ যেন অন্ধ আক্রোশে শরীর থেকে ছিঁড়ে নিয়েছে, কোমরের যন্ত্রনা শিরদাঁড়া ভেদ করে নৌকোর খলুই ভেঙে জলের বহু নীচে জমে থাকা কাদামাটিতে গিয়ে ঠেকেছে। এতক্ষন ঠায় বসে বসে তাদের মনে হচ্ছে তারা যেন একেকটা গাছ হয়ে পুঁতে গেছে নৌকোর খোলে। শরীরের সাথে মাথাও যেন কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে, নোনা হাওয়ার প্রচন্ড ঝাপটা মুখ দিয়ে ঢুকে বুকে ভয়ংকর চাপ দিচ্ছে। বুকটা ফেটে যেতে চাইছে, হাঁ করে হাঁফাতে হাঁফাতে একটু বিশুদ্ধ বাতাস খুঁজছে; নৌকোর খোলের ওপর ছটফট করছে পাঁচটা সুঠাম দেহের জওয়ান পুরুষ। সবাই বুঝতে পারছে এবার তাদের যুদ্ধ শেষ হবে, শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে৷ প্রাণপনে বাঁচতে চেয়েছিল….. চোখের সামনে ভেসে উঠছে অনেক দূরে ফেলে আসা বাড়ির মানুষগুলোর মুখ। যখন সকলের হা- ক্লান্ত হাত থেকে হালগুলো খসে খসে পড়ছে, তখন রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে পূবের আকাশ আবছা আলোর চাদর মেলে ধরছে। আর সেই চাদরের কিনারার বেশ কিছুটা নিচে রহস্যময় কোনো জাদুকরের জাদুর ছোয়াঁয়  দূরে ফুটে উঠছে একটা স্বপ্নের ডাঙা জমি।
     ভোরের আলো ফুটতেই জেলে বস্তির মহিলা-ছেলে-বুড়ো সবাই ঘর ছেড়ে দৌড়ে সমুদ্রের পাড়ে এসে পৌঁছলো। একটা একটা করে নৌকো ফিরে আসছে, সূর্য তখনো পূব আকাশে উঁকি দেয়নি। শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে মানুষগুলো তাদের ভাঙা নৌকো নিয়ে এসে পৌঁছালো সমুদ্রের কিনারায়। তখন ছেলে-বুড়ো এমনকি মহিলারাও পৌঁছে গেছে সেই জলের মধ্যে। হাত ধরে ধরে সবাইকে নৌকা থেকে নামিয়ে ঢেউ ভেঙে তীরে নিয়ে আসছে, যদিও সমুদ্র এখন ভরা দীঘির মতো শান্ত। প্রত্যেকে নিজের নিজের মানুষদের ফিরে পেয়ে সমুদ্রদেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। বাচ্চাগুলো তাদের বাবাদের ভিজে জামা কাপড়েই জড়িয়ে ধরছে। মহিলারা কালকের পূজো করা সেই পবিত্র বালুভূমিতে আভুমি নত হয়ে প্রণাম জানাচ্ছে। একসময় ছেলেমেয়েদের হাত ধরে সমুদ্রমানুষ গুলো বাড়ি ফিরতে শুরু করলো। চেঁচামেচি আর উচ্ছাসের মধ্যে কেউ লক্ষ করলোনা একটা মানুষ আধা জল আধা বালিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার উৎসুক চোখের ঘেরা পরিসীমায় বাড়ির কোনো লোক চোখে পড়ছেনা ৷ শত ক্লান্তির মধ্যেও একটা আতঙ্ক চেপে ধরলো; শ্রান্তি, ভয়, খিদে-তেষ্টা নিয়ে মানুষটি সবার শেষে টলতে টলতে বাড়ির দিকে এগিয়ে চললো।
     সূর্য তখন পূব আকাশের সামিয়ানা বেয়ে বেশ কিছুটা ওপরে উঠেছে;  আলোর ঝিল্লিতে সমগ্র তটভূমিকে রৌপ্য গালায় ধীরে ধীরে মজিয়ে তুলছে , ঠিক সেই সময় জেলে বস্তি থেকে দু-তিন কিলোমিটার দূরে সৈকতে বালির বিছানায় শুয়ে আছে আট বছরের একটি মেয়ে। সমুদ্রজল বারবার এসে নিপুণ দক্ষতায় বালির আল্পনা এঁকে দিচ্ছে মুখে, গলায়, দু-হাত ভরে। কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশটা বালির মধ্যে প্রোথিত। সূর্যের কিরণ বালির আল্পনায় ঠিকরে পড়ে সারা অঙ্গ রজত গহনায় সাজিয়ে তুলেছে। চোখ বুজে পরম শান্তিতে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে শিশুটি; এক হাতে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরা পিতলের রেকাবিটা আর অন্যহাতের বজ্রমুঠোয় কয়েকটা বাসী ফুলের পাপড়ি।

ডঃ গৌতম সরকার। পশ্চিমবঙ্গ