রহস্যের মায়াজাল (নয়) - সুজিত বসাক
পরের দিন সকালে উঠেই যে ঘটনার কথা শুনল রাকিব তার জন্য মোটেই সে প্রস্তুত ছিল না। মনে মনে ভীষণ ব্যথিত হল। মায়াকে কেউ খুন করে রেখে গিয়েছে দীপঝিলের ধারে। কাল রাতে রাকিবের সাথে দেখা করার কথা ছিল মায়ার। রাকিব অনেকটা সময় অপেক্ষা করেছিল ওর জন্য। মায়া যেটা বলতে চেয়েছিল রাকিবকে সেটা বোধহয় কারও পছন্দ হয়নি। তারই মাশুল দিতে হল মেয়েটাকে? হয়তো রাকিবের সামনেই খুন হয়েছে, কারণ রাকিব অনেক রাত পর্যন্ত ওদিকেই তো ছিল, তবুও বুঝতে পারেনি। নিশ্চয়ই সেই অজ্ঞাত মুখোশধারীই মায়ার খুনি। খুন করে পালানোর সময় দেখা হয়ে যায় রাকিবের সাথে।
রাকিবের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল। মায়া খুন হল কেন? গুপ্তধনের সাথে ওর কোন প্রত্যক্ষ যোগ নেই। দীপঝিলের ওপারের মৃত্যুবনের অজ্ঞাত দুজন ব্যক্তি গুপ্তধন চায়। মায়ার সঙ্গে ওদের একটা যোগ আছে বটে, কিন্তু তার জন্য মায়াকে মেরে ফেলার কী কারণ থাকতে পারে ভেবে পেল না। শুধু মাত্র সন্দেহের বশেই মায়াকে মেরে ফেলেনি তো? নাকি এসব দেখাশোনার বাইরে আরও কোন রহস্য আছে? বলার অপেক্ষা রাখে না, রহস্য আরও জাল বিছিয়ে দিচ্ছে। এর শেষ কোথায় কে জানে!
লাশটা ভাল করে পরীক্ষা করল রাকিব। গলায় কালচে দাগ। মনে হল, শক্ত দড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে মায়াকে। ধীরেন্দ্র প্রতাপ ও মায়ার খুনের মধ্যে আপাত কোন মিল না থাকলেও রাকিবের কেন জানি মনে হল দুটোরই চোরা গতি একই সাগরে মিশেছে। আর একটু সমন্বয় দরকার। কোন অপরাধই একেবারে পারফেক্ট হয় না। খুব সামান্য হলেও গড়বড় থাকেই। সেটা ধরা দিয়েও যেন দিচ্ছে না। ঘটনাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটা পাজল তৈরি করে রেখেছে, সেগুলোকে একত্রিত করতে পারলেই একটা অবয়ব পাওয়া সম্ভব। কিন্তু গোছাতে গিয়ে ভেঙে যাচ্ছে বারবার।
আশপাশটা ভাল করে দেখল। আশেপাশের ঘাস ও গাছপালা দেখলেই বোঝা যায় কিছুটা ধস্তাধস্তি অবশ্যই হয়েছিল। কিন্তু রোগা মেয়েটা বোধহয় বেশি প্রতিরোধ করতে পারেনি। রাকিব যেখানে কাল রাতে অপেক্ষা করছিল সেখান থেকে খুনের স্পট খুব বেশি হলে একশো মিটার দূরে। মাঝখানে একটা ঝোপের ব্যারিকেড। অথচ কিছুই জানতে পারল না রাকিব!
হঠাৎ একটা চকচকে জিনিস দেখে থমকে দাঁড়াল রাকিব। একটা ছোট গাছের ফাঁকে অনাদরে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে রোদের আলো লেগে ঝলসে উঠছে। রাকিব সেটা তুলে নিয়ে ভাল করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর মুখে একটা সরু হাসি ফুটে উঠল। মায়ার মৃত্যু বেদনার মাঝেও মনে হল, এবার বোধহয় সত্যি সত্যি একটা সূত্র পাওয়া গেল।
অ্যালান স্মিথের সাথে চলেছে রাকিব। উনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন জানে না। তবুও যাচ্ছে, কারণ রাকিবের মন বলছে ওঁর সঙ্গে গেলে মূল চাবিকাঠি পাওয়া গেলেও যেতে পারে। লোকটার যে কুমতলব থাকতে পারে সেটাও কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে, তাই মনে মনে যথেষ্ট সতর্ক। স্মিথসাহেব দীপঝিলের পশ্চিম ধারের কিছুটা জঙ্গল পেড়িয়ে একটা ভাঙাচোরা ধ্বংসস্তূপের সামনে এসে দাঁড়ালেন। একটা পুরানো থামের দিকে চোখ যেতেই রাকিব চমকে উঠল। ধীরেন্দ্র প্রতাপের ম্যাপের একটা সাংকেতিক চিহ্নের মতো হুবহু একটা চিহ্ন পিলারটির গায়ে খোদাই করা। তার মানে স্মিথসাহেব সঠিক দিশাতেই নিয়ে এসেছে তাকে। মনে মনে ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করলেও আচরণে একদমই প্রকাশ করল না।
স্মিথসাহেব বললেন –“এটাই গুপ্তধনের কাছে যাওয়ার প্রবেশ দ্বার রাকিব। অন্য পথও থাকতে পারে, তবে আমার জানা নেই।”
রাকিব বলল –“ধীরেন্দ্র প্রতাপ গুপ্তধনের কতটা কাছে পৌঁছুতে পেরেছিলেন বলে আপনার মনে হয়?”
-“ঠিক বলা মুস্কিল। তবে বোধহয় লালগোলাপ পর্যন্তই পৌঁছে থাকবে।”
রাকিব অবাক হয়ে বলল –“আপনি লালগোলাপের রহস্য জানেন?”
স্মিথসাহেব হেসে বললেন “দশ বছর ধরে এর পিছনে ছুটছি … আর এটুকু জানব না?”
ধীরেন্দ্র প্রতাপের চিরকুটের প্রসঙ্গ মনে এলেও চেপে গেল রাকিব।
বলল –“লালগোলাপের রহসটা আসলে কী?”
-“অত তাড়া কীসের? ধীরে ধীরে সব দেখতে পাবেন। এবার এদিকে আসুন।”
রাকিব অনুসরণ করল তাঁকে। ওঁর চলার গতি দেখেই বুঝতে পারল এসব অলিগলি ভাল করেই চেনা। কিছুটা যাওয়ার পর একটা অন্ধকার কুঠুরির মতো। টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকে স্মিথসাহেব ডাকলেন –“চলে আসুন ভেতরে।”
ভেতরে ঢুকে ভীষণ অবাক হয়ে গেল রাকিব। একটা সরু সিঁড়ি সোজা নেমে গিয়েছে পাতালের দিকে। সিঁড়িটার চারপাশে জমে থাকা থোকা থোকা জমাট অন্ধকার টর্চের আলোতে খান খান হয়ে গেল। রাকিবের চোখে বিস্ময়ের ঘোর –“এটা কিসের সিঁড়ি … কোথায় গিয়েছে?”
সে কথার জবাব না দিয়ে স্মিথসাহেব বললেন –“এখানে ভয়ঙ্কর গোখরোর বাসা আছে। খুব সাবধান।”
ওরা সতর্কভাবে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। পাশাপাশি চলার উপায় নেই, তাই আগা-পিছু করে চলতে হচ্ছে। কতটা নামল বুঝতে না পারলেও একটা সময় রাকিবের মনে হল, দুতিন তলা তো অবশ্যই নামা হয়ে গিয়েছে। একসময় সমতল পেল।
স্মিথসাহেব বললেন –“দুর্ধর্ষ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন বটে মহম্মদ আবুল হাসান বেগ। তাঁর এই সৃষ্টিকে অত্যাশ্বর্য বললে কম বলা হবে। হি ওয়াজ জিনিয়াস। আপনি ভাবলে অবাক হয়ে যাবেন, ওপরের প্রাসাদের মতোই আরও একটা প্রাসাদ তিনি মাটির তলায় বানিয়েছিলেন। প্রযুক্তির এমন সব নিদর্শন এখানে আছে যা দেখলে আধুনিক প্রযুক্তিবিদরাও ঘাবড়ে যাবেন। কিন্তু কোন কারণে এই পাতাল প্রাসাদ এই রাজ পরিবারের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই এই বংশেরই পঞ্চম মহারাজা বীজেন্দ্র প্রতাপ সিং তার আমলে বন্ধ করে দেন এই পাতাল প্রাসাদের দ্বার। শুধু মাত্র একটা দুটো দরজা খোলা রাখেন যাতে বড় কোন বিপদ এলে তাঁর বংশধরেরা লুকিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে পারে। ধীরে ধীরে এই প্রাসাদ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে, বর্তমান প্রজন্ম ধরতে গেলে এই প্রাসাদ সম্পর্কে কিছুই জানে না।”
রাকিব অবাক হয়ে বলল –“আপনি এতসব জানলেন কি করে?”
-“মানুষের ইচ্ছে আর আগ্রহ থাকলে অনেক কিছুই জানতে পারে। আপনি নিজেকে দিয়েই দেখুন, সামান্য একটা শব্দের সন্ধান করতে গিয়ে কত কিছু জেনে ফেললেন।”
রাকিব হেসে বলল –“তা ঠিক। শব্দের উৎসটা কোথায় … আপনি কিন্তু দেখাবেন বলেছিলেন?”
-“নিশ্চয়ই দেখাব। আরও সামনে যেতে হবে।”
অন্ধকার চিড়ে জোরালো টর্চের আলোয় ফুটে উঠেছে এক মায়াবী রাজ্য। স্মিথসাহেবের কথা ঠিক হলে একসময় এসব জায়গায় হয়তো বহু মানুষের আনাগোনা লেগে থাকত। তাদের কথাবার্তায় গম গম করতো এই পাতালপুরীর অলিগলি। দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে পড়েছিল রাকিব। হঠাৎ স্মিথসাহেব থমকে দাঁড়াতে সম্বিত ফিরে পেল। কী যেন খুব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। তারপর বিড়বিড় করে বললেন –“মনে হল যেন কেউ আসছে।”
-“কে আসছে? কী করে বুঝলেন?”
-“এটা ভাইব্রেট জোন। কান পেতে শুনলে বহু দূরের পায়ের শব্দও শোনা যায়। আস্তে চলুন, বেশি কথা বলার দরকার নেই।”
এবার নিঃশব্দে চলতে লাগল ওরা। একটা ঘরের মাঝখানে এসে স্মিথসাহেব বললেন –“এটা কোন জায়গা বুঝতে পারছেন রাকিব?”
রাকিব দুপাশে মাথা নেড়ে বলল –“একটুও না।”
-“আমরা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক গেস্ট হাউসের নীচে। এখানেই ক’দিন চলেছিল খনন কাজ। তারই শব্দ আপনার কাছে পৌঁছুত। এই দেখুন তার নিদর্শন।”
রাকিব দেখল দেওয়ালের একদিকে বেশ কয়েকটি ক্ষত চিহ্ন। মেঝেতেও কয়েকটি রয়েছে।
-“এসব করল কারা?”
-“গুপ্তধন অনেকেই চায়, তাদের মধ্যে কেউ হবে হয়তো। সম্ভবত ওরা ভেবেছিল এখানেই আছে গুপ্তধন। ভাগ্যিস কিছুটা খোড়ার পড়েই বুঝতে পেরেছিল! নইলে কি হাল হতো সহজেই বুঝতে পারছেন। এক ধরনের মানুষ থাকে, মাথা খাটাতে চায় না, কিন্তু বড় কিছু পাওয়ার আশা করে।”
রাকিব বলল –“একটা কথা আমার মাথায় আসছে না, এসব পথ ওরা জানল কি করে? আমারটা যদি আসল কপি হয় তাহলে তার ডুপ্লিকেট কপি অবশ্যই ওদের কাছে আছে।”
হাসলেন স্মিথসাহেব –“কে বলেছে আপনারটা আসল? ওটাও নিতান্ত একটা কপি মাত্র। তাই তো ধীরু ওটা নিয়ে এলেও কিছু বলিনি। বরং ভেবেছিলাম ওটা নিয়ে ধীরু যদি নতুন কিছু বের করতে পারে সেটাই আমার পক্ষে লাভের হবে। তবে বুদ্ধির দৌড়ে ও এক ধাপও এগোতে পারেনি। এমনকি লালগোলাপ পর্যন্তও পৌঁছুতে পারেনি।”
-“আসল নক্সাটা তবে কোথায়?”
-“আমিও জানি না। সেটার সন্ধান করে যাচ্ছি এখনও। সত্যি কথা বলতে আমিও খুব বেশি যে এগোতে পেরেছি তা কিন্তু নয়। লালগোলাপ পর্যন্ত উদ্ধার করে আটকে আছি। ইঞ্জিনিয়ার বেগ যথেষ্ট বেগ দিয়েছেন আমাকে। আমি কিন্তু গুপ্তধন নয়, অন্যকিছুর সন্ধান করছি, সময় এলে আপনাকে বলব।”
অনেকগুলো অলিগলি পেড়িয়ে ওরা এসে পৌঁছুল একটা খোলামেলা জায়গায়। প্রশস্ত হলঘরের মতো। ঘরটা কী কাজে ব্যবহৃত হত বোঝা মুশকিল। একপাশে একটা সাবেকি স্ট্যাচু। পরির মূর্তি। চারপাশ উঁচু করে বাঁধানো। কোন এক সময় ফোয়ারার ব্যবস্থা ছিল বলেই মনে হয়।
-“খুব সহজে আপনাকে নিয়ে এলেও এই পথের সন্ধান পেতে আমাকে যে কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে আপনি ভাবতে পারবেন না। আমি জানি, এখানে যদি আপনাকে ছেড়ে চলে যাই, তাহলে আপনি কোনদিনই আর উপরে পৌঁছুতে পারবেন না।”
মনে মনে আতঙ্কিত হলেও বুঝতে দিল না রাকিব।
স্ট্যাচুটার হাতের দিকে আলো ফেলে স্মিথসাহেব বললেন –“এই হল সেই লালগোলাপ। আলো পড়লেই ফুটে ওঠে। ইঞ্জিনিয়ার বেগের এক অনবদ্য সৃষ্টি।”
রাকিব অবাক হয়ে দেখল, টকটক করছে গোলাপটি, যেন এইমুহুর্তে ফুটল! কথা বলতে বলতে স্মিথসাহেব বিশেষ কায়দায় গোলাপটিকে ঘুরিয়ে দিলেন। ঘটে গেল এক দারুণ কান্ড! দেওয়ালের একটা অংশ সরে গিয়ে একটা গুপ্ত পথ তৈরি করল। চলবে…
সুজিত বসাক। দিনহাটা, কুচবিহার
-
গল্প//উপন্যাস
-
08-09-2020
-
-