জাতিস্মর ও নিমফুলের গন্ধ - ড. মহীতোষ গায়েন
গতকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার, আজ সকাল থেকেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। বহুদিন পর আজ সজলঘন বিকেলে ছাদে উঠলো মৈনাক, ফ্ল্যাটের ছাদ, আকাশ দেখবে বলে। লকডাউন চলছেই, উপায় নেই সংক্রমণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে, কিছুই ভালো লাগেনা তার ফেসবুক আর আর হোয়াটসএপ -এ বিরক্তি ধরে গেছে। ঘরে শুয়ে বসে আর অনলাইনে মাস মাইনে পাওয়াতেও বিরক্তি। অনলাইনের সাহিত্য গ্রুপে কবিতা পোস্ট করতে করতে ডান হাতে চিনচিনে ব্যথা। আকাশ দেখতে দেখতে তার পাখি হয়ে ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছা করে। পাখিদের কোন দু:খ নেই, ক্লান্তি নেই, রাগ অভিমান নেই, পাঁচতলার উপরে খোলা ছাদে তার নিজকে দুনিয়ার অধীশ্বর ভাবতে শুরু করে।
এইতো সেদিন এই জানুয়ারিতেই এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গবেষণাপত্র পড়তে ঢাকা গিয়েছিল, মনে পড়ে ইতিহাস একাডেমির সম্মেলনে গেলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তবসুমের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, ভারী মিষ্টি মেয়ে। পবিত্র বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল তারা। সেমিনার শেষে ঢাকেশ্বরী কালীমন্দিরে পুজো দিয়েছিল তারা। এবার অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিল সে, আবার তাদের দেখা হবে, সারারাত ধরে একুশের ভাষাশহীদ অনুষ্ঠান দেখবে, বাংলা একাডেমি, নীলকুঠি, জাহাজঘাটা ঘুরবে, ইচ্ছে ছিল, টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে মুজিবের জন্মভিটে দেখবে, মুজিবের জীবন তার কাছে যেন আগুনের পরশমনি, মুক্তির দূত, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের অগ্নিমন্ত্র। মনের দুটো কথা বলবে, অনেক খুজেঁছিল মৈনাক, মেয়েটির সাথে এবার দেখা হলোনা, হঠাৎ করে সতর্কতা জারি, উড়ান বন্ধ হয়ে যাবে, অগত্যা সাত তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফেরা।
জীবনটা মৈনাকের কাছে দুর্বিষহ হতে থাকে,অস্থিরতা গ্রাস করে, তার প্রেমের প্রথম কদমবনে একি শিহরণ! দোলা, আগে তো কখনো এমন মনে হয়নি। সাঝবেলার মাঙ্গলিক শঙ্খবেজে ওঠে, গ্রামের বাড়িতে তুলসী তলায় মায়ের সেই সন্ধ্যারতীর কথা মনে পড়ে। সেবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে অনেক নিমপাতা পেড়েছিল, আটপৌরে শাড়ি পরে জীবন সায়াহ্নে আসা মা খোলা আকাশের নীচে বিকেলের ম্লান আলোয় নিমফুল বাছছিল। নিম বেগুন তার খুব ভালো লাগে। লকডাউন এর ঠিক আগেই তার শয্যাশায়ী মা চিরবিদায় নিয়েছে। খোলা আকাশের ছাদে উঠৈ সে নিমফুলের গন্ধ পায় গোধূলির ঝড়ে উঠছে হাজার হাজার নিমফুল, তির চোখে মুখে এসে পড়েছে নিমফুল সে ছুতে পারছে না।
সিড়ি বেয়ে নেমে আসে সে, মাথা অবশ হয়ে আসে। পরদিন ডাকপিয়নের চিঠি, মুজিব হসপিটালে তবসুমের চিকিৎসা চলছে, ভাইরাসের সংক্রমণ। মৈনাক এর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কনক বলে কি হয়েছে তোমার?
মৈনাক সব কথা খুলে বলে। মাধবী তাকে আশ্বস্ত করে। গায়ে মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, পঙ্কজ ডাক্তার ডাকে কনক, ডাক্তারের কাছে মৈনাক অস্ফুট স্বরে বলে, আমি চারিদিকে নিমফুলের গন্ধ পাচ্ছি কেন? ডাক্তার কনককে বলে, তীব্র মানসিক আঘাত আর লকডাউন জনিত মারাত্মক অবসাদে আক্রান্ত হয়ে ও এক কাল্পনিক জগৎ-এ বিচরণ করছে, যেখানে শুধুই, অবসাদ, অপ্রাপ্তি, সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বিচরণভূমি। সব ঠিক হয়ে যাবে কনক, ভয় পেওনা, ধৈর্য্য, সমবেদনা, আশ্বাস আর ভালোবাসার পরিপূর্ণতা এনে দেওয়ার চেষ্টা করো। কদিন বাদে তারা মন্দিরে পূজো দিতে গিয়ে কনকের কোলে মাথা রেখে বলে, বিশ্বাস করো কনক একটি প্রেম, প্রতারণা, আর বিশ্বাসভঙ্গের গল্পে লিখতে চেয়েছিলাম। গল্পটার নাম দিতে চেয়েছিলাম জাতিস্মর। গল্পটা লেখা শেষ, কিন্ত এটা কোথাও ছাপা হবে না জানো, কনক বলে কেন?
মৈনাক বলে আমি জাতিস্মর হতে চেয়েছিলাম, পারিনি, কোনদিনই হতে পারবোনা, আমি চোখ বন্ধ করলে এখন শুধু দেখতে পাই নিমফুল উড়ে যাচ্ছে, আমার চারদিকে শুধুই কনকচাঁপার গন্ধ অনুভব করি, অনুভব করি ভালোবাসা ও নির্ভেজাল প্রেমের গন্ধ আর একান্ত আপজনের নিভৃত আশ্রয় ও নির্ভরতার গন্ধ।
ড. মহীতোষ গায়েন। কলকাতা
-
গল্প//উপন্যাস
-
01-09-2020
-
-