নাড়ুদার স্বপ্ন - জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
"একটা বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে আনুমানিক কত খরচ পড়বে বলতে পারিস?" নাড়ুদার প্রশ্নে আমি চমকে উঠলাম। আমাদের পাড়ায় নাড়ুদার ওরফে নরেন দাসের একটা বেশ বড়সড় মুদির দোকান আছে। 'সব কিছু পাই দোকান'। মারমার কাটকাট চলে। সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত খদ্দেররা ভিড় জমায়। নাড়ুদা ও ওর কর্মচারীদের নাওয়া খাওয়ার সময় খুব কষ্ট করে বার করতে হয়।
দাদার পড়াশোনা তেমন কিছুই করে ওঠা হয়নি কিন্তু মুখে মুখে সব হিসেব করতে পারে। ওর একমাত্র ছেলে, নান্টু ক্লাস সেভেন পাস, তারপরেই আর কিছু না করতে পেরে শেষমেষ বাবার দোকানে বসে পড়েছে। নাড়ুদার ইচ্ছে ছিল ছেলে অন্তত গ্রাজুয়েট হোক তারপর দোকানে বসুক। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয়?
একমাথা টাক, বেঁটেখাট, মোটাসোটা, শ্যামলা বরণ, নাকে একটা আঁচিল, মুখে সদাপ্রসন্ন হাসি বুদ্ধিমান নাড়ুদা আমাকে খুব ভালোবাসে। নাড়ুদার আমাকে ভীষণ পছন্দ করার কারণ আমি মোটামুটি একটু পড়াশোনা করে কল্যানীর কলেজে শিক্ষকতা করতে ঢুকেছি। ওর ছেলের থেকে আমি সাত বছরের বড় হবার সুবাদে কাকু না বলে দাদাই বলি। মানে নাড়ুদাই আমাকে বলতে বলেছে। আমার রোজকার নাড়ুদার রোজকারের তুলনায় নস্যি, তবে ওর মতে আমার নাকি সম্মান বেশি। পাড়ার শিক্ষিত উঠতি ছেলেপুলে দেখলেই নাড়ুদা ওদের ডেকে ডেকে খোঁজখবর নেয়। কোন কলেজ, কি বিষয় নিয়ে পড়ে, কোন বিশ্ববিদ্যালয় সব জানার চেষ্টা করে। কথোপকথনের পরেই সেই ছেলেপুলেদের হাতে একটা করে ছোট ক্যাডবেরি চকোলেট বিনাপয়সায় তুলেও দেয়। ওরা চলে গেলেই গালে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নাড়ুদার দীর্ঘ্স্বাস পড়ে। ক্ষনিকের জন্য হিসাবের শক্ত দুনিয়া থেকে ওর মন কেমন যেন আত্মগ্লানির আদ্রতায় ভিজে যায়। নিজের আর ছেলের তেমন পড়াশোনা না জানার দুঃখ যেন নাড়ুদাকে কুরে কুরে খায়।
নাড়ুদা ক্যাসে বসে টাকা গোনে আর সময় পেলেই সামনের রাস্তা দিয়ে স্কুলপোশাকে কলকল করতে করতে স্কুলে যাওয়া ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে। দোকানে আরো গোটা তিনেক লোক আছে। আর ওর ছেলেও দোকানেই কর্মচারীর মত সারাদিন হাড়ভাঙা খাটে। নাড়ুদার প্রবল ইচ্ছে একটি শিক্ষিতা, অন্তত গ্রাজুয়েট মেয়ের সাথে যেন ছেলের বিয়ে হয় তাহলে অন্তত ভবিষ্যতের প্রজন্ম স্কুল কলেজের গন্ডি পেরোতে পারে। শিক্ষাপ্রেমিক এহেন নাড়ুদা প্রতি বছর পাড়ার সরকারি স্কুলের বার্ষিক পুরস্কারের পুরো টাকাটাই নিজের পকেট থেকে দেয়। সেই স্কুলের হেডমাস্টার বক্তৃতা দিতে বললে নাড়ুদা বেশ গম্ভীর হয়ে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাটা তুলে ধরে লোকের হাততালি পায়।
ঠিক এমনি এক সময়ে মাসকাবারি বাজার করতে রবিবার নাড়ুদার দোকানে হাজির হতে নাড়ুদা আমার হাতে এক ভাঁড় চা তুলে দিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো।
উত্তরে আমি আবার উল্টে প্রশ্নই করে বসলাম, "কেন দাদা, তুমি কি কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর প্ল্যান করছ নাকি?"
"দেখ, ঈশ্বরের কৃপায়, তোদের সকলের ভালোবাসায় পয়সাকড়ি আমার মন্দ নেই। কিন্তু মনে আমার শান্তি কই। এখন যদি সকলের জন্য একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানাতে পারি তো মরলে আমার আত্মাটা অন্তত শান্তি পাবে।"
আমি নাড়ুদার দুঃখ বুঝি। কিন্তু একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানানোর যে প্রচুর খরচ, পারমিশন, আরো বিভিন্ন হ্যাপা সেগুলো নাড়ুদাকে জানাতে গিয়ে বললাম, " তুমি কি জানো একটা বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে কি ঝামেলা? জমি চাই, পারমিশন চাই, বিল্ডিং চাই, শিক্ষক চাই, ছাত্র ছাত্রী চাই। চালাক চৌখস কয়েকজন লোক লাগবে যারা পুরো ব্যাপারটা দাঁড় করাবে। তোমার তো দিনের ষোলো ঘন্টা দোকানের পিছনেই চলে যায়, তুমি এসবের পিছনে দৌড়বে কিকরে?"
"আচ্ছা কতটা জমি লাগবে বলতো?" আমার মুখের দিকে চেয়ে নাড়ুদা প্রশ্নটা করে।
"তা ধরো কুড়ি তিরিশ একর কমপক্ষে লাগবে। বেশি হলে আর ভালো। চারিদিকে সবুজের সমারোহ আর মাঝখানে কলেজের বিল্ডিং, গাড়ি রাখার জায়গা, বিশাল ক্যান্টিন, সাইকেল আর বাইক স্ট্রান্ড, ছেলেমেয়েদের আলাদা আলাদা হোস্টেল, শিক্ষক ও কর্মচারীদের থাকার জায়গা এগুলো তো কমপক্ষে লাগবেই। ছোট জায়গায় উঁচু বিল্ডিং করতে হবে।"
"তোর সন্ধানে কোনো এরকম বড়ো জায়গার সন্ধান আছে?"
আমি নাড়ুদার সম্পদ কি আছে জানি না। রেস্তো না থাকলে এত বড়ো প্রজেক্টে তো নামা যায় না। উত্তরাধিকার সূত্রে নাড়ুদা কিছু পেয়েছে নাকি কোনো লটারির টিকিট জিতল তাও জানি না। আমি বেশ অবাকই হোলাম। তবে মহৎ উদ্দেশ্য এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই।
"আরে দালাল ধরতে হবে। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। আমি সাধারণ মানুষ। এতটা জমির সন্ধান কিকরে দিতে পারব?" আমি হেসে বলি।
"তুই আমার একটা উপকার কর। কাল বা পরশু কাগজে একটা জমি চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে দে না। শহরের বাইরে একসাথে তিরিশ একর জমি চাই। পাথুরে জমিও চলবে। জমিতে একটা পুকুর থাকলে আরো ভালো। কোনো মামলা মোকদ্দমা চলছে এমন জমি চলবে না।"
"নাড়ুদা আপনার জমির বাজেটটাও লিখতে হবে। পশ্চিম বাংলার বাইরেও চলবে কি? ঝাড়খণ্ড বা বিহার বা উড়িষ্যা?"
"না, বাজেট এখন বললে দালালরা দাম বাড়িয়ে দেবে। ভারতের যে কোনো জায়গায় হলেই হবে।"
"তাহলে বাংলা আর ইংরেজি দুটো কাগজেই বিজ্ঞাপন দিয়ে দি?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
শনিবারের কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোনোর পর সব চুপচাপ। কারুর কোনো ফোন নেই। সাত দিনের পরও কোনো ফোন এলো না। জমির কি তাহলে আকাল পড়লো? আমি আর নাড়ুদা মনের দুঃখে দোকানে সন্ধ্যে বেলায় বসে পোড়া ভুট্টা খাচ্ছি। কয়েকজন খদ্দের জিনিস কিনছে। নাড়ুদার এত বড় একটা মহৎ কার্য করতে গিয়ে প্রথমেই বাধা আসাতে আমাদের মনটা একটু দমে গেছে। নাড়ুদাকে বললাম যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নাকি একটা জমি ব্যাংক আছে। সেখানে খোঁজ করবো বা গুজরাটের শিল্পমন্ত্রীকে একটা ইমেল করবো আমাদের প্লানটা জানিয়ে যদি ওরা জমি দেয়। নাড়ুদা তাতে সায়ও দিলো। কিন্তু মন থেকে কেন না জানি মানতে পারছি না যে নাড়ুদার মতো একজন লোক এতবড় একটা মহাকাজে কেন মেতে উঠলো?
"আচ্ছা নাড়ুদা তুমি কি সত্যি সত্যি এতবড় একটা কাজে নামতে চাও?" আমি ভুট্টা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম।
"অবশ্যই। নাহলে এত টাকা দিয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম কেন? জমিটা একটু সস্তায় পেলে বাকি কাজ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে করবো।" নাড়ুদার কথায় প্রত্যয়ের সুর।
আরো সপ্তাহ খানেক পর এক রবিবারের দিন সকালে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। হ্যালো বলাতে দেখি ওপর প্রান্ত থেকে নাড়ুদা ফিসফিস করে আমাকে তক্ষুনি দোকানে আসতে বলছে। আমিও চোখ রগড়াতে রগড়াতে সকাল সাতটায় দোকানে হাজির হোলাম। নাড়ুদাকে আজ যেন বেশ উত্তেজিত। খোলা দোকানের বাইরেই পায়চারি করতে করতে দুটো হাতের তালু ঘষাঘষি করতে করতে আমাকে দেখেই বললো, "বাঃ, তুই এসে গেছিস। একটু পরেই দোকানে ভিড় হয়ে যাবে তখন আর ভালো করে কথা বলা যাবে না তাই তোকে সকাল সকাল আসতে বললাম। শোন প্রায় জলের দরে অনেকটা জমি পাচ্ছি। ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম। পাথুরে জমি। সে আমি সব ঠিকঠাক করে নেব খন। তুই খালি একজন ভালো আর্কিটেক্ট এর খোঁজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নক্সাটা ভালো করে বানা। কোনো খুঁত যেন না থাকে। চার বছরের প্রজেক্ট। ২০২২ সালেই শুরু করবো। কারোর পারমিশন নিতে হবে না। প্রজেক্টটার হালহকিকত খুব জমিয়ে লেখ। ওটা ব্যাংকে জমা দিয়ে লোনের দরখাস্ত করবো।"
"কতোটা জমি আর কতো দামে কিনছ নাড়ুদা?"
"কুড়ি কুড়ি একর করে দুটো পাশাপাশি প্লট কিনছি। আমেরিকান সাহেবদের ওনেক দিনের পুরোনো দালালির কোম্পানি। খুব নামকরা। জমির দলিল দেবে, রেজিস্ট্রি করিয়ে দেবে। অবশ্য আগে তিন চতুর্থাংশ টাকা ডলারে দিতে হবে। বাকিটা দলিল, রেজিস্ট্রির কাগজ একদম হাতে দিয়ে তবে নেবে।"
"বলো কি? এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। অবশ্য লক্ষী তো তোমার ঘরে বাঁধা। এখন সরস্বতী আরাধনায় তোমার প্রয়াস সফল হতে বাধ্য। তোমার সৌভাগ্য না হলে আর কার হবে।" আমি হাতে চায়ের ভাঁড় নিয়ে নাড়ুদার দিকে চেয়ে বলি।
সামনের এই টাকমাথা, মোটা, বেঁটে লোকটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টর হিসেবে মানসচক্ষে দেখে সম্মানে আমার মাথা ঝুঁকে এলো। মানুষ চাইলে না কি করতে পারে। এই একমাস আগেই দেখেছি নাড়ুদা এই মুদির দোকানে তেল, নুন, জিরে, হলুদের হিসেব মেলাচ্ছিলো আর কয়েক বছরের মধ্যেই দাদা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টর হয়ে যাবে। স্বপ্নের মতো উত্থান। এমন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা পুরুষ যে আমাকে বিশ্বাস করে কিছু কাজের দায়িত্ব দিচ্ছে এতেই আমি কৃতার্থ।
"নাড়ুদা, জমিতে কত পড়বে?"
"প্রায় পাঁচশো ডলার বা ভারতীয় টাকায় চল্লিশ হাজারের কিছু কম।"
আমি প্রায় মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলাম। চা ছলকে আমার জামা প্যান্টে পড়ে গেলো। কোনো রকমে নিজেকে সামলালাম। ঠিক শুনছি তো? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে আবার চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম, "কত বললে?"
"চল্লিশ একর জমির দাম প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা।" নাড়ুদা বেশ জোর দিয়েই বললো।
"কোন কোম্পানি তোমাকে বিক্রি করছে?"
"কি যেন লুনার ল্যান্ড বলে আমেরিকার খুব নামকরা কোম্পানি। ইন্টারনেট ঘাটলেই সব পেয়ে যাবি। কোনো জালিয়াতি নেই। হুঁ হুঁ বাবা। খাঁটি সাহেব কোম্পানি।"
" আর জমিটা কোথায়?"
"কেন? চাঁদে।" নাড়ুদার সপ্রতিভ জবাব।
"আর ২০২২ সালে শুরু করাটা কিভাবে?" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি।
"কেন রে, কিছুই খবর রাখিস না দেখছি। আরে ভারত থেকে চন্দ্রযান তো ওই সালেই চাঁদে মানুষ পাঠাবে। ওদের সাথে বন্দোবস্ত করে চলে যাবো। লুনার ল্যান্ড কোম্পানি আমাকে ইসরো’র সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেবে বলে কথা দিয়েছে।”
নাড়ুদা চাঁদে চল্লিশ একর জমি কিনেছে। আমেরিকা থেকে জমির দলিল, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট যথা সময়ে দাদার হাতে এসে গেছে। আমাকে সেগুলো দেখিয়েছেও। সব অরিজিনাল আর পাকা কাজ। কোথাও কোনো ভুলচুক নেই। লুনার ল্যান্ড কোম্পানি এখন মঙ্গলগ্রহে আর বুধেও জমি অধিগ্রহণ করে সেগুলো বেচার মতো অবস্থায় নিয়ে এসেছে। যাদের চাঁদে জমি আছে তাদের কিছুটা সস্তায় অন্য গ্রহে জমি দিচ্ছে। নাড়ুদার দেখাদেখি ওর চেনাশোনা কয়েকজন চাঁদের জমির মালিক হয়েছেন। জনবসতি হলে জমির দাম নাকি হুহু করে বেড়ে যাবে। নাড়ুদার ভীষণ পীড়াপীড়িতে আমি আর্কিটেক্ট এর কাছে গিয়ে দুদিন তিনঘন্টা করে আলোচনাও করে এসেছি। ঘরগুলির ছাদের উচ্চতা কুড়ি - পঁচিশ ফিট কমকরে করতে বলায় উনি তো আমায় এই মারেন তো সেই মারেন। আমি কিছুতেই ওনাকে বোঝাতে পারিনা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবক যুবতীরা ঘরের ভিতর যদি শরীরচর্চার জন্য স্কিপিং করে পৃথিবীর বুকে তিন ফুট লাফায় তো চাঁদে আঠারো ফিট লাফাবে। সুতরাং ছাদ গুলো একটু বেশি উচুঁই তো করতে হবে। আর্কিটেক্ট আমায় পাগল বলে বিদায় করেছেন।
কিছুদিন হলো নাড়ুদা একটা বেশ শক্তিশালী দূরবীন কিনেছে।
রোজ সন্ধ্যা হলেই চায়ের ভাঁড় হাতে আমরা দুজন দাদার বাড়ির ছাদ থেকে দূরবীন দিয়ে চাঁদের দিকে চেয়ে দেখি। নাড়ুদা নিজস্ব জমিটা খোঁজে আর আমি খুঁজি ছোটবেলার চাঁদের সেই বুড়িটাকে যে এখন নাড়ুদার জমি পাহারা দেয়।
জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। কলকাতা
-
গল্প//উপন্যাস
-
21-08-2020
-
-