সাম্রাজ্য - হাসান গোর্কি
হরিরচরের আলম মিয়াকে চেনে না এমন লোক এ তল্লাটে নেই। এমন কারো বসবাসের অধিকারও নেই এ অঞ্চলে─ অন্তত হরিরচরে। বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী আছে তার। চরমেদীনি, জালালীরচর, চরকাঙালী থেকে ফসল কাটার মৌসুমে যখন দলে দলে লাঠিয়াল এসে জমা হয় আলম মিয়ার বৈঠকখানার সামনে তখন তাকে দেখলে মনে হয় প্রাচীন পৃথিবীর বিশাল কোন জনগোষ্ঠীর গোত্রপতি সে। তিন ছেলে এক মেয়ের জনক আলম মিয়া। মেয়ের নাম রেখেছে বীণা। অনেক আহলাদের মেয়ে। বীণাকে হরিরচরের রাজকন্যা বললে বেশি বলা হবে না। যখন সে গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে যায়, যখন মালিপাড়ার আমবাগানে বসে যমুনার ভাঙন দেখে, তখন তার আধিপত্যের বিস্তারে নিমজ্জিত হয় আশপাশের সবকিছু। এ যেন তারই সাম্রাজ্য, তারই শাসিত কোন জনপদ।
তখন অঘ্রানের মাঝামাঝি। মাঠের পর মাঠ আমন ধানের সোনালি শীষে ভরে গেছে। আলম মিয়ার লাঠিয়াল বাহিনী এবারও হরিরচরের সমস্ত পাকা ধান কেটে নেবে। কাতালচর, জালালীরচর, চরকাঙালী থেকেও কেটে নিয়ে আসবে রাশি রাশি স্বর্ণাভ ধানের ছড়া। বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিদিন একটা করে গরু জবাই হচ্ছে। বিয়ের মজলিশের মত খাওয়া- দাওয়া চলছে প্রত্যেক বেলা। সকালের ঝলমলে আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আদিগন্ত শষ্যের সোনালি মাঠ, মিয়াবাড়ির আটচালা, কলমীবন, সর্দার দীঘি। উত্তর দিক থেকে হঠাৎ গগনবিদারী এক রৈ রৈ শব্দ ভেসে এলো। কাতালচরের নূরু ব্যাপারীর লাঠিয়াল বাহিনী হরিরচর আক্রমণ করেছে। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ল, তারা চরের পুরো উত্তর অংশ জুড়ে ধান কাটতে শুরু করেছে। তীর, বর্শা, বল্লম, লাঠি, শরকি হাতে নিয়ে আলম মিয়ার বাহিনীও ছুটে গেল উত্তরে। আলম মিয়ার হাতে একটা দোনলা বন্দুক। কাঠের বাক্স ভর্তি গুলি নিয়ে তার সাথে বেরিয়ে গেল শেখর, শম্ভু─ দুই সহোদর। সংঘর্ষ শুরু হলো পুরো মাঠ জুড়ে। আলম মিয়া একটা উঁচু টিবির আড়াল থেকে গুলি চালাচ্ছে। সারি সারি রক্তাক্ত লাঠিয়াল দৌড়ে পালাচ্ছে। দু’একজন পাখির মত শুয়ে পড়ছে মাটিতে।
কিন্তু একটু পরেই চিত্রটা অন্যরকম হয়ে গেল। আলম মিয়ার গুলি শেষ। নুরু ব্যাপারীর প্রতি আক্রমণে পিছু হটতে শুরু করল আলম মিয়ার বিপুল পরাক্রমশালী লাঠিয়াল বাহিনী। হঠাৎ বল্লমধারী একটা ক্ষুদ্র বাহিনী আলম মিয়াকে ঘিরে ফেলল। বড় ও মেজো ছেলে কোনরকমে ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এলেও লাঠির আঘাতে দু'জনের দুজনের-ই মাথা ফেটে গেল। আলম মিয়ার স্ত্রী জায়দা বিবি ছোট ছেলের হাত ধরে আমলকি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখছে। বীণাও বরাবর চর দখলের যুদ্ধের একজন দর্শক। এখানে মৃত্যু আছে, উত্তেজনা আছে, বিজয়োল্লাস আছে, ভয়াবহতা আছে। সবার ওপর অস্থির, অজ্ঞাত, ব্যাখ্যাতীত একটা আকর্ষণও আছে অনাকাঙ্খিত এ যুদ্ধের মধ্যে। বীণা এর আগে কখনও এরকম বিপদগ্রস্ত হতে দেখেনি বাবাকে। অস্থির হয়ে সে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। এমন পরাক্রমশালী একজন মানুষকে এরকম অসহায় অবস্থায় মানায় না। বাবার মৃত্যুর চেয়ে তার পরাজয়ের অপমান বেশি কষ্টদায়ক তার জন্যে।
হঠাৎ বল্লম হাতে কোথা থেকে ছুটে এলো সুরুয আলী। প্রায় পাঁচ বছর থেকে সুরুয আলী আলম মিয়ার বাঁধা লাঠিয়াল। দীঘল তলদা বাঁশের মত একহারা শরীর। রোদে পোড়া বাদামী শরীরে পেশীগুলো যেন পাথরখণ্ডের মত লেগে আছে। তার সামনে দাঁড়াতে পারে এমন লাঠিয়াল এ অঞ্চলে নেই। সে বল্লম ছুঁড়লে তা অব্যর্থ নিশানায় ছুটে যায়। ডান হাত বাম হাত করে বনবন শব্দে লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে সে যখন সামনে এগিয়ে চলে তখন লাঠিটাকে চোখে দেখা যায় না। শুধু একটা অস্পষ্ট বাদামী বৃত্তের মত বলয় গড়ে ওঠে তার চারিদিকে। বন্দুকের গুলিও নাকি ঐ বৃত্ত ভেদ করতে পারে না। সুরুয আলী বাঘের মত হুঙ্কার দিয়ে টিবির ওপর উঠে দাঁড়াল। এক ক্রোশ দূর থেকেও শোনা গেল সে গর্জন। একটা বল্লম অব্যর্থ নিশানায় ছুটে গেল তার হাত থেকে। প্রতিপক্ষের একজনের উরুতে গিয়ে বিদ্ধ হলো সেটি। ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নুরু ব্যাপারীর চৌকশ লাঠিয়াল বাহিনীর ছোট দলটি। আলম মিয়া দৌড়ে পিছিয়ে এলো। পিছিয়ে এলো সুরুয আলীও।আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিল। বীণার মনে হলো, সুরুয আলী কেন একটা রাজপুত্র হলোনা ; নিদেনপক্ষে একটা চরের মালিক। কেন সে শুধুই লাঠিয়াল? কেন বাবার সাথে কথা বলার সময় মাথা নিচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে থাকে সে?
বিকেলের মধ্যে হরিরচরের অর্ধেক ধান কেটে নিয়ে গেল নুরু ব্যাপারী। সন্ধ্যায় বৈঠকখানার সামনে সব লাঠিয়ালকে ডাকল আলম মিয়া। বিষ মাখানো বর্শার ফলার আঘাতে মাথার খানিকটা ছড়ে গেছে তার। থেতলানো দূর্বাঘাস লাগিয়ে মাথায় পটি বাঁধা হয়েছে। ধবধবে সাদা লুঙ্গি আর নীল রঙের ফতুয়া পরে আলম মিয়া চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়াল। তার সারা অবয়ব জুড়ে একটা স্থির গাম্ভীর্য। বিগত পঁচিশ বছরে হরিরচর থেকে কেউ ধান কেটে নিয়ে যেতে পারেনি। আলম মিয়ার বাবা জেবান আলীর জীবদ্দশায় অনাক্রম্য ছিল হরিরচর। একবারই পরাজিত হয়েছিল জেবান আলী; তাও সেটা জীবিত থাকতে নয়। হরিরচরের সমস্ত ধান কেটে, বাড়িতে আগুন দিয়ে, লুটতরাজ করে পুরো এলাকা বিরান করে রেখে গিয়েছিল নুরু ব্যাপারীর বাবা দুদু ব্যাপারীর লাঠিয়াল বাহিনী। তার আগে কোঁচা দিয়ে খুঁচিয়ে তারা হত্যা করেছিল জেবান আলীকে। সে কাহিনী আলম মিয়া এখনও ভুলে যায়নি। সারা শরীর উত্তাপে অবশ হয়ে যাচ্ছে তার। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। লাঠিয়াল বাহিনীর দিকে তাকাল সে। নিঃশব্দে স্থির হয়ে বসে আছে তারা।
আলম মিয়া বরাবরের মত তার সাত পুরুষের শৌর্য- বীর্যের কাহিনী বর্নণা করতে গেলনা। লর্ড লিটন বড়লাট হয়ে আসার পর পুরো তালুকের ওপর তার কর্তৃত্ব কতটা অবিসংবাদিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আজ সেটাও আর বলল না। শুধু বললো
─ মিয়ারা, কাইল বিয়ানে ধানগুলা আর নূরু ব্যাপারীর মাথাডা লইয়া আইবা।
সমাবেশ থেকে প্রতিবাদ বা সম্মতিসূচক কোন শব্দ উচ্চারিত হলো না। হিমালয়ের উপত্যকা জুড়ে পড়ে থাকা নিশ্চল পাথরখণ্ডের মত তারা বসে রইল। আলম মিয়া বলল─ অহন যাও।
জালালীরচরে মনুশেখের কাছে খবর দেয়া হয়েছিল─ তাদের আর কখনই আক্রমণ করবে না আলম মিয়ার লাঠিয়াল বাহিনী। শর্ত হলো, কাতালচর আক্রমণে পুরো লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে সহায়তা করতে হবে। ধান সহ যা কিছু লুট করে আনা যাবে পুরষ্কার হিসেবে তার সবটুকুর-ই মালিক হবে মনু শেখ। ইতিবাচক জবাব এসেছে। মনুশেখ রাজী।
ভোর রাতে ‘আল্লাবোল’ চিৎকার শুনে জেগে উঠল বীণা। কৈশোর থেকে সুরুয আলীর কণ্ঠস্বরের সাথে, এ ‘আল্লাবোল’ ধ্বনির সাথে সে পরিচিত। সুরুয আলী বর্শা হাতে দৌড়ে দৌড়ে মিয়াবাড়ির পুরো চত্বর আল্লাবোল ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তুলল। সে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো সহস্র লাঠিয়ালের কণ্ঠে। বীণার মনে হলো, আজ সুরুয আলী মারা যাবে। এরকম কেন মনে হলো তা সে জানে না। বীণা দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেল, সুরুয আলীর গলাকাটা মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে যমুনার শ্লথ গতির জলধারায়। বীণার ইচ্ছে করল, সুরুয আলী আজ যুদ্ধে না যাক। পেটের ব্যথায় অস্থির হয়ে নেতিয়ে পড়ুক। ঘুমিয়ে পড়ুক। ঘুমিয়ে থাক দুপুর অব্দি। কিন্তু এসবের কিছুই ঘটল না। বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে রৈ রৈ শব্দে সবাই চলে গেল উত্তরে কাতালচরের দিকে।
সারা সকাল সহস্র লাঠিয়ালের দূরাগত অস্পষ্ট গর্জনের দিকে কান পেতে রইল বীণা। দুপুরের আগে এক সময় থেমেও গেল সে শব্দ। বীণা মা- র সাথে আমলকি তলায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে কাতালচরের দিকে। কাতালচরে আগুন জ্বলছে। বট গাছের মত কুণ্ডলি পাকিয়ে অপ্রমেয় ধোঁয়ার রাশি উঠে যাচ্ছে আকাশে। বীণার শরীরটা উত্তেজনায় শিহরণে কেঁপে উঠছে বার বার।আড়ুয়াখাল পাড়ি দিয়ে আলম মিয়ার লাঠিয়াল বাহিনী ফিরে আসতে শুরু করল দিনের আলো নিভে যাবার আগেই। তক্তার ওপর একটা মৃতদেহ নিয়ে নৌকা থেকে নামল চার জন লাঠিয়াল। বীণা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ছুটে গেল খাল পাড়ে। দেখল দেহ থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। অকারণে একটা লম্বা চাকু বিদ্ধ করে রাখা হয়েছে পেটের মধ্যে। নূরু ব্যাপারীর লাশ। মাথা বাদ দিয়েও শরীরটা ছ’ফুটের কাছাকাছি। বীণার চোখ লোনা জলে ভরে উঠল। হয়তো স্বস্তির প্রাবল্যে, হয়তো বিজয়ের আনন্দে।
রাতে সামিয়ানা টানিয়ে, বড় হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে, তিনটা গরু জবাই করে মজলিশ দেয়া হলো। বীণা একটা জামপাতা রঙের শাড়ী পরেছে। শহর থেকে বাবার আনা কাগজের একটা বড় গোলাপ গুঁজেছে মাথায়। একেবারে অকৃত্রিম তাজা গোলাপের মত দেখাচ্ছে সেটি। অকারণ অন্দর মহল- বাহির মহল ছুটোছুটি করছে সে। সুরুয আলীকে দেখছে না সে কোথাও। বৈঠকখানার পেছন দিয়ে যাবার সময় বীণা দেখল, সুরুয আলী গোলাঘরের চৌকাঠের ওপর বসে আছে। বীণা বলল─ সুরুয ভাই, এই আঁন্ধারে কি করেন?
সুরুযের সাথে বীণার কথা হয় খুব কম। তাদের সম্পর্ক অনেকটা প্রভু- ভৃত্যের মত। সুরুয বিস্মিত হলো। বীণার প্রশ্নের কী উত্তর দেবে সে ভেবে পাচ্ছিল না। বীণা আবার বলল─ দীঘির পাড়ে যাইবেন?
সুরুযের মনে বোশেখের ঝড়ো রাত্রির বিদ্যুল্লতার মত একটা চমক খেলে গেল। বলল─ ক্যান যামু না! চল।
সুরুয আলী আর বীণা সরদার দীঘির পাড়ে এলো। বীণার শরীর থেকে আতরের গন্ধ বের হচ্ছে। চাঁদের আলোয় হেঁটে হেঁটে সরদার দীঘির শাণ বাঁধানো ঘাটে পৌঁছুল ওরা। খোঁপা থেকে কাগজের ফুলটা খুলে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল বীণা। তারপর সুরুযের হাতে দিয়ে বলল─ কেমন ফুলডা?
সুরুয কিছু বলার আগেই বীণা বলল─ খোঁপায় লাগায়া দ্যান।
কাঁপা কাঁপা হাতে বীণার খোঁপায় ফুলটা গুঁজে দিল সুরুয আলী।
সুরুয আলীর দিকে ফিরে বীণা বলল─ সুরুয ভাই, আজ আমারে কেমন লাগতাছে তা তো কইলেন না?
সুরুয ভাবছে, সে তো স্বপ্নের রাজকন্যা। সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে তার থাকবার কথা। রাজপুত্রের বেশে পঙ্খিরাজে করে তার কাছে গেলে তবেই কেবল এরকম একটা প্রশ্ন বীণা তাকে করতে পারে। আগেও কখনও হয়তো সুরুয আলী আড়ুয়াখালের পাশে বসে কোন নির্জন রোদেলা দুপুরে একা একা এরকম স্বপ্নের জাল বুনে থাকবে। সুরুয আলী আলতো করে বীণার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল।
সাত পুরুষ ধরে বীণাদের বংশ শাসন করছে হরিরচর। এই বিশাল ভূখণ্ডে একচ্ছত্র আধিপত্য তাদের। কোন অংশীদারিত্ব নেই। কোন ভাগাভাগি নেই। তাদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালে সে মাথা কেটে ফেলা হয়। চোখ তুলে তাকালে সে চোখ উপড়ে ফেলা হয়। শরীরে নীল রক্তের অহমিকা বীণা অনুভব করে অহর্নিশ। পনের বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা মিয়াবাড়ির অহং কি এভাবে বিসর্জন দেবে বীণা! সে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। সুরুয আলী আতরের গন্ধ পাচ্ছে। বীণার মুখটা পরীদের মত। সবচেয়ে সুন্দর পরীটা হয়তো বীণার মত দেখতে। সুরুয আলী সবসময় এরকম-ই ভাবে। সুরুয বলল─ তুমি দ্যাখতে পরীর মতন।
বীণা কোন কথা বলল না। স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তার শরীর থেকে আতরের গন্ধ বের হচ্ছে। সুরুয দেখল, বীণাকে পরীদের রানীর মত দেখাচ্ছে। ধবল জ্যোৎস্নায় উড়ে উড়ে একখণ্ড কালো মেঘ ওদের মাথায় ওপর এলো। মেঘখণ্ডের চারপাশে ফুটে উঠল একটা সোনালি আলোর রেখা। সুরুয আলী বীণার চিবুকে হাত রাখল। বীণা এবারও কোন কথা বলল না। শুধু ডান হাতের সর্বশক্তি দিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিল সুরুযের গালে। তারপর ত্রস্তপদে হেঁটে চলে গেল মিয়াবাড়ির দিকে।
সুরুয আলী পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হেঁটে হেঁটে আড়ুয়াখালের পাড়ে গেল। একটা নৌকায় উঠে বসল। মিয়াবাড়ির নৌকা। দাঁড় হাতে নিয়ে নৌকা বাইতে শুরু করল সে। পিতৃমাতৃপরিচয়হীন সুরুয আলীর পুরো শৈশব কৈশোর কেটেছে কাতালচরে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা; সেখানেই তার লাঠিয়াল জীবনের সূত্রপাত। কিন্তু সেখানে তার আর ফিরে যাওয়া নিরাপদ নয়। তার জন্যে এখন চরম বৈরী কাতালচরের আলো- হাওয়া। সুরুয আলী নতুন কোথাও ভাগ্যাণ্বেষণে যাচ্ছে। আড়ুয়াখাল যেখানে যমুনায় মিশেছে সেখানে গিয়েই নৌকার গলুই ঘুরে গেল চর মেদিনীর দিকে। ইয়াদ আলী নতুন জোতদার। কিন্তু মনটা অনেক বড়। বাধা লাঠিয়ালদের সারা বছরের ভরণ- পোষণ দেয়; নির্দিষ্ট পরিমান জমিতে চাষ করে আবাদ ফসলও ঘরে নেয়া যায়। সুরুয আলীকে এ বছরও লোক মারফত খবর পাঠিয়েছিল ইয়াদ আলী। লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু সুরুয আলী যার নুন খেয়ে বড় হয়েছে তার সাথে বেঈমানী করেনি।
মাঝরাতে বীণা সরদার দীঘির ঘাটে এসে দাঁড়াল। কোথাও কেউ নেই। হেঁটে হেঁটে আড়ুয়াখালের পাড়ে গেল সে। একা। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুই ধবধবে জ্যোৎস্নার অপার নিঃসঙ্গতা। দীঘির পাড়ে ফিরে এলো বীণা। জলে নেমে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল; দেখল সত্যিই জল পরীদের সম্রাজ্ঞীর মত দেখাচ্ছে তাকে।
ভিক্টোরিয়া, কানাডা
hassangorkii@yahoo.com
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন
গল্পঃ দ্ব্যর্থক - হাসান গোর্কি
-
গল্প//উপন্যাস
-
11-08-2017
-
-