অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
স্নেহলতা রিসর্ট - রত্না দত্ত

     প্রিয়তোষ আজ প্রায় তাড়াতাড়িই অফিস থেকে বেরোল ফ্লাইটের টিকিট বুক করার জন্য। প্রতিদিনই অনলাইনের নেটওয়ার্কের ঝামেলায় আর টিকিট কাটা হয়ে উঠছে না, তাই আজ একটু আগে করে বেরোল, আজ সে টিকিট কেটে তবেই বাড়ী ঢুকবে। আগামী রবিবার ওকে যেভাবেই হোক দার্জিলিং পৌঁছতেই হবে। চা-বাগানে কিসব ঝামেলা লেগেছে। যাইহোক বাবার শখের ব্যবসার মধ্যে অনেক কিছুই ছিল যেগুলো আজ দেখাশোনার অভাবে লুপ্তপ্রায় বললেই চলে, কিন্তু এই চায়ের ব্যবসাটা কেন জানি না প্রিয়তোষকে বেশ আকর্ষণ করে। মাঝে মাঝে যখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের চেয়ার এ বসে কাজের চাপে দম ফেলার সময়টুকু সে পায়না, তখন তার মনে হয় যে, এই ব্যবসাটা আর হয়ত টিকিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। ওটা একরকম বিক্রিই করে দিতে হবে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে, কিন্তু লাভের টাকা যখন হাতে এসে ওঠে আর ছেলে - বৌ এর মুখের হাসি বেশ অনায়াসেই বজায় রাখা সম্ভব হয় তখন মনে হয় যে, থাকনা বেশ ভালই তো চলছে; আর অভয়ের মতো সুপারভাইজার ও ম্যানেজার থাকতে চিন্তা কি? অভয় অনেক পুরোনো কর্মচারী, বাবার সময় থেকেই আছে। অভয়ের বাবা তখন সামলে এসেছে আর আজ অভয় বংশপরম্পরায় ওরাই এই ব্যবসার কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই প্রিয়তোষ এর থেকেও অভয়ের  হ্যাপিভ্যালি চা বাগানটা-এর ওপর যেন কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে। প্রিয়তোষ এর বাবার নিজের হাতে তৈরি করা এই 'হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট' অনেক প্রাচীনতম চা-বাগান হলেও নিজের সন্মান সে আজও বজায় রেখেছে, একটুও তাতে চোট আসতে দেয়নি।
     যাইহোক ক-দিনের জন্য ছেলের গরমের ছুটিতে কলকাতার এই প্যাঁচ প্যাঁচে ঘাম গড়িয়ে পড়া গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে আর সঙ্গে একটু ফ্যামিলি ট্যুর হতে পারে এই মনে করে একটু চেঞ্জ এর জন্য সে এই প্রোগ্রামটাকে শ্রেয় বলে মনে করে।
     তাই মোটামুটি গতে বাঁধা ছকে টিকিট কেটে  বাড়ি এসে একরকম প্যাকিং কমপ্লিট করার মানসিকতা নিয়েই চুমকি ও বিতানকে তাদের সব জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নেওয়ার সব পরিকল্পনা মিটিয়ে নিল। প্রিয়তোষ মোটামুটি আর পাঁচজনের থেকে একটু আলাদা। নিজের প্যাকিংটা সে নিজেই করে নিতে পারে। তার জন্য চুমকিকে দরকার হয়নি কোনোদিনই। যাইহোক রবিবার যথা সময়ে তাদের ফ্লাইট মোটামুটি রাইটটাইম এ থাকার জন্য সকালসকালই তারা পৌঁছে গেলো শিলিগুড়ি। লেবং কার্ট রোড ধরে খানিক এগোলেই একটা সরু পাহাড়ি রাস্তা, টি. পি. ব্যানার্জী রোড, সেই সাপের মত আঁকা বাঁকা রাস্তা বেয়ে খাড়া নামলেই ঐ দিগন্ত বিস্তৃত চা-বাগান। যাইহোক গাড়ি এসে থামে ওদের নিজেদের সবথেকে পুরোনো  রিসর্টে, পুরোনো হলেও এখনও সে তার অমূল্য সবেকিয়ানা বেশ বজায় রেখেছে। এই রিসর্টটা প্রিয়তোষ এর মায়ের খুব পছন্দ ছিল। বাবা বেঁচে থাকতে বাবা যখনই কাজের সূত্রে এখানে আসতেন, মা ও সঙ্গে  এখানে আসত  আর প্রায় একমাস এখানে থাকত। প্রিয়তোষ বরাবরই একটু মা ন্যাওটা ছিল। ছোটবেলা থেকে মায়ের আঁচলের তলায় আদরের দুলালের মতো মানুষ হয়। মা ছাড়া সে কিছুই ভাবতে পারতো না, তাই স্বভাবতই মায়ের নামে এই 'স্নেহলতা' রিসর্টের নামটা একরকম প্রিয়তোষ এরই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ছিল। সে-ই এই নামকরণের ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিল। আর এই রিসর্টের সমস্ত আসবাবপত্র কাঠের তৈরী বড় সিঁড়ি, দালান, গাড়ি বারান্দা সবটাই তৈরি হয়েছিল মায়ের সাধ মতো, তাই এটা ছিল বাবার কাছে মায়ের স্মৃতি স্বরূপ। পাহাড়ের কোলে এই রিসর্টটি দেখতেও খুব  সুন্দর। মা বলত এখানে এলে মায়ের নাকি বাতের ব্যথার সব জ্বালা, যন্ত্রণা সেরে যেত, মায়ের চোখে মুখেও যেন এক পরম তৃপ্তির ছবি ফুটে উঠত। মা ফিরে যেতেই চাইত না কলকাতায়।
     আজ এখানে এসে প্রিয়তোষ এর অনেক পুরোনো কথা মনকে নাড়া দিয়ে উঠছে। সেদিনও মা এসেছিল বাবার স্টেটের কিছু মিটিং এর ব্যাপারে প্রায় চল্লিশ দিনের জন্য, বাবাও গেছিল শিলিগুড়িতে, বিভিন্ন জায়গার চা-বাগান মালিকদের সঙ্গে মিটিং এ ব্যাস্ত ছিলেন। হঠাৎই মায়ের বুকে ব্যাথা ওঠে। অভয় তখন ছোটো ছিল, অভয়ের বাবা ব্যানার্জি কাকু যা করেছিলেন তার তুলনা হয় না। তিনি বহু চেষ্টা করেও বাবাকে ফোন এ পাননি তাই তিনি বাধ্য হয়েই মাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করাতে বাধ্য হন। কিন্তু মায়ের অবস্থা এতটাই সংকটজনক ছিল যে মা-কে আই.সি.ইউ-তে ভর্তি করাতে হয়েছিল এবং আস্তে আস্তে মায়ের সেরিব্রাল অ্যাটাক ও হয়ে যায় এবং মায়ের শরীরের সমস্ত অর্গান গুলো আস্তে আস্তে জবাব দিতে শুরু করে, বাবারও সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই মা সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এসব কথাই প্রিয়তোষ এর মনকে বারবার নাড়া দিচ্ছিল কারণ এই 'স্নেহলতা' রিসর্টটা ঘিরে রয়েছে শুধু মায়েরই স্মৃতি। সারা রিসর্টটা জুড়ে কত মরসুমি ফল ফুলের গাছ, দেবদারু, ইউ ক্যালিপটাস ও কত বাহারি গাছের সমাহার। বনমালীদা ভালো মেইনটেইন ও করে রেখেছে সুন্দরভাবে। সবই মায়ের নিজের হাতে লাগানো এবং মা-ই বনমালিদাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিল যে কিভাবে এদের যত্ন করবে।
     যাইহোক ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হওয়ার পর যথারীতি  চুমকি ও বিতান  সবাই একসঙ্গেই লাঞ্চ সারার কথা এমনটাই প্ল্যানের তালিকায় ছিল তাই যথারীতি বাবুর্চি অর্থাৎ সেনদা ডাইনিং টেবিলে খাবারদাবার সাজিয়ে আনল  কিন্তু নাহ্ জমল না, ডাইনিং টেবিল এর আড্ডা। কি যেন একটা অস্বস্তি ঘর জুড়ে বিরাজ করছে। পুরোনো আমলের ঐ ঝাড়বাতির  চড়া আলো আজ যেন বড্ড মেকি, দুপাশের ঘরগুলোর দরজায় নিষেধের বড় বড় ভারী ভারী পর্দা যেন প্রিয়তোষকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। শেষপর্যন্ত লাঞ্চ সেরে যে জার মতো ঘরে চলে যায়।
     যাইহোক বিতানকে নিয়ে একটু কাছাকাছি জঙ্গল ঘুরতে নিয়ে  যাওয়ার কথা, কিন্তু যে কাজের জন্য প্রিয়তোষ এর আসা সেই কাজেই প্রিয়তোষকে চলে যেতে হয়। তাই অভয় এর ওপরেই দায়িত্ব বর্তায় চুমকি ও বিতানকে নিয়ে জঙ্গল ঘোরাতে নিয়ে যাওয়ার। রিসর্ট এর কাছাকাছি একটা খুব সুন্দর গেস্ট হাউস আছে ওদের, সেখানে মায়ের একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছিল বাবা। বিকেলে কাজ সেরে ফিরে ঐ গেস্টহাউস এর দিকে প্রিয়তোষ এর নজর কাড়ল। রিসর্ট এর পাস দিয়ে যে ছোট্ট নদীটা বয়ে যাচ্ছে, সেই নদীর দিকে যেতে ডান হাতি রাস্তা। বড় বড় গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে হাঁটা পথ। দুপাশে অনেকতো জমি সমেত পাঁচিল ঘেরা সাহেবি আমলের বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। ঝোপঝাড় আগাছা গজিয়ে গেছে এক -একটা বাড়িতে, সুন্দর রঙিন ফুলে ভরা  বাগানও আছে কোনো কোনো বাড়িতে, সব বাঙালি বাবুদেরই বাড়ি, তখনকার দিনে হাওয়া বদল করতে  আসত। হঠাৎই ঝিম ধরা বিকেলের নির্জনতা চিরে কানে ভেসে এলো,
   'বহে নিরন্তর আনন্দ ধারা',
     রবি ঠাকুরের গান। আমার মায়ের ভীষণ পছন্দের একখানি গান। এগোতে এগোতে কৌতুহলী হয়ে কখন পায়ে পায়ে ভিতরে চলে এসেছে প্রিয়তোষ খেয়াল নেই। ঘরটায় ঢুকতেই ঠিক মুখোমুখি দেওয়ালে ফ্রেমবন্দি 'মা', আর রেকর্ড প্লেয়ারে হালকা মৃদুস্বরে বাজছে ঐ গান। ঘরে ঢুকতেই প্রিয়তোষ এর কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগলো। চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা গেস্টহাউসের পরিবেশটাকে যেন গ্রাস করেছে। পূর্ণিমার আলোতে গেস্টহাউসের  মাঝে  যে বড় কৃষ্ণ চূড়ার গাছ সেটার বাঁধানো বেদিতে বসে প্রিয়তোষ যেন আজ তার মনে ভিড় করে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। আনমনে থাকতে থাকতে কখন যে প্রিয়তোষ এর দুচোখের পাতা এক হয়ে যায়, হাল্কা হাল্কা ঠান্ডা বাতাস ও যেন গায়ে শিহরণ জাগাচ্ছে। হঠাৎই প্রিয়তোষ এর মনে হল, কে যেন তার মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, এক মমতাভরা হাতের স্পর্শ। গায়ে ও যেন কে হালকা চাদরের আস্তরণ দিয়ে দিয়েছে, সে চেষ্টা করলেও যেন চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না। এক অজানা ঘোরের মধ্যে সে শুধু অনুভব করতে পারছে তাঁর অস্তিত্ব,তাঁর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, সবকিছুই। হঠাৎ চৌকিদারের বাঁশির আওয়াজে তার চেতনা জাগে, সে বুঝতে পারে যে সত্যিই তার গায়ে সেই মায়ের নিজের হাতের কাঁথা কাজ করা লাল রঙের চাদরটি কে যেন জড়িয়ে দিয়েছে। সে ডাকবার চেষ্টা করে 'মা', 'মা' বলে, তবে কি আজ মা এসেছিল, তার শিয়রে সে মায়েরই অস্তিত্ব অনুভব করছিল এতক্ষণ। চৌকিদারকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে, 'না তো বাবু, এখানে তো আপনি ছাড়া আর কেউই নেই'! 
     - তবে? তবে, কে ছিল? আর, এই চাদরটাই বা কথা থেকে এলো? হয়তো আমারই ভুল!
    এইভেবে প্রিয়তোষ রাত হয়ে গেল দেখে উঠে পড়ল, মৃদু জ্যোৎস্না ভেজা পথ, চাঁদ তার মায়াবী আলো ছড়ালেও আকাশে তারারা কিন্তু অন্যদিনের মতো আজ ও স্থির, প্রত্যয়ী। ধীরগতিতে পায়ে পায়ে সে যখন রিসর্ট এ পৌঁছল তখন অনেক রাত হয়ে গেছে, চুমকি ও বিতান শুয়ে পড়েছে।
     পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রিয়তোষ আগের দিনের সমস্ত ঘটনা চুমকি ও বিতানকে বলতে বলতেই হঠাৎই চোখ পড়ে হলঘরের ডানদিকের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা ফ্রেমবন্দি করা মায়ের বিশাল ছবিটার দিকে, দেখেই সে চমকে ওঠে আর সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে বেডরুম থেকে ওই কাঁথা কাজ করা লালরঙের চাদরটা নিয়ে আসে, একদম এক, হুবহু,কোনো অমিল নেই, এইটাই তো সেই চাদর যেটা কাল আমার গায়ে কে যেন জড়িয়ে দিয়েছিল?
     - তবে কি মা? মা এসেছিল?বলতে বলতে হাউ হাউ করে প্রিয়তোষ কেঁদে ফেলে, মায়ের ফটো জড়িয়ে ধরে আর বলতে থাকে- 'মা', তুমি যদি এলেই তবে চলে গেলে কেন 'মা'? আমার যে তোমাকে খুব দরকার 'মা', ফিরে এসো, ফিরে এসো;
     রিসর্টে উপস্থিত সবাই অবাক দৃষ্টিতে প্রিয়তোষ এর দিকে তাকিয়ে থাকে এক অজানা রহস্যের সন্ধানে, কেউই বুঝে উঠতে পারেনা আসল ঘটনাটা কি? প্রিয়তোষ ও কাউকে বলারও প্রয়োজন মনে করেনি, কিন্তু সেদিনের ঘটনা সবাইকার মনে একটা রহস্যের শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল যা সবার কাছে অধরাই থেকে যায়।

রত্না দত্ত। হুগলী