অকূল দরিয়া - বিমলচন্দ্র গড়াই
পশ্চিম দিগন্তে তখন অস্তমিত সূর্যের সোনালী ছটা ছড়িয়ে পড়েছে সবুজ গাছে গাছে। নদীর জলের ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় সোনালী গোলাকার সূর্যের প্রতিবিম্ব যেন নেচে নেচে ওঠে! পাখির দল সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলে আপন কুলায়ে। অনবরত পাখার ওঠানামা ছন্দে ঘরে ফেরার আনন্দ যেন বাতাসের কানে কানে বলে যাই আজ আসি বন্ধু! আবার প্রভাত কিরণের রঙ মেখে ফিরে আসব তোমাদেরই কাছে, বাতাসের বুক চিড়ে এগিয়ে যাব আরও একটি দিনের জন্য।
কী অপরূপ তোমার রূপ! তোমার অকৃপণ দানে আমরা গর্বিত। তোমার রূপ- রস-গন্ধে আমরা সম্মোহিত! তোমারই কোলে বসে তোমারই দেওয়া বাতাস নিতে নিতে বেঁচে থাকার রসদ গ্রহণ করি। আর এজন্যই তো তোমাকে আল্লা, ভগবান, গড বলে মনের গভীর থেকে আহ্বান করি।স্মরণ করি।
ওই দ্যাখো নদী, তোমারই বুকে পানসি ভাসিয়ে দুঃখ যন্ত্রণায় কাতর কোন এক মাঝি গেয়ে যায়----
আমায় ভাসাইলি রে,আমায় ডুবাইলি রে
অকূল দরিয়ায় বুঝি কুল নাই রে --!
রোকেয়ার দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসে। মাঝি বুঝি তার মনের কথা জানতে পেরেছে! তাইতো প্রাণখুলে সে গায়ছে, বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছে রোকেয়ার যন্ত্রণাদগ্ধ প্রাণের আকূল আবেগ! রোকেয়া মাঝির কণ্ঠের সুরে গলা মিলিয়ে গেয়ে ওঠে----
"কূল নাই সীমা নাই অথৈ দরিয়ার পানি
দিবসে নিশিথে ডাকে দিয়া হাতছানি রে
অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাই রে!”
একসময় রোকেয়ার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে! অশ্রুসিক্ত চোখদুটো বুজে আসে! আর তখনই মনে হয় কে যেন পিছন থেকে নাম ধরে ডাকছে---
"রোকেয়া?"
"কে?"
"আমি এসেছি রোকেয়া! তোমার প্রাণের প্রিয়,বড় আপনজন। যাকে তুমি একমূহুর্ত না দেখলে স্হির থাকতে পারতে না! যার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমার আয়তাকার দুটি চোখে আনন্দ আর ভাললাগার উচ্ছ্বাস নেমে আসত! যাকে বুকের মধ্যে নিয়ে তুমি নিশ্চন্তে ঘুমিয়ে পড়তে, দুটি নিষ্পাপ জীবনের ভালোবাসা যেখানে নীরবে প্রবাহিত হতো, আমি সেই হীরামন!”
"হীরামন তুমি এসেছ? আমি কতকাল ধরে তোমারই জন্য এ নদীর তীরে অপেক্ষা করছি।"
"আমি জানি রোকেয়া। তুমি যে আমাকে বড্ড ভালবাস! তোমার কান্না আমি শুনতে পাই অনেক অনেক দূর থেকেও! তোমার নিশ্বাস প্রশ্বাসে আমার উপস্থিতি টের পাই মানব সমাজের বাইরে থেকেও! প্রতিক্ষণে আমার মন ছটফট করে তোমাকে দেখব বলে।"
"তবে কেন দূরে থাকো হীরামন? সেই কবে দুহাত দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে আমাকে সোহাগ করেছিলে!"
"ঠিক তাই রোকেয়া। ক্ষেতে কাজ করে যখন বাড়ি ফিরতাম, তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে মাটির দাওয়ায়। চোখ দুটোতে থাকতো হাসির ঝলক। ঠোঁটে লেগে থাকতো এক অনাবিল না বলা সোহাগ! আমি অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখতাম। তুমি বড় লজ্জা পেতে! আমি কাছে টেনে নিতে চাইলে তুমি ছুটে পালিয়ে যেতে ঘরে।"
'সে তো আজ ভুলতে বসেছি হীরামন। পর পর দুবছর অনাবৃষ্টিতে ফসল গেল জ্বলে! দেশে খাবারের আকাল নেমে এলো। আমার পানে তাকিয়ে তুমি স্হির থাকতে পারতে না! আমার পেটে তখন আমাদেরই আনন্দের ফসল তিল তিল করে বড় হচ্ছে। তোমার চিন্তায় ঘুম হতো না, কিভাবে তোমার বড় আপনার দুটি জীবন কে রক্ষা করবে!' একদিন কাজের খোঁজে বেরিয়ে সাঁঝের বেলা ফিরে এলে। আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললে, 'রোকেয়া, আমি সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছি, জেলে পাড়ার মানুষদের সাথে। তোমার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম! তা কি করে সম্ভব! এ অবস্হায় আমার পাশে থাকা তোমার খুব দরকার। আমি তোমাকে যেতে দিতে পারি না।' তুমি আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বললে, 'যে আসছে তার তো যত্ন নিতে হবে। আর তাকে ভাল রাখতে গেলে তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে। এজন্য টাকার দরকার। প্রকৃতির রোষে ক্ষেতের ফসল নষ্ট। তাই তো জেলে পাড়ায় গিয়েছিলাম একটা কাজের খোঁজে। ওদের সাথে যাবার কথা দিয়েছি। ওরা আমাকে কিছু টাকা অগ্রিমও দিয়েছে।'
'হ্যাঁ রোকেয়া। সে টাকা দিয়ে তোমার জন্য বেশ কিছু দিনের খাবার কিনে দিলাম। হাতে কিছু নগদ ও রাখলে। তুমি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বিদায় দিলে! তোমাকে ছেড়ে আমার মনটা যেতে চাইছিল না। কিন্তু আগত সন্তানের কথা ভেবে বিদায় নিলাম।তোমাকে কথা দিলাম ---'
'তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে।'
'হ্যাঁ রোকেয়া। সে কথা আমার মনে ছিল। সাগরের পানিতে জাল টানতে টানতে আল্লাকে বার বার ডাকতাম, আমার প্রাণের মানুষটাকে যেন ভাল রাখে। রাতে যখন সাগরের বুকে নাও চালাতে চালাতে চাঁদের কিরণ দেখতাম, অমনি তোমার কথা মনে পড়ে যেত। তোমার মুখটা আমার মনের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের মতোই ভেসে উঠতো। আমার প্রাণটা তোমার আদর সোহাগ পাওয়ার জন্য ছটফট করতো। মনে হতো সবকিছু ফেলে, সাগরের অগাধ জলরাশিকে উপেক্ষা করে ছুটে আসি তোমার কাছে।'
'সত্যি বলছো হীরামন?'
' সত্যি রোকেয়া! নাও-এর মালিককে বলতাম আমার মনের কথা। বলতাম, আমাদের ভালবাসার কথা। সে বলতো,আর তো কটা দিন। এখন প্রচুর মাছ উঠছে। এখন তো যাওয়া যাবে না। এ মাসের শেষে যখন মাছ আর নদীর মোহনার দিকে ছুটে আসবে না, তখন কিছু দিনের জন্য ছুটি। বাড়ীর দিকে সবাই রওনা দেব। আমিও দিন গুনতে লাগলাম সে দিনটার জন্যে। সেদিন কবে আসবে! একদিন ভোরে গভীর সমুদ্রে গেলাম মাছ ধরতে। হঠাৎ সমুদ্রের জল গর্জে উঠলো! প্রবল গতিতে একটা ঝড় আছড়ে পড়ল! আমরা সবাই নৌকা সামাল দিতে ব্যস্ত। কিন্ত প্রকৃতির শক্তির কছে আমরা যে তুচ্ছ। নৌকা গেল উল্টে, তলিয়ে গেলাম সমুদ্রের অতল গহ্বরে! হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তেই খোদা তালাকে ডাকলাম। ধীরে ধীরে আমার দেহটা একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল।'
'তারপর?'
'তারপর আর কিছু মনে নেই রোকেয়া। শুধু মনে হচ্ছে আমি এখন আর তোমাদের নই, তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে পড়েছি! অনেক অনেক দূরে চলে এসেছি।'
'না হীরামন! এমন কথা বলো না, তুমি এভাবে আলাদা থাকতে পার না। আমি যে তোমার জন্যে প্রতিদিন এ নদীর তীরে বসে থাকি। সাগর থেকে ফিরে আসা কোন নৌকা দেখলেই জিঙ্গেস করি। আমার যে অনেক কথা বলার আছে। আমার পেটের ভিতর তিল তিল করে বেড়ে ওঠা প্রাণটা এখন পৃথিবীর আলোয় হাত পা ছুঁড়ছে! খেলতে খেলতে খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে যে তোমার আদর নেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।'
'আর তাকে আদর করা হলো না রোকেয়া! তুমি তাকে বলো তার আব্বাজান সাগরের বুকে সাঁতার কাটছে ! সমুদ্রের তরঙ্গের মাথায় চেপে কখনো ডুবছে আবার কখনো ভাসছে। সেখান থেকে ফেরার কোন পথ নেই।'
'অমন কথা বলো না হীরামন! তুমি পিতা! যে সৃষ্টির বীজ তুমি আমার দেহে রোপণ করেছিলে তা থেকেই তিলে তিলে গড়ে উঠেছে তোমার সন্তান। তাকে কোলে পিঠে মানুষ করে গড়ে তুলবো আমরা দুজন।'
'সে সুযোগ আর পেলাম কোথায় রোকেয়া। তুমি তাকে বলো তার জন্মদাতা বড় অসহায়, বড় নিষ্ঠুর। তাই তো সে না পেল পিতার আদর, না পেল ভালোবাসা, আশীর্বাদ! আমি আসছি রোকেয়া। বিদায় বন্ধু, বিদায় ----!’
রোকেয়ার চোখ দুটো বুজে এলো। ধীরে ধীরে নদীর তীরে অন্ধকার নেমে এলো। সে চীৎকার করে কেঁদে উঠলো- তুমি এভাবে চলে যেতে পারো না! তার যন্ত্রণাদগ্ধ কান্নার আওয়াজ অনেকদূর ভেসে গেল। নদীর দুই কূলে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে নদীর তরঙ্গে তরঙ্গে আছড়ে পড়লো। বাতাসে ভেসে এলো নমাজের আজানের সুর। যন্ত্রণাকাতর রোকেয়া হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো নমাজ পড়তে।
বিমলচন্দ্র গড়াই
নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ
ভারত
-
গল্প//উপন্যাস
-
05-08-2020
-
-