অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
অনিলার কাছে চিঠি – ফরিদ তালুকদার

     তখনও জানতাম না…
     বেয়াদব তারুণ্যের অনার্য হৃদয় ও যে একদিন হয়ে যেতে পারে, ঘর ছাড়া নদীর বুকে অরক্ষিত পালহীন এক তরী। যেখানে অনিলাদের মেহেদী আঁকা চরণের ধ্বনি অবাধ তান্ডবে মেতে উঠতে পারে যেকোন সময়। ভবঘুরে মন, হৃদয়-চত্বর, শ্রাগী সময় একে একে সব তারা লুট করে নিতে পারে যখন খুশি যেমন ইচ্ছে।
     তারপর একদিন… 
     সব ভুলে গিয়ে এক ভিন্ন অভিধানে তারা খুঁজতে থাকে জীবনের মূল্য। পালহীন নয়। তাদের দূরবীনে তখন ভেসে উঠে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের পথে চলা পাল তোলা এক তরী। জীবনের ঘাটে ঘাটে যে তরী কুড়িয়ে নিতে পারে তথাকথিত সোনালী ঐশ্বর্য্য।
     কিন্তু… 
     ততোদিনে লাগামহীন তারুণ্যের মনোজগতে তারা ঘটিয়ে ফেলে এক নিঃশব্দ বিভ্রাট। সুবাসিত তাদের ছায়ার ঘ্রাণ, অজান্তেই তখন দখল করে নেয় তরুণের অস্থি মজ্জার সব চরাচর…! 
     সময়ের সন্ধিক্ষণে এমনই…
     আমাদের ভালোবাসাগুলো অকালেই পথ হারিয়ে ফেলে নিরাপত্তা নামক একটি শব্দের সন্ধানে। অর্থই যেখানে অবতীর্ণ হয় দিক দর্শনের মূল ভূমিকায়!
     আজ… 
     এতো এতোটা বছর পরে এই কথাগুলো তোকেই লিখছি অনিলা…! 
     জানি… 
     কোনদিন ই এ লেখাটা খুঁজে পাবেনা তার আরাধ্য ঠিকানা, তবুও…!
     বিষয় আর বস্তুই যদি সুখের উৎস হয় তাহলে যতোটুকু জেনেছি, বলতে পারি তুই ভালো আছিস। এই খবরটাও পেয়েছিলাম বছর কয়েক আগে। লিটন দিয়েছিলো। আমার সম্পর্কে বলার মতোন তেমন কিছুই নেই। বলতে পারিস আগের মতোই…। 
     মন জঙ্গলের বেদীতে গড়ে ওঠা মূর্তিটা এখনো আছে। অনেকটাই দীনহীন। খসে পড়েছে পলেস্তারা। সংস্কারের কোন প্রয়োজন বোধ করিনা। অদ্ভুত বিষয় কি জানিস? তুই চলে যাবার পরই ওটা গ্যালাতিয়ার মতো পূর্ণ রূপ ধারণ করে…! জানিনা… এটুকুই হয়তো নূতন মনে হতে পারে তোর কাছে।
     সুযোগ পেলে বিদেহী মনের আস্তরণ খুলে, এখনো শুয়ে থাকি সবুজ ঘাসের বিছানায়। রাতভর আমার ওষ্ঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পাড়ি দেয় একটি ধ্রুব তারা। আমার কপালের উপর একটা নীল প্রজাপতি এখনো, কেন যে ভাগ্যলিপি লিখে যায় তা আমি বুঝতে পারিনা..! মাঝে মাঝে মনে হয়, ভালোবাসা শব্দটা এখন জীবনের আঙিনা ছেড়ে শুধু বইয়ের পাতায়ই পরিত্রাণ খোঁজে। 
     জলের দীনতাও তো একদিন মুছে দেয় মৌসুমি বৃষ্টির মাতম। কখনো উৎসের ইতিহাস না জেনেও রংধনু কেড়ে নেয় আমাদের হৃদয়। 
     অথচ আমি…!? 
     বিরহের শিলাখন্ডে তৈরী একটি প্রতিবিম্ব, অচলায়তনের রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হৃদয়ের ধ্বংস স্তুপের উপর। তারই কপালে ভালোবাসার অগ্নি টিপ পড়িয়ে আমি তাকিয়ে থাকি সকাল-সন্ধ্যায়!
     হয়তো কোন প্রতিক্রিয়া হবে না, তারপরও তোকে একটা খবর বলি অনি। দুঃখের…! গত জুলাইয়ে লিটন টা চির বিদায় নিলো মাত্র দু’ঘন্টার নোটিশে!? ওকে তুই ভুলে যাবার কথা নয়। মনে পড়ে...? ব্রেকের সময় কিংবা কলেজ ছুটির পরে, তুই যখন আমাকে নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরীতে যেতে চইতিস, তখন সে আমন্ত্রণকে উপেক্ষা করে, ও আর আমি আবাহনী / মোহামেডান টিম গড়ে কলেজ মাঠে ফুটবল খেলায় মত্ত হয়ে যেতাম? 
     একদিন তাই রাগ করে তুই বলেছিলি--- 
   “প্রোমিজ বাই গড, (এটা বলা তোর একটা মুদ্রা দোষের মত ছিলো, প্রায়শই এ নিয়ে আমি তোকে ক্ষেপাতাম) আর কখনো তোকে আমি কোথাও যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করবো না!” 
     তুই কি এখনো এটা বলিস? তোর বর কি এটা নিয়ে তোকে ক্ষেপিয়ে তোলে? 
     একটা মজার খবর দেই… 
     লিটন তোকে ভালোবাসতো! 
     শুনে আকাশ থেকে পড়লি নাতো?
     কথাটা ও বলেছিলো যখন তুই আমাদের দুজনেরই জীবন বলয় থেকে অনেকটাই দূরে…! বলেছিলো--- “শুধু আমিই না, ক্লাসের সবাই ই বুঝতে পারতো তোদের বিষয়টা, তারপরও আমি ওকে…” 
     ঐ দিন ও আমাদের কলেজ পিকনিকের একটা ছবি নিয়ে এসেছিল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে যেন আপন মনেই বললো--- “ও তোর জন্যে এতোটাই করতো আর তুই শালা…!?” 
     ক্লাসে আরও তিন চারটা ছেলে তোর জন্যে প্রায় উন্মাদ ছিলো তা আমি জানতাম। কিন্তু ওর মনের এই গোপন কথাটি আমি কখনো জানতে পারিনি! আমি শুধু বলেছিলাম--- তুই এটা এতোদিন পরে কেন বলছিস? 
     মানুষের হৃদয়ের পাঠ আমি এখনো করতে পারিনা অনি…! 
     বিষয়-সংসারও এখনো আমাকে তেমন টানে না…!
     পৃথিবীর মাটি আজ কোভিড-১৯ আক্রান্ত। মানুষের মন ও ইতিহাসের পাতায় এই বিমারীটির কথা বহু বহুকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে। জানিনা সময়ের এই আঘাত তোদের জীবনকে কতোটা প্রভাবিত করেছে। তবে আমি এখনো মনে করি, আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিমারী হলাম আমরা মানুষেরাই! আশ্চর্য হলি? এ নিয়ে আর বেশী কথা বলবো না আজ। তবে আমার বিশ্বাস একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবি। আমার মনোজগতে অবশ্য অসুখের যে বীজ তুই বুনে গেছিস, তা দিনে দিনে বৃক্ষ রূপ নিয়ে অনুক্ষণ আমাকে নেশার মতো ছেয়ে থাকে। তাই সবকিছুতেই আমি একরকম বিকারহীন এখন!
     লাইব্রেরীর সিঁড়িতে বসে একদিন তুই বলেছিলি--- “কোন একদিন এমন নীল আকাশের সূর্য ডুবে গেলে, সপ্তর্ষিদের দিকে তাকিয়ে আমরা গোটা রাত কাটিয়ে দিবো!” এমন অসংখ্য রাতেই এখন একা একা আমি সপ্তর্ষিদের গতিপথ মুখস্থ করি। চন্দ্রালোকের নীচে আমার অস্তিত্বের মতোই সত্য যে ছায়া শরীর আমাকে জাগিয়ে রাখে সারারাত, আমি তার সবটুকু অবয়ব মুখস্থ করি। দূর নিবাসী কোন নক্ষত্রের হাত ধরে আমি হারিয়ে যাই সময়ের অতল গহ্বরে। 
      এই স্মরণগুলো ছাড়া তোর আর কোন স্মৃতিই আমার কাছে নেই। ও হ্যাঁ একটি বিষয়।  সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতে আমার নিত্যদিনের যাপনে খানিকটা লাগাম দিতে যে রুটিনটা তুই নিজ হাতে লিখে দিয়েছিলি? ঐ পাতাটা রয়ে গেছে এখনো কোন একটা ব্যাগের ভিতর। পুরনো কিছু জঞ্জাল ফেলে দিতে গিয়ে কয়েকদিন আগে ওটা আমার চোখে পড়ে। আপন মনেই হেসে উঠলাম কাগজটায় চোখ বুলিয়ে। দিনে একটি সিগারেট ফোঁকার অনুমতি লেখা আছে তাতে! তা আবার তোর কাছে বসেই করতে হবে, শর্তে লেখা! মনে পড়লো তুই একদিন বলেছিলি--- “ধুমপান ও যে একটা শিল্প তা তোর ধুমপানের ভঙ্গি না দেখলে বুঝা যায় না!” আর সে কারনেই এই ছাড়পত্র খানি পেয়েছিলাম! আজ তোকে বলছি অনি--- কেউ যখন সারাদিনে একটা বা দুটা সিগারেট টানে তখন ঐ ভঙ্গিমাটা ধরে রাখা সম্ভব। কিন্তু সেই সংখ্যাটা যখন বিশে উঠে যায় তখন আর সেটা থাকে না। বরং ঐ সিগারেটের মতোই সে শুধু পুড়ে পুড়ে শেষ হয়!  তুই কাছে থাকলে এই প্রজন্মের কোন তরুণীকে দেখিয়ে বলতাম এই যে দেখ---" ইনি হলেন পৃথিবীর সব আদর্শ প্রেমিকার রোল মডেল!”
     সব এখন খুব হাস্যকর মনে হয় রে অনি, তাই না? স্মৃতির ফ্রেমে বন্দী এক প্রস্থ জীবন নিয়ে ভাবা, এতোটা বছর পড়ে এই সব লেখা, সবই এক অকারণ সময় ক্ষেপণ ছাড়া তো আর কিছু নয়! আসলে  আমাদের গোটা জীবনটাই তো প্রহসন আর কৌতুকের মঞ্চে মঞ্চস্থ একটা ড্রামা। যে মঞ্চে প্রতিটা হাসির অন্তরালেই যেন থাকে এক বিষাদের গ্রহণ! অর্থহীন এই সব আবেগের মূলধন গুলো সেখানে কচুরিপানার মতোই উদ্দেশ্যহীন ভাসতে থাকে নিরবধি সময়ের স্রোতে! 
     ভালো থাকিস… ভালো থাকিস তুই অনিলা…!

ফরিদ তালুকদার। টরেন্টো