অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
জয় বাবা শনিনাথ - সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     মাথা গরম বোঝাতে কত কথাই না ব্যবহার করা যায়। রগচটা, বদমেজাজি, রাগী, খোচোপার্টি, তিরিক্ষি মেজাজ ইত্যাদি ইত্যাদি।
    যেমন গদাই দা। হেব্বি খোচোপার্টি। উচ্চারণের কায়দাই আলাদা। বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিমা দেখলে মনে হবে, সারা দুনিয়ার একছত্র অধিপতি।
     সেদিন গলির মোড়ে চায়ের দোকানের সামনে গুলতানি করা গদাই কে, কী  কুক্ষণেই  না হরি দা, অভ্যেস বশত জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল, 
     -কিগো গদাই কেমন আছ?
     ব্যাস, আর যায় কোথায়, দিলো ছুটিয়ে ভাষার তোড়, 
     -তোর কী বে শালা, খুব খারাপ আছি, কী করবি? তুই,,, আমার ভালো করতে পারবি। মোরোদ আছে? যা ভাগ শালা এখান থেকে। যতসব ফালতু মাল,,, যা ভাগ। ভালো মারাতে এসেছে শালা।
     হরি দা বুঝলো গতিক সুবিধের নয়। মানে মানে কেটে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই বিরসবদনে কাঁচুমাচু হয়ে সরে গেল।
    দুর্বলতার লক্ষণ। দুর্জনেরে করহ পরিহার। য পলায়তি স্ব জীবতি। 
     কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকমও হতে পারতো। হরিদাও  যদি ঐ একইরকম তিরিক্ষি মেজাজের ভাষাবিদ হতো, তাহলেই খেল জমে যেত। লাগ ভেলকি লাগ। পিয়ারি লালের খেলা দেখে যা। মার কৈলাশ। কিন্তু তেমনটা হবার নয়। কেননা, হরিদা  তথাকথিত ভদ্রলোক। ভদ্রলোকেরা গা বাঁচিয়ে চলাতেই নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পছন্দ করে। কিন্তু সব আম একই জাতের হয়না। প্রকার ভেদ আছে। শুনুন তবে,,,।
     রতনে রতন চেনে, শুয়োরে চেনে কচু। যেমন নেলো দা। সে আবার গদাই কে গুলে খেয়ে নিতে পারে। বাপেরও ঠাকুর্দা আছে। ধরা যাক। হরি দা যেমন বলেছিল, ঠিক তেমন করেই  নেলো দা, গদাই কে বললো,
     -কিরে গদাই কেমন আছিস?
     একগাল পানমশলা মেশানো হাসি দিয়ে গদাই দা মালাই মাখাবে,,,।
     কেন?  ওই যে বললুম, বাপেরও ঠাকুর্দা আছে। নেলো দা পার্টির তল্লাটে নেতা। লোকে খাতির করে। প্রমোটারি আর দালালী করে টু পাইস কামিয়েছে। দেমাক খুব। দেশের মহারাজা, মহামন্ত্রী, মহামাত্য দের সঙ্গে দেদার ওঠাবসা। তাদের বরাভয় হাত নেলোর উর্বর মাথায়। সুতরাং তাকে পায় কে। গদাই এর মতো হাজারো  ফুটো কানেস্তারা তার চারপাশে ঘুরঘুর করে একটু পেসাদ পাবার আশায়। নন্দী খুশ তো মহেশ্বর খুশ। কাক খুশ তো শনি খুশ। বাহনই আসল। তার পিঠে চেপেই তো এ লোক থেকে সে লোক অবাধ যাত্রা।
     -আরে দাদা আমার। তুমি যেমন রেখেছ গুরু।
     গোবদা মোটা ভুঁড়ি বাগিয়ে জাপটে ধরতে গেল গদাই।  নেলোদা, একটু পিছনে সরে গিয়ে বিরক্তি স্বরে বললো-  এই এই, দূর থেকেই ঠিক আছে। বেশি ঘসটা ঘসটি লাগাস না, জামা খারাপ হয়ে যাবে। 
     এই হলো কায়দা। মেশে কিন্তু দূরত্ব ঘুচিয়ে না।  শনি ঠাকুরের মতো। পুজো নেবে, কিন্তু ঘরে ঢুকবে না। সে জানে, এ পুজো ভয়ের পুজো। ভক্তির ছিটেফোঁটাও নেই।
     গদাই থেমে গেল। মুখের চেহারা শুকনো আমের আঁটি। করুণ সুরে বললো,
     -দূরে সরিয়ে দিও না ওস্তাদ, মরে যাবো একেবারে গুরু।
     হায়রে, কোথায় গেল রগচটা স্বভাব। কোথায় সেই তিরিক্ষি মেজাজের বোলচাল। তেল চুঁইয়ে ফুটো কানেস্তারা ফাঁকা।
     ধরাযাক, একটু আগে ঝার খাওয়া হরিদা, ঠিক সেই মুহূর্তে সেখান দিয়েই ফিরে আসছে। কী হতে পারে?
     হরি দা, গদাই এর শুকনো ঘুঁটের মতো মুখটি দেখে, প্রতিহিংসার চাপা মুচকি হেসে, যদি, গদাই এর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দ্যাখে, তাহলে? সিনটা একবার কল্পনা করুন। কিন্তু না, তেমনটা হবার নয়।
     হরিদা নির্বিবাদী নিরীহ ছাপোষা নাগরিক। তেলেও আছে জলেও আছে। আবার সুবিধেমত কিছুতেই নেই। দুহাত তুলে ভজ গৌরাঙ্গ। ঠোঁটের আগায় অমায়িক দেবত্ব হাসি। প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসী। জনদরদী নেতাদের  মূল্যবান ভোটার জনগণেশ।
     মতি স্থির নেই। যে যখন যা বোঝাচ্ছে, তাই বুঝছে।  নিজের কোনো মতামতই নেই। কাঁঠাল পাতায় বিশ্বাসী। খুড়োর কলের কারসাজি বোঝবার ক্ষমতাই নেই।
     আচ্ছা সত্যিই কী তাই? একটু ভাবুন।
     ছোটোরা বড়দের দেখে শেখে। বাবাকে দেখে ছেলে। গুরুকে দেখে শিষ্য। রাজাকে দেখে প্রজা। ভালো দেখলে ভালো শিক্ষা। মন্দ দেখলে মন্দ।
     যে দেশের রাজাই দুর্নীতিবাজ। সেই দেশের প্রজা সমূদয় সাধু-সন্ত হবে, আশা করা যায় কী?
     কিন্তু, একথাও তো ঠিক, সকলের সবকিছু ধাতে সয় না।
     তাহলে তাদের বাঁচার উপায় কী?
     তোয়াজ। শনির বাহন ভুশণ্ডির কাক বাবাজীদের তোষামোদ করে যাও। জ্যান্ত শনির সিন্নি চড়াও। পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে-গলিতে, মহল্লায় মহল্লায়,  রাস্তার মোড়ে মোড়ে জ্যান্ত শনিদের খোসামোদ করে যাও।
     হ্যা হ্যা করে হাসো। হ্যাঁ এ হ্যাঁ মেলাও। যেনতেন প্রকারে প্রমাণ করে দাও, তুমি তাদেরই লোক। তোলা চাইলে নির্দ্বিধায় সমর্পণ করো।
      ভক্তিহীন  শক্তিপুজো। অঞ্জলি লহ মোর।
     ব্যস, আর কোনও চিন্তা নেই। এবার যা প্রাণ চায় তাই করো। স্বাধীনতা উপভোগ করো। কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। বলার সাহস থাকবেনা। ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকবে সব। তুমি শনির কৃপা দৃষ্টিতে ধন্য। অন্যথায় কুদৃষ্টিতে ভস্মীভূত। ভুলে যাও, পৃথিবীতে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ বলে কিছু আছে।
     রাজা যেখানে রাজধর্ম পালনের দায় অস্বীকার করে, তখন, তুমি কে?
     মনে রেখো, তুমি ভোটার। শুধুই ভোটার।  মগজধোলাই হয়ে যাওয়া নিরীহ গোবেচারা মাথাগুনতি নতমস্তক কর্তব্যপরায়ণ, কর্মহীন, অন্নহীন, গৃহহীন, স্বাস্থ্যহীন, উপার্জনহীন, শিক্ষাহীন, প্রবল দেশভক্ত ভোটার  নাগরিক। আর কেউ নও, কিচ্ছু নও। শুধু জ্যান্ত শনি পুজোর নিষ্ঠাবান পূজারি। জয়ধ্বনি দাও। বলো, জয় বাবা শনিনাথ। যুগ যুগ জিও।

সুজিত চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা