অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
পিরিতি - প্রদীপ দে

    হেমেনবাবুর কত অহংকার। মাটিতে পা পড়ে না।গাড়ি চড়ে তড়বড় করে নামে বাড়ির গেটে। গটগট শব্দ তুলে বাড়ির মধ্যে ঢোকে ধকাং করে গড়ির দরজা খুলে।
     গিন্নিকে ডাকে - কোথায় থাকো?  আমি যে এলাম। কই তোমার তো দেখি এখন আর আমাকে নজরেই আসে না।
     গিন্নি পাত্তাই দেয় না। অনেক্ষণ অন্বেষণ করার পর মালুম হয় বেরোবার সময়েই উটকা ঝামেলায় গিন্নির মেজাজ বিগড়ে গেছিলো, এখনো তার রেওয়াজ আছে নিশ্চয়ই।
     নিজেই বাথরুম থেকে বেড়িয়ে হাঁক মারে - কানাই কোথায় রে? চা- টা দিবি নাকি? 
     কোনো আওয়াজ নেই। চারদিকে সুনসান। কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। মনটা কেমন করে ওঠে, ভয় ভয় লাগে। রান্নাঘরে উঁকি মারে হেমেন। ওঃ মাঃ দেখো কি কান্ড? ওইতো কানাই রাতের সব্জি কাটছে, আর ঠিক তার পাশে বসে খুনসুটি কাটছে রান্নার মেয়ে রাধু। মাথা গরম হয়ে যায় হেমেনের ওদের লুকানো পিরিত দেখে।
   - কিরে তোরা এখানে, আর সাড়া দিচ্ছিস না? হারামজাদা কোথাকার !
     না কোনো আওয়াজ নেই। কোনো ভয়ের বালাই নেই। মালিকের সামনেই পিরিত করছে ওরা। মালিককেই অবজ্ঞা করে, ওরা ওদের নিজেদের কাজ করে যায়। হেমেন ওদের একেবারে কাছে চলে যায়।
    - কি ব্যাপার হলো!
    - বাইরে চলে যান বাবু, গিন্নিমা দেখলে আমাদেরেই বকুনি দিবে।
     হেমেন এবার ব্যাপারখানা বোঝে- মানে সব মালার ই কারসাজি। কাজের লোককে বারণ করে দিয়েছে। কি অবস্থা? নিজের স্বামীকেই অবজ্ঞা?  তাও কিনা কাজের লোকের কাছেই?  লজ্জায় মাথার চুল নেতিয়ে পড়ে। সকালে ঝগড়ার সময় যদিও এই মাথার চুলই খাঁড়া হয়ে উঠেছিলো। গুটিগুটি পায়ে পিছপা হন কর্তা। কানাই রাধু কে চিমটি কেটে মুচকি হাসে।
     হেমেন পরে মহা ফ্যাসাদে। বড় রাশভারী লোক তিনি। বাইরে তার গম্ভীর আচরণে সকলেই ভয় পায়। আর ঘরে একেবারে ভিজে বিড়াল। অফিসে সবাই তার কথায় ওঠে বসে। ব্যাপারখানা জেনে গেলে ইজ্জত থাকবে না। আর কেউ মানবেও না। 
    কি যে করবে ঠিক করে উঠতে সময় চলে গেল।
     উপরে উঠে দেখে, গিন্নি নিজেকে নিয়ে নিজেই ব্যস্ত। প্রসাধন করে বেরোনোর প্রস্তুতি চলছে। বেশি সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না ভেবে বলে ফেলে- বলি ব্যাপারখানা কি?  অসহ্য হয়ে উঠেছে সব কিছু।
     গিন্নি মালা শাড়ির আঁচল ঝুলিয়ে হাঁক মারে- ওহে রামন গাড়ি বার কর। সুগন্ধি ছড়িয়ে অবজ্ঞার ভঙ্গিতে  সিড়ি দিয়ে নীচে নামে। হেমেনের গাড়ি স্ট্রাটের আওয়াজ ওঠে। পিছিনে একরাশ কালো ধোঁয়া পড়ে থাকে।
     হেমেনের পেট চোঁ চোঁ করে। না পায় চা না খাবার। বাইরে গিয়ে যে কিছু খেয়ে আসবে তারও উপায় নেই। গাড়ি নিয়ে মালা পার্টিতে। কি মুশকিল হলো। পায়ে হেঁটে বেরোনো যাবে না। ইজ্জত আছে একটা।
     ফোন করে গিন্নিকে। নিরুপায় হয়ে। না সে ধরলো না - বেজে গেলো। সোফায় বসে বসে ঝিমিয়ে কাত হলো হেমেন।
     রাত ন' টায় গিন্নি ফিরলেন। ধকাং করে আওয়াজ করে গাড়ি গ্যারেজ মুখো হলো। আওয়াজে চোখ তুলে দেখে গিন্নি খুশিতে ঢুকছে, হেমেন তাড়াতাড়ি মালার পিছু নিল- কি ব্যাপার? কি হয়েছে? তা কি বলবে তো?
     গিন্নির মুড ভাল ছিল- কেন এখানে কেন?  যাও না তোমার নেকী সেক্রেটারির কাছে যাও না- সোহাগ খাও না, এখানে কেন?
    - সে আবার কি? ও তো কাজের জায়গা? ও যে কাজের মহিলা?
     তা তাই যাও না কাজের মহিলাকে নিয়েই কাজ সারো,বেকাজের বউয়ের কাছে কেন?
    - এসব কি কথা ছিঃ ছিঃ।
    -তোমার এখানে সব খেলা বন্ধ।এখানে সব আমার অর্ডার!
    -কিন্তু এটা তো আমার বাড়ি?
   - ছিল। এখন আমার!
   - এতো মহা ঝামেলা?  যার খাবে তারই' --
     কথা শেষ হয় না, বউ মালা ঝাপিয়ে পড়ে- কি বললে?
     হেমেন বিপদ বুঝে সরে আসে- ঠিক ঠিক,  তুমিই। ঠিক, ক্ষমা  চাইছি মাপ করে দাও। কি করতে হবে বলো?
    - আর কোনোদিন যেন ওই মহিলাটিকে অফিসে না দেখি।
    - সে কি ছাড়িয়ে  দেবো?
    - তাহলে ঘরে তুলে আনো।
    - তাই ভালো,  আমি ওকে বাড়ি ডাকি, ও বাড়িতেই কাজ করুক তোমার সাথে, তাহলে তো আর সন্দেহ থাকবে না, কি বলো?
    - হ্যাঁ,  হ্যাঁ। ডাকো -- আমিও ঝ্যাঁটা রেডি করে রাখছি।
    - মারতে পারবে তো? আমি ডাকতেই পারি। তুমিতো ডাকতেই বলেছো যখন।
    - যদি আমি মারতে না পারি তো আমি এক মায়ের বেটি নই বুঝলে, নাহলে আমাদের কুত্তার নাম বদলে, মালা করে দিও - এই বলে রাখলাম।
    - আচ্ছা আচ্ছা তাই হবে। কিন্তু মনে রেখো।
   - হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক আছে। আর যদি পারিতো তোমায় ওর সঙ্গে কান ধরে উঠবোস করিয়ে ছাড়বো -- এই বলে রাখলাম মালা বোস -- হুঙ্কার ছেড়ে বেশ রাগের সঙ্গে ধপাস করে দামী সোফায় গিয়ে বসলো সে।
     গম্ভীর ভাবে হেমেন মোবাইলে কল করলো। কায়দা করে স্পিকার অন করে ডাকলো -- স্নিগ্ধা, আমি তোমার বস্ বলছি,আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি এখনই আমার বাড়িতে  একবার এসোতো। -- বলেই সংগে সংগে লাইনটা কেটে দিল, যাতে ওপর প্রান্তের গলা না শোনা যায়!
    ওদিকে সোফায় বসে মালা গিন্নি রীতিমতো হাঁফাতে লাগলো।কর্ত্তার সাহস দেখে সে অবাক!
    কোথায় জব্দ হবে না,  না তাকেই চ্যালেঞ্জ করছে?
    চেঁচামেচি করে বাড়ি ফাটালো -- কে কোথায় আছিস ঝ্যাঁটা জুতোগুলো নিয়ে আয়তো আমি একবার দেখি!
     সঙ্গে সঙ্গে গিন্নি হাঁক পেড়ে ডাকে - রামন গাড়ি নিয়ে যা, ঠিকানা খুঁজে হারামজাদীকে নিয়ে আয় এখুনি। দেখি আজ আমার একদিন না তোদের কর্ত্তা বাবুর একদিন!
     হেমেন অতুৎসাহে ঠিকানা বুঝিয়ে দিতেই রামেন হু -হু করে গাড়ি ছুটিয়ে দেয় এই রাতেই। হেমেনের সাহস দেখে গিন্নি মালা বোসের তো চক্ষু চড়কগাছ! এতো সাহস!
     গিন্নিমাকে সব্বাই ভয় পায়। হুড়োহুড়ি লেগে যায়, কে কিভাবে সাহায্য করবে। কানাই রাধু এখন একবারে বউয়ের কাছটি ছাড়ে না।
     কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি আবার ফিরে আসে হুস করে এসে গেটের কাছে এসে থামে। ধকাং করে গাড়ির দরজা খোলার আওয়াজ আসে। সবাইয়ের চোখ দরজায়! এবার বুঝি এক ভয়ানক এক দৃশ্য দেখা যাবে,এই আশঙ্কায় সকলেই।
     ইতিমধ্যেই দরজা খুলে এক ছিমছাম মহিলা প্রবেশ করে -- যার শরীর বোর্খায় ঢাকা ছিল।
    - ছ্যা,  ছ্যা শেষমেশ মুসলমানে পিরিত হলো -- বলেই ঝ্যাঁটা হাতে, রে রে করে তেড়ে গেল গিন্নি মালা বোস।
     মহিলাটি একটুও সুযোগ না দিয়ে ঝাপটে ধরলো মালাকে, মালা ছিটকে সরে যেতে চাইলো -- ছিঃ ছিঃ জাত গেলো রে, এই মিনসেটার জন্যে। ততোক্ষনে মহিলাটি জাপটে ধরে ফেলেছে মালাকে  -- ওরে আমার দিদিরে, আমি যে তোর বোন পলা রে।-- বলেই মুখের বোর্খা সরিয়ে ফেলেছে, তারই মায়ের পেটের বোন পলা।
     মালা দেখেই চমকে ওঠে -- ও মা এযে তুই। তুই কোথা দিয়ে এলি?
   - আরে আমিই তো জামাইবাবুর অফিসে কাজ করছি।মজা করার জন্য জামাইবাবু বলতে বারণ করেছিল। জানি দুদিন মজা তো হোক, তারপর তো জানা যাবেই।
     মালা বোস - নট ফোঁস ফোঁস - একেবারে চুপ।ভয়ে, লজ্জায় কুপোকাত!  বিপদ বুঝে কেটে পড়তে চায়, পলা কে ধরে নিয়ে ওপরে উঠতে চায় - ওপরে চলে আয়, কথা বলবো,এখানে নয়।
     নিচে কর্ত্তা হেমেনের সে কি উল্লাস -- মার দিয়া কেল্লা!  হো হো, এক বাপের দো বেটি, হো-হো -- করে চেঁচায় -- কে কোথায় গেলি রে কুত্তাটারে নিয়ে আয়, আজ ওর যে নতুন নামকরন হবে রে !

প্রদীপ দে। উত্তর চব্বিশ পরগণা