অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
মনোবিদ - অতনু রায়

   "মাথাটাকি সত্যি সত্যি খারাপ করে ফেললে, আপন মনে কি সব বকে চলেছ অতীন।"....
     বিশুদার কথায় সে বললে, জীবনের কাছে এটাই বোধহয় শেষ পাওনা ছিল আমার। সংসার পরিজন হারিয়ে ছিলাম, আজ যে নিজেকে হারাতে চলেছি।
     - কাল ডাক্তারের সাথে তোমার appointment আছে তো। 
     - আমার ভয় করছে বিশুদা, যদি হারিয়ে যাই!
     - নিজেকে হারিয়ে ফেলা সহজ নয়। নিজেকে শক্ত করতে শেখ। তাছাড়া এখানে আমরা সবাই তো রয়েছি। 
     মাঘ মাস। হু হু করে বাতাস বইছে। আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করেছে। মেস থেকে বেড়িয়ে ষ্টেশন আসার সময়  তাড়াতাড়িতে ছাতাটা নিতে ভুলেছে অতীন। টিকিট কেটে সে ডাউন গাড়ির সময়সূচী দেখে। সাতটা দশে ডাউন কাটোয়া লোকাল। শুরু হল ঝড়বৃষ্টি। আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হয়েছিল পশ্চিমীঝঞ্ঝার কারণে সন্ধ্যের দিকে ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন লোক চোখে পড়ছিল, বৃষ্টি শুরু হতে আঁধারের কোন গুহায় আশ্রয় নিয়েছে জানা গেল না। 
     অতীন ঘড়ি দেখে ছ'টা ষোল। ষ্টেশন মাষ্টারের কেবিনের দরজাটি আধ ভেজানো। প্ল্যাটফর্ম চত্বরে সে একা। প্ল্যাটফর্মের লাল আলোর আভায় হাত পা গুলো তামাটে দেখাচ্ছে। চায়ের দোকানের ঝাপ বন্ধ। ধপ! - একটা আওয়াজ। চমকে ওঠেঅতীন। কোত্থকে একটা কালো হুলো বেড়াল তার সামনে লাফিয়ে পড়ল। জ্বলজ্বল চোখে বিড়ালটা অতীনের দিকে তাকিয়ে ডাকল- ম্যাও।
     - একটু সরে বসবেন। ভয় পেলেন নাকি ! অতীন সরে বসলে লোকটি তার ভেজা ছাতা বন্ধ করে অতীনের পাশে বসল। লম্বাটে গড়ন। গায়ের রঙ কালো। কাঁচাপাকা চুল। বাঁ গাল জুড়ে লম্বা কাটা দাগ। 
     ফ্ল্যক্স থেকে চা বের করে অতীনের দিকে এগিয়ে বলেন, নিন চা খান। 
     অতীনের বিষ্ময় ঘোর তখনো কাটেনি। সে ষ্টেশনে একাই বলতে ছিল। লোকটি কখন আসল। সে একবার ষ্টেশনমাষ্টরের কেবিনের দিকে তাকাল। কেবিনের দরজা বন্ধ। লোকটি বলেন, সাহেবরা দাওয়াইটা ভালই দিয়ে গেছেন। ও মশাই! চা যে ঠাণ্ডা  হয়ে গেল। ধরুন। 
     অতীন দীর্ঘশ্বাস ফেললে, লোকটি বলেন, এই মাঘের শীতে ঝড়বৃষ্টি  গোদের ওপর বিষফোঁড়া মশাই।..... নিশ্চয়ই আমার কথা ভাবছেন। আর ভাবনাটা আসবে নাই বা কেন অন্ধকারময় জনমানবশূন্য এইরকম স্থানে আমার মতো একটা বিদঘুটে চেহারায় লোক অযাচিতভাবে ভাব জমালে চিন্তা তো আসবেই। 
     অতীন একটু হেসে চায়ে চুমুক দিল। বেঞ্চের পাশে সেই কালো বিড়ালটা নেই। অতীনকে চঞ্চল হতে দেখে লোকটি বলেন, কিছু খুঁজছেন। 
     অতীন বিষ্ময়ে বলে উঠল, আপনি আমার মনের কথা কি করে জানতে পারছেন। একটু আগে চায়ের দোকানের দিকে তাকিয়ে চায়ের কথা ভাবতে আপনি এসে চা offer করলেন। এখন ওই বিড়ালটার কথা; 
     - বিড়াল!
     - একটা কালো বেড়াল এখানে একটু আগে বসেছিল। 
     - আছে কোথাও এদিক ওদিকে। সবকিছুকে  নজরবন্দি করা যায়  কি অতীনবাবু? আপনি তো মনোবিদের কাছে যাচ্ছিলেন।
     প্ল্যাটফর্মের লাল আলোটা একবার নিভে দপ্ করে জ্বলে উঠল। অতীনের গলা শুকিয়ে আসে। কানের গা বেয়ে একবিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ে। লোকটি তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। রুমাল এগিয়ে বলে, মনের আকাঙ্ক্ষা সবসময় পূর্ণ হয়। কেউ তা বুঝতে পারে কেউ পারে না। কোনটা বিশ্বাস হচ্ছে না আমাকে, না আপনাকে। মানুষের মনের কথা পড়াই আমার কাজ। মনোবিদের কাজ। অথচ আমাদের শরীরে মন বলে কিছু নেই। হার্টের পীড়াকে সবাই মন বলেভুল করে বসে। শরীরের সকল function কে control করে এই brain আর কিছু না। 
     - ওরা যে বলে....
     - আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ। কোন মনোবিদের কাছে যাবার আপনার দরকার নেই। এটা আমার  prescribed বলতে পারেন। 
      অতীনের অস্ফুট স্বর শোনা যায় না। চোখ তুলতে দেখে সেই কালো বেড়ালটা বেঞ্চের পাশে বসে। চারপাশটা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
     পরদিন খবরের কাগজে ছেপেছে ডাঃ অবিনাশ ধর গতকাল সন্ধ্যায় রুগী দেখতে যাবার পথে ঝড়বৃষ্টির সময় গাড়ি দুঘটনায় মারা গেছেন।

অতনু রায়
হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ