ঘন্টা - রীনা দাস
ছেলে ফিরল ট্যুর থেকে। ব্যাগ থেকে বের করছিল যা যা কেনাকাটি করেছে। দার্জিলিং এর চায়ের প্যাকেট, লেডিজ শাল, মাফলার, পশুপতি মার্কেট থেকে কেনা ছাতা আর গ্যাংটক থেকে কেনা ছোট ছোট ঘন্টা। কালচে তামাটে রঙের, কারুকার্য করা ঘন্টা গুলোর পেণ্ডুলাম থেকে লাল সুতোর ঝালর ঝুলছে। গোড়ায় লম্বা লাল দড়ি পরানো। নাড়ালে টং লিং টং লিং করে বাজে। আমাকে একটা দিল। আমি তো মুগ্ধ হয়ে দেখছি আর মনের সুখে টুংটাং করে বাজাচ্ছি। ছোটবেলায় ঠাকুমার পুজোর ঘন্টাটা হাতাতে পারলেই এরকম করে বাজাতাম। শুধু ঘন্টা বাজানোর লোভে রোজ ঠাকুমার সব পুজোর বাসন ঝকঝকে করে মেজে দিতাম। সেই সব কথা মনে পড়ে গেল।
: হ্যাঁরে বাবু, এটা দিয়ে কি পুজো করে?
: না। এটা বৌদ্ধ ঘন্টা। এর অলৌকিক ক্ষমতা আছে।
: কি রকম কি রকম?
আমার তীব্র কৌতুহল।
: এই যে দেখছো লম্বা দড়িটা, এটা দিয়ে গলায় হারের মত করে পরে থাকতে হয়। হাঁটাচলা করবে আর ঘন্টাটা টুংটাং করে বাজবে। তার আওয়াজ যতদূর যাবে, ভুত প্রেত, পিশাচ, মার, সব পালাবে। কেউ কাছে ঘেঁষতে সাহস করবে না।
শুনে মুগ্ধতার সঙ্গে কেমন একটা গা সিরসিরোন আকর্ষণ চেপে ধরল আমাকে। তক্ষুনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় পড়তে যাচ্ছিলাম ঘন্টাটা। কত্তা বাধা দিল।
: আহা আহা! কর কি? ওভাবে যখন তখন নয়। এর কথা পড়েছি বইতে। চান করে, শুদ্ধাচারে গলায় ধারণ করতে হয়।
কত্তার অগাধ জ্ঞান। আর তার ওপরে আমার অগাধ বিশ্বাস। কিন্তু পরার জন্যে তো আর তরও সইছে না। তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে গেলাম চান করতে। চান সেরে, কাচা কাপড় পরে, শুদ্ধ চিত্তে, ঘন্টাটাকে ভক্তিভরে কপালে ছুঁইয়ে গলায় পরে নিলাম। বেশ দারুণ লাগছিল। আজকাল ওই যে লাল নীল ফিতের হার বেরিয়েছে না, ওই রকম লাগছিল। তবে আরো সুন্দর।
আর তার পর থেকেই গা ছমছমে ঘটনা গুলো ঘটতে সুরু করল। সন্ধে বেলা এঘর থেকে ওঘরে যাচ্ছি, ঘন্টা বাজল হাঁটার তালে। আচমকা মনে হল, কে যেন সাঁৎ করে বারান্দা থেকে সরে গেল। আর খুব মৃদু খিকখিক করে হাসির আওয়াজ। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, ফাঁকা। কেউ কোত্থাও নেই। গা শিউড়ে উঠল ভয়ে। মনে মনে বললাম, "ওম্ মণিপদ্মে হুং"।
কিন্তু তাতে ঘন্টা হল! এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকল। সব সময় মনে হয় কে বা কারা যেন আড়াল থেকে দেখছে। কুটনো কুটছি, ঘন্টা বাজছে টুংটুং। ঘসঘস করে পোড়া মাজছি, দুলুনীতে ঘন্টা খুব জোরে বাজছে টংলিং টংলিং। আর মনে হচ্ছে, কে যেন দাঁড়িয়ে ছিল আড়ালে, রান্নাঘরের পাশে, প্যাসেজে, সিঁড়িতে, বারান্দায়। সরে গেল এইমাত্র। সেই সঙ্গে মৃদু হাসি চাপার আওয়াজ। কখনো বা ফিসফিসে কথা। শুনতে পাই। বুঝতে পারি না। ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি। আনমনে চাটনীতে চিনি দিতে ভুলে যাই, ডালে ডবল নুন দিয়ে ফেলি, সন্দেশের গায়ে লেগে থাকা টিস্যু পেপার খেয়ে ফেলি (অবশ্য এটা আগেও খেয়ে ফেলতাম। ও আলাদা করা খুব শক্ত)। সে এক কেলেংকারীয়াস অবস্থা।
দুদিনের মধ্যে চোখের কোলে কালি। আর কাজল পরতে হয় না। খাওয়া, ঘুম, সব কমে গেছে ভয়ে। এতদিন ফেসবুকে বানিয়ে বানিয়ে ভুত পেত্নী, অলৌকিক সব গল্প লিখতাম। আর এখন আমার আশেপাশেই অশরীরীদের নিঃশব্দ আনাগোনা! ওরে বাবারে! একি হল রে! মনটাকে ঘোরাতে, কবিতা লিখতে গেলাম। কে যেন হাত দিয়ে সড়সড় করে লিখিয়ে নিল,
কারা যেন ঘরের ওপাশে
খুব আস্তে মৃদু হাসে,
সাঁৎ করে সরে গেল আড়ালে,
কথা বলে ফিসফিস,
খুক্ করে কাশে, ইশশ্,
মিলিয়ে যায় সেদিকে পা বাড়ালে।
ঘন্টা বাজলে টানা,
ভুত বা ভুতের ছানা
আড়ালেই ঘুরঘুর করে,
অশরীরী আনাগোনা,
ভয়েতে নীলাঞ্জনা
বুক ধড়ফড় করে মরে।
হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম ছড়াটার দিকে। এ কি লিখলাম? আমি লিখলাম, নাকি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল কেউ? ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। আর গলায় বাঁধা গ্যাংটকের ভুত তাড়ানো বৌদ্ধ ঘন্টা বাজতে লাগল, টংলিং টংলিং।
খুব রাগ হতে হতে, অনেক সময় যেমন রাগটা গা সওয়া হয়ে যায়। খুব দুঃখ শোক পেতে পেতে যেমন মানুষ পাথর হয়ে যায়। ঠিক তেমনি ক্রমাগত ভয় পেতে পেতে, ভয়টার বিরুদ্ধেই ঘুরে দাঁড়ায় মানুষ। আমারও তাই হল এক সময়। ছেলে কাল চলে যাবে কাজের জায়গায়। আজ আব্দার করল, হিং দেওয়া মাখা মাখা আলুর দম আর লুচি খাবে। কত্তাও দারুণ সাপোর্ট করল প্রস্তাবটাকে (ওনারও খুবই প্রিয় কিনা)। সন্ধে গড়িয়েছে। আলুর দম ফুটছে কড়ায়। ভুরভুর করে খাইখাই গন্ধ ছাড়ছে হিং মশলার। খপাৎ খপাৎ করে একমনে ময়দা ঠাসছি। গলায় বাঁধা ঘন্টাটা বাজছে টংটং করে। হঠাৎই, একদম হঠাৎই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলল, কে বা কারা দেখছে আমায়, আড়াল থেকে। মুখ তুলে দেখলাম দরজার দিকে। কেউ নেই। অথচ মনে হল, ছিল কেউ। সরে গেল এক্ষুনি। আর সহ্য হল না। বাঁহাতে ঘন্টাটাকে মুঠো করে ধরে (যাতে না বাজে), ডান হাতে গরম খুন্তিটাকে বাগিয়ে ধরে (বাড়তি সাহসের জন্যে), পা টিপে টিপে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। এবং এই প্রথম বার স্পষ্ট শুনলাম, ওপাশের প্যাসেজে সেই তেনাদের কথাবার্তা!
: আহা রে! খুব সরল, না!
: হ্যাঁ। প্রায় হাবাগবা।
: ছোটবেলা থেকেই এরকম ছিল?
: হ্যাঁ। তবে মনটা খুব ভাল। সব কেমন বিশ্বাস করে নেয়। দেখ, কেমন গরুর মত গলায় ঘন্টা বেঁধে ঘুরছে।
: হিহিহি (খুব চাপা সুরে)।
: চুপ চুপ! শুনতে পাবে। খিকখিক (আরো চাপা সুরে)।
রীনা দাস (নীলাঞ্জনা)
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
-
গল্প//উপন্যাস
-
16-07-2020
-
-