ঝড়ের রাত - রেজওয়ান আহমেদ
এ কালের বাচ্চাগুলোর প্রসঙ্গে 'বাচ্চা ভয়ঙ্কর কাচ্চা ভয়ঙ্কর' বাক্যাংশটি খুব মানানসই। অবশ্য আমারটি তেমন নয়। ও সবার থেকে একটু আলাদা হয়েছে। কেমন গম্ভীর গম্ভীর। এ ছেলে মহাজ্ঞানী দেবশিশু না হয়েই যায় না। আবার আজকাল কীসব বিজ্ঞানঘেঁষা কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে বসে - এটা কী? সেটা কেন? ওটা কোথায়? - আমি লাজওয়াব হয়ে শূন্যদৃষ্টিতে তাকালে আমাকে অপমান করতে ছাড়ে না - তুমি ছাই প্রফেসর, কিচ্ছুটি জান না! আচ্ছা, তোমাকে কি লোকে চেহারা দেখে বেতন দেয় বাবা?! সত্যিই ত, আমি সুদর্শন, তাই বোধহয় এতগুলো টাকা মাইনে আমার। সপ্তায় দুদিন ছেলের আমার বিজ্ঞানচক্ষু খুলে দেয় গোপাল ভাঁড় সিরিয়ালের বিজ্ঞানী মহাশয়, আর রোজ আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়ে আমাকে উদ্ধার করে আমার পুত্র মহাশয়।
আমাদের পুরুষানুক্রমে বাংলাদেশে থাকার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ পাঠবৈদগ্ধ্যের অব্যর্থ নিশানায় কলেজ স্ট্রিটের আরশিপড়শি খুব করে নিজের মনে হয়। পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসি সিটি অব জয় - কলকাতা! এম.ফিল. করতে ভর্তি হই রবীন্দ্রভারতীতে। প্রথম প্রথম যে শুনেছে সে-ই ছি ছি করেছে। প্রিমেডিটেশন বাঙালির স্বভাব। কলকাতায় চলে আসা মানেই নাকি হিন্দুত্ববাদ গ্রহণ করা - এইসব সেকেলে বয়ান। আজকাল সেসব গম্ভীরদর্শন সমাজতত্ত্ববিদ দৃশ্যপটের আড়ালে। বুঝেছে - একে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। দৃশ্যপটের সবটা জুড়েই এখন উপন্যাস - আমার ছেলে। কলকাতায় এসে আমাদের লাভক্ষতি কী হয়েছে জানি না। তবে ছেলেকে একটা যন্ত্রণা থেকে আগাম মুক্তি দিয়ে পেটে পেটে বর্ডার ক্রস করিয়েছে ওর মা। উপন্যাসকে ওর নাম নিয়ে এখানে কেউ বিরক্ত করে না - না বুড়োরা, না গুড়োরা। নইলে আমার যে ছেলে, ঘরের বাইরেই নামতে চাইত না। কারোর সঙ্গে ঝগড়া করতে ওকে বারণ করে দিয়েছি। যত কথাযুদ্ধ ওর আমার সাথে। কালও কথাযুদ্ধ হয়েছে।
আমাদের জানালাটা পশ্চিমমুখী। পশ্চিমের সবটা বাতাস বোধকরি আমাদের ঘরময় লুকোচুরি খেলতে ঢুকতে উদ্যত ছিল কাল। চারপাশ অন্ধকার করে শো শো বাতাস বইছে। আমাদের থাইগ্লাস না হলে জানালার কপাটগুলো নিয়ে ত্রাহি মধুসূদন দশা হতো। দৃষ্টিসীমায় দুটো বাড়িতে দুই গৃহকর্তা রীতিমতো যুদ্ধ করছেন বাতাসের সাথে। আমি আর বেগম মুঠোফোনের আলোয় সব দেখছি। উপন্যাস পাশেই গভীর ঘুমে। গভীর থেকে গভীরতর আওয়াজে বাতাস বাড়ছে। বাড়ছে সিগন্যালও। বাংলাদেশের পায়রার উপকূলের কী বৃত্তান্ত - জানার কোনো সুযোগ নেই। পুরিতে নাকি ১১ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। পুরনো কলকাতার তস্যগলির অট্টালিকার সমারোহে যে বাতাস এতটা আন্দোলনে মুখর, সে না জানি খোলামেলা পুরিকে কতখানি বীভৎস করে তোলে ধমকের দমকে! এর মধ্যে শিলাবৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। আমরা অকুতোভয়। জানালা খোলা রেখেই দেখে চলেছি কাণ্ড। শেষমেশ ঈশ্বর মুখ তুলে চাইলেন। একখানি শুভ্র প্রস্তরবৎ কিছু নিক্ষেপ করে মৃদু হাসলেন। সেই মৃদুহাসিতে পাথর জল হয়ে পড়ল। পড়বি ত পড় এক্কেবারে উপন্যাসের ডানপায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে ফোটায় ফোটায়। ঘুমিয়ে কাদা হয়ে থাকা ছেলে আমার এক ঝটকায় উঠে বসল। সে ও আমাদের সাথে বসে কাণ্ড দেখবে। ততক্ষণে গ্লাস আটকে দিয়েছি। বেগমকে পাঠালাম কফি আনতে। উপন্যাস গ্লাস টেনে খুলে দিল। সে আকাশ না দেখে কফি খেতে পারে না। ছ'বছর না হতেই এত পরিণত ফিলিংস উপন্যাসের পক্ষেই হয়তো সম্ভব। গল্পের গাঁথুনি তার অল্প বয়সেই ফুটে উঠেছে। নামকরণ সার্থক।
অমাবস্যা। এ রাতে চাঁদের হাসিতে বান ডাকা মানা। কিন্তু ছেলের আমার প্রশ্নের বাণ কে ঠেকাবে?
- বাবা!
- হ্যাঁ বাবা?!
- আকাশ কালো কেন?!
- অমাবস্যা তাই।
- অমাবস্যা কী?!
- একটা তিথি বাবা।
- তিথি কে?! জান বাবা আমাদের ক্লাসে একটা তিথি আছে তিথি পোদ্দার। অমাবস্যা কি তিথি পোদ্দার?!
- জানি না।
- তুমি ত কিচ্ছুটি জান না বাবা!
- তুমি সব জান!
- না, আমি তোমার কাছে জানি।
- আচ্ছা!
- শোন না বাবা!
- বল!
- আমি চাঁদের বুড়ি দেখব!
- আজ ত চাঁদ নেই বাবা!
- কেন নেই?!
- অমাবস্যা তিথি যে!
- তাহলে তিথিকে আমি অমাবস্যা তিথি ডাকব!
- না, পূর্ণিমা তিথি ডেকো।
- কেন?!
- মেয়েরা অমাবস্যা হতে পছন্দ করে না।
- কেন?!
- বুঝবে না এখন।
- কখন?!
- শোন, পূর্ণিমা আর অমাবস্যা - দুই তিথি। পূর্ণিমা তিথিতেই শুধু চাঁদ দেখা যায়।
- ও।
সুবিধা করতে না পেরে দমে গেল উপন্যাস। ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। অনলাইনে ঢুকে প্রথমেই বাংলাদেশের খবর নেয়ার চেষ্টা করলাম - ক্ষয়ক্ষতির যা আশঙ্কা সব ফসলেরই। প্রাণনাশ হওয়ার খবর পাওয়া গেল না। অবশ্য যার পিতৃভূমির সবাই কৃষিজীবী, ফসলের ক্ষতির খবর তার জন্য প্রাণনাশের খবরের চেয়ে কম বেদনার কিছু নয়।
ঝড়বাদলের রাতে ভালো ঘুম হয়। বেগম ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আজ আমি নির্ঘুম থাকব। আর দু'কাপ কফি ঢালতে ঢালতে উপন্যাসকে ডাকলাম। ওকেও খাওয়াব। মাঝেমধ্যে নির্ঘুম রাত কাটাতেও পুত্রনির্ভর পিতা হতে হয়।
রেজওয়ান আহমেদ
শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
-
গল্প//উপন্যাস
-
07-07-2020
-
-