রাধারানীর বঁটি - রীনা দাস
মাঝরাতে যখন বিছানায় শুতে আসে তন্দ্রা, হাত পা গুলো যেন খুলে আসতে চায়। একবার তাকিয়ে দেখে, একপাশে সুমন ঘুমুচ্ছে বেহুঁশ। দেখে মায়া হয়। সারাদিন অফিস করে। তারপর ক্লাবে যায় তাস খেলতে। বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে আর জেগে থাকতে পারে না। তলিয়ে যায় ঘুমে। সকালে আবার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। ন'টায় হাজিরা। এই চলে সোম থেকে শুক্কুর। শুধু শনি রবি রুটিনের বাইরে। এ দুটো দিন কোথাও যায় না সুমন। শনিবারের রাত আর রবিবারের দুপুর, একদম সজাগ হয়ে, ঘাপটি মেরে বসে থাকে জেগে। তন্দ্রা ঘরে এলেই বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপরে। তখন কে বলবে, এই লোকটাই সেই লোকটা। অমন নির্বিরোধী, শান্ত শিষ্ট মানুষটা তখন বাঘ হয়ে যায়, বন্ধ ঘরের আড়ালে। চিবিয়ে চুষে ছিঁড়ে খুঁড়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খায় তন্দ্রাকে। হয়ত এটাই ভালবাসা, ভাবে তন্দ্রা। আহা, মানুষটা কেমন বুঁদ হয়ে যায় তাকে নিয়ে খানিকক্ষণ এর জন্যে। ভালবাসা নয়? খালি হপ্তার অন্য দিন গুলো........ একটা শ্বাস ফেলে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে তন্দ্রা। কাল আবার ভোরে উঠতে হবে।
*
সুমনের সংসারে এসেছে তন্দ্রা দু বছর হল। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। লেখাপড়াও সাধারণ। শুধু ছিল রূপ। দেখে শুনে বিয়ে। এই বনেদী বড়লোকের ঘরে বিয়ে হবে, স্বপ্নেও কেউ ভাবে নি। কোন এক বড়লোক আত্মীয়ের বিয়ে বাড়িতে তন্দ্রাকে দেখে সুমন। দেখে একেবারে পাগল হয়ে যায়। নিজেই এসে যেচে আলাপ করে ছিল। সুপুরুষ, মিষ্টভাষী সুমনকে ভালই লেগেছিল তার। তবে তার রূপ দেখে কত ছেলেই তো আলাপ করতে চায়। কিন্তু তাদের চোখ দেখে তন্দ্রা বুঝতে পারে, শুধু শরীর আর শরীর। মন নেই সেই দৃষ্টির আড়ালে। গরীব ঘরের সুন্দরী মেয়েটাকে কি করে বিছানায় তোলা যায়, সেই ধান্দা। সাবধানে থাকে তন্দ্রা। নিজেকে উদাসীনতার মোড়কে মুড়ে রাখে। এক্ষেত্রেও তাই রেখেছিল। সুমনের সঙ্গে দু একটা কথা বলেই, আড়ালে সরে এসেছিল। ভুলেও গেছিল কদিন পরে। তাই এক মাসের মাথায় যখন সম্বন্ধ এল সুমনের বাড়ি থেকে, তার বাবার কাছে, খুব চমকে গেছিল তন্দ্রা। আর ডুবে গেছিল ভাল লাগায়। হয়ত সেটাকেই ভালবাসা ভেবেছিল। কে জানে। যাই হোক, দাবী দাওয়া ছিল না কিছুই। তারা নাকি কম বয়েসী সুন্দরী মেয়ে খুঁজছিল। তন্দ্রার বাবা যেন হাতে চাঁদ পেল। ছেলে দেখতে সুন্দর, শিক্ষিত। হাতে অত কাঁচা পয়সা, অথচ মদ ভাঙ খায় না। ব্যবহারটাও ভাল। বনেদী পরিবার। আর কি চাই। হয়ে গেল বিয়েটা।
*
বাড়িটা বিশাল। পরিবারটাও। এখন শরিকে শরিকে ভাগ হয়ে গেছে। তবে ঝগড়া অশান্তি নেই। সবাই বেশ মিলজুল করেই থাকে। একটু আধটু রেষারেষি, মন কষাকষি হয়ত..........সে আর কোন সংসারে থাকে না। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনীয়ার, কেউবা সুমনদের মত ব্যবসাদার। তবে মানুষ গুলো পুরনোকে আঁকড়ে ধরে নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টেছে নিজেদেরকে। বেশ আধুনিক স্বচ্ছল জীবন যাত্রা সকলের। সুমনদের পরিবারটা মাঝারি। শ্বশুর, শাশুড়ি, কলেজে পড়া দেওর আর ইস্কুলে পড়া ননদ। সুমন বড়। ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা এদের। শ্বশুর মশায়ের বয়েস হয়ে যেতে, একা আর পারেন না। সুমনও ঢুকেছে এই ব্যবসাতে। তবে কিছুদিন যেতে, তন্দ্রা তার মোটা বুদ্ধিতেও বুঝেছে, সুমনের অবস্থা ওই কর্মচারীর চেয়ে একটু বেশি আর কি। ক্ষমতা সব শ্বশুর মশায়ের হাতে। আর সংসারটা শাশুড়ির। তবে তার সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করে না। গরীবের মেয়ে বলে খোঁটাও কেউ দেয় না। ঝি, রাঁধুনী, ড্রাইভার নির্ভর সংসার। ফ্রীজ, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রো ওভেন, ইনডাকশন হীটার থেকে শুরু করে গ্যাজেটে গ্যাজেটে ছয়লাপ। যে যার নিজের মত থাকে। কাজের লোক একদিন না এলে, চোখে অন্ধকার দেখে সবাই। যন্ত্রপাতি খারাপ হলে মাথাও যেন খারাপ হয়ে যায় এদের। প্রথমটা বেশ হকচকিয়ে গেছিল তন্দ্রা। এসব জিনিস বাপের জন্মে ব্যবহার করে নি। পরে আস্তে আস্তে সামলে নিলেও, কেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। সমস্যা হল বিয়ের তিন মাসের মাথায়। রাঁধুনী অসুস্থ হয়ে দেশে চলে গেল। বদলি লোকও দিয়ে গেল না। আজকের দিনে মনের মত কাজের লোক পাওয়া ভগবানকে পাওয়ার মত। দু একজন এল গেল কিন্তু টিঁকলো না। কেউ নোংরা, কেউ চোর, কেউ চুকলিখোর। শেষে অশান্তি যখন চরমে উঠেছে, তন্দ্রাই নিজে যেচে রান্নার দায়টা নিল আপাততঃ, যদ্দিন না মনের মত লোক পাওয়া যায়। সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আর রান্নাঘরে ঢুকে তন্দ্রা পড়ল আতান্তরে। এ সব কাটিং মেশিন, চপিং মেশিন, কিচেন ওয়্যার নিয়ে থতমত খেয়ে যায়। বাপের বাড়ির সাঁড়াশি বঁটি খুন্তি হাতার ট্রেনিং কোন কাজে লাগছে না। এখানে, ছুরি দিয়ে ব্ল্যাকস্টোনের ওপরে সব্জী কাটা, পিলিং নাইফে খোসা ছাড়ান অসহ্য লাগে তন্দ্রার। ছুরিতে আঙ্গুল কেটে যায়। অর্ধেক আলু পটল চলে যায় খোসার সঙ্গে। এদিকে একা হাতে কুটে বেঁটে সময়ের মধ্যে ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ টিফিন তৈরী করা, কি যে কঠিন, তা বুঝতে পারে। বেশ সুনামই ছিল তার এসব কাজে বাপের বাড়িতে। এখন রাগে দুঃখে চোখে জল এসে যায়। একটা বঁটি নেই গো কোথাও!
:- মা, একটা বঁটি পাওয়া যাবে? কাজের বড় সুবিধা হত।
শেষে একদিন থাকতে না পেরে বলে শাশুড়িকে।
: বঁটি? এ বাড়িতে কেউ তো বঁটি ব্যবহার করে না।
: আনিয়ে দেবেন বাজার থেকে?
: বেশ তো। সে দেওয়া যাবেখন।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। কাজের কাজ কিছু হল না। উল্টে পরের রবিবারে টেবিলে জলখাবার খেতে খেতে, এই নিয়ে, পাকাচুল, ববকাট চুল, স্টেপকাট চুল, সাইডে কামানো চুল আর ঢেউ খেলানো চুলে ভরা মাথা গুলো হেসে কুটিপাটি হতে লাগল। হাসতে হাসতে শ্বশুর মশাই হঠাৎ থমকে থেমে গেলেন। কি যেন ভাবছেন।
: বঁটি বোধহয় একখানা আছে এ বাড়িতে বৌমা। চিলেকোঠার ঘরে, একটা পুরনো ট্রাঙ্কের ভেতরে। খুব ছোটবেলায় ঠাকুমা বলেছিল মনে পড়ছে। তবে..........
: তবে কি বাবা?
: ওই বঁটির সঙ্গে একটা ভয়ঙ্কর গল্প জড়িয়ে আছে।
: কি কি? বল বল!
গল্পের গন্ধ পেয়ে সবাই উৎসুক।
: আমাদের এক পূর্ব পুরুষের বউ ছিলেন রাধারানী। মোটেই রাধারানীর মত দেখতে ছিলেন না। কালোকোলো মোটাসোটা, জাঁদরেল মহিলা। ড্যাবাড্যাবা চোখ, গালে মেছেতার দাগ। তবে দেখতে যেমনই হোক, নামডাক ছিল রাঁধিয়ে বলে। কুটনো কুটতেন, যেন শিল্পকর্ম। যজ্ঞিবাড়ি থেকে ডাক পড়ত তেনার। আর তিনিও হাজির হতেন নিজের বঁটি হাতে। খুব পেয়ারের ছিল বঁটিখানা। তা একবার কি কারনে রাগের মাথায় সেই বঁটি দিয়ে বাড়ি শুদ্ধু প্রায় সকলের গলা কেটে, গলায় দড়ি দেন তিনি। সেই থেকে সেই বঁটি চিলেকোঠার ঘরে। আমি দেখি নি চোখে। তবে গল্প শুনেছি।
: কি সাংঘাতিক!
বলে ওঠে সবাই। শুধু তন্দ্রা মনে মনে উঁচিয়ে থাকে। দেখতে হবে দুপুর বেলা। তার কোন কুসংস্কার নেই। ভয়ও নেই।
*
রঙ চটা জং ধরা পুরনো ট্রাঙ্কটার গায়ের বহুকালের ঝুল ময়লা পরিষ্কার করে, হাঁ করে তাকিয়ে ছিল তন্দ্রা। নির্জন শেষ দুপুর। ভাতঘুমে আচ্ছন্ন সারা বাড়ি। চিলেকোঠার ঘরে সে আর সেই প্রাচীন ট্রাঙ্ক। ডালাটা খুলতে চেষ্টা করে তন্দ্রা। পারে না। শক্ত হয়ে এঁটে আছে। ঠোকাঠুকি হাঁচোড় পাঁচোড় করে অবশেষে খোলে সেটাকে। একটা পুরনো ভ্যাপসা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরে। ওপরে কিছু পুরনো কাপড় চোপড়, আসন, কম্বল। সরাতে যেতেই গুঁড়িয়ে গেল তাদের বেশ কয়েকটা। ওপরটা খালি করতেই বেরোল কিছু পেতলের ঘটি বাটি গেলাস থালা। আর একপাশে রয়েছে সেই বঁটি। আছে আছে! সত্যিই আছে তাহলে। গল্প নয়। বঁটিটা হাতে তুলে নেয় তন্দ্রা। গা সিড়সিড় করে ওঠে। এই সেই রাধারানীর বঁটি। বাঁটটা পালিশ করা কাঠের। কব্জাটা পেতলের। মাঝারি মাপের ফলাটা টানতেই মসৃণ ভাবে খুলে এল। আলোয় ঝিকিয়ে উঠল ইস্পাত। হাতের মুঠোয় যেন কেঁপে উঠল বঁটিটা একবার। নাকি তন্দ্রাই কাঁপল।
: ধার পড়ে গেছে। শাণ দিতে হবে ভাল করে।
নির্জন ঘরে, আপন মনে বলে তন্দ্রা। নাকি অন্য কেউ।
: শাণওলাআআআ। কাটারী কাঁইচি ছুরি ধারওলাআআআআ। শাণওলা শাণওলাআআআআ।
দু দিন পরের এক সকালে হাঁক শুনে তাড়াতাড়ি দোতলার বারান্দায় বেরিয়ে আসে তন্দ্রা।
: ও শাণওলা, দাঁড়াও। আসছি।
বঁটি আর টাকা নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে যায় সে। লোকটাকে বঁটিটা দেয়। ধার দেবার আগে, সেটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে লোকটা।
: এ জিনিস কোথায় পেলেন মা? এ তো ফরমায়েস করে বানানো ইস্পেশাল বঁটি। সেগুন কাঠের বাঁট। বিলিতি ইস্পাতের ফলা। এরকম ইস্পাত এখন চোখেই দেখা যায় না।
: ছিল বাড়িতে। ভাল করে শাণ দিয়ে দাও। কত লাগবে?
: চিন্তা করবেন না মা। পুরোটায় এমন ধার তুলে দেব, আনাজ, মাছ, যা ঠেকাবেন, দেখতে না দেখতে দু খণ্ড হয়ে যাবে। ষাট টাকা দেবেন।
: অনেক বেশি বলছ। চল্লিশ দেব। করে দাও।
: বউনীর সময়। পঞ্চাশটা টাকা দিন মা।
রাজী হয়ে যায় তন্দ্রা। লোকটা কাজ শুরু করে। প্রায় দশ মিনিট ধরে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, এপিঠ ওপিঠ শাণায় ফলাটাকে। কিছুতেই যেন মনঃপুত হচ্ছিল না তার। অবশেষে ঠিক তার মনের মত হতে, বঁটিটা ফেরত দেয় তন্দ্রাকে।
: আগুনে ছুঁইয়ে, বেগুনের বোঁটায় করে একটু সরষের তেল মাখিয়ে নেবেন ফলাটায় আগে। যা ধার দিয়েছি, দেখবেন জীবন কেটে যাবে।
টাকাটা কপালে ছুঁইয়ে, চলে যেতে যেতে বলে যায় লোকটা। বঁটি হাতে ওপরে উঠে আসে তন্দ্রা। তারপর চমকে থেমে যায়। হাতের মধ্যে কি একবার কেঁপে উঠল বঁটিটা?
*
রান্নাঘরের মেঝেয় বঁটি পেতে কুটনো কোটে তন্দ্রা। ফলার সঙ্গে আঙ্গুলের প্রেম জমে ওঠে। আলুর খোসা ছাড়ে, যেন কাগজ। ঝিরঝির করে ঝরে পড়ে মিহি বাঁধাকপির কুচো। শিষপালং এর হাড়ের মত শক্ত গোড়া চেলিয়ে দু খণ্ড করে দেয় চোখের নিমেষে। বেগুনীর বেগুনের ফালি সব সমান। দুধের প্যাকেট থেকে পনীর, সব কিছুতেই বঁটি হাজির। নিজে নিজেই যেন কাজ করে বঁটিটা, মনে হয় তন্দ্রার। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে কাজ শেষ। তাই একটু দম ফেলার ফুরসত পায় তন্দ্রা। সেই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে মন দিয়ে রান্না করে। প্রথম প্রথম একটু ভয়, আপত্তি জানিয়ে ছিল সকলেই। এখন খাবার টেবিলে তোফা তোফা করে শ্বশুর শাশুড়ি দেওর ননদ। রান্নার অকুণ্ঠ প্রশংসায় বুক ভরে যায় তার। আর ছুটির দিনে সুমন এখন এক মনে খেয়ে যায়। একটু বেশিই খায় আজকাল। ভরপেটে আদরটাও তেমন করতে পারে না। তা হোক। তন্দ্রার অত সময় নেই এসব ভাববার মত।
এই করতে করতে দুটো বছর কোথায় কেটে গেছে। মনের মত রান্নার লোক আজও পাওয়া যায় নি। কেউ খুব একটা খোঁজও করে না বোধহয় আর। সেই ভোর থেকে তন্দ্রার কাজ শুরু। মর্নিং ওয়াকে যাবার আগে শ্বশুর মশায়ের চিনি ছাড়া পাতলা লিকার চা। একটু পরে সকলের বেড টি। তারপর ব্রেকফাস্ট। তারপর রান্নার যোগাড়। সুমনের লাঞ্চ রেডি করতে হয় সবার আগে। দেওর আর ননদের কলেজ ইস্কুলের ভাত। শেষে শ্বশুর শাশুড়ির মুখের মত দু একটা পদ, দুপুরের মেনু। ছুটির দিনে ফরমায়েসি রান্না। সন্ধের চা জলখাবার, রাতের রান্না। অবসর নেই, কোন অবসর নেই। তবে প্রথম চায়ে চুমুক দিয়ে শ্বশুর মশায়ের তৃপ্তির আহ্, খেতে বসে হুড়োহুড়ির মধ্যেও দেওর ননদের থামস্ আপ, অফিস বেরোবার আগে সুমনের আলতো চুমু, আত্মীয় স্বজনের কাছে শাশুড়ির, তার নামে ভূয়সী প্রশংসা, এগুলো যেন টনিকের মত কাজ করে। অতএব খাটে তন্দ্রা। তবু মাঝরাতে যখন বিছানায় শুতে আসে, হাত পা গুলো যেন খুলে আসতে চায়।
*
সে রাতেও পাশ ফিরে বেহুঁশ ঘুমোচ্ছিল সুমন। আলো নেভাবার আগে, ওর দিকে তাকায় তন্দ্রা। আজকাল আর তেমন পাগলামি করে না ও। হয়ত ব্যবহারে ব্যবহারে উন্মাদনা কমে গেছে। ভীষণ মায়ায় ঝুঁকে একটু আদর করতে যায় তন্দ্রা। আর তখনি সুমনের গলায় কালচে মত দাগটা নাইট ল্যাম্পের আলোয় আবছা চোখে পড়ে। ভাল করে দেখার জন্যে জোর আলোটা জ্বালে তন্দ্রা। কাছে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। চকোলেট রঙের লিপিস্টিকের দাগটা তাকে যেন ঠাট্টা করতে থাকে। খানিক পরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়ে তন্দ্রা। কাল আবার ভোরে উঠতে হবে। কিন্তু ঘুম আসে না কিছুতেই। খালি মনে হচ্ছিল, খুব উঁচু থেকে একটা অতল খাদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে সে। আরো কি কি হচ্ছিল, সে সব ঠিক ঠিক বুঝতে পারছিল না তন্দ্রা। শেষে বিছানা ছেড়ে ওঠে। তারপর অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। ডাইনিং এর আলোটা জ্বালে। বেসিনের আয়নায় নিজের মুখটা দেখে। তার অমন রঙ কবে এমন কালচে মেরে গেল? গরুর মত ভাবলেশ হীণ ড্যাবাড্যাবা দুটো চোখ। তলায় একপুরু কালি। আর ও কি! আরো একটু এগিয়ে যায় তন্দ্রা আয়নাটার দিকে। গালে হালকা বাদামী ছোপ, মেছেতার।
: ঠিক রাধারানীর মত।
বলে, দাগটায় আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে, আপন মনে হেসে ওঠে তন্দ্রা। তারপর পায়ে পায়ে এসে রান্নাঘরে ঢোকে। আলো জ্বালে। মেজে ধুয়ে গুছিয়ে রাখা বাসনপত্র ঝকঝক করে ওঠে। একপাশে রাখা বঁটিটা। হাতে তুলে নিয়ে ফলাটা খোলে তন্দ্রা। আলোয় ঝিকিয়ে ওঠে বিলিতি ইস্পাত। হাতের মুঠোয় জ্যান্ত প্রাণীর মত সড়সড় করে ওঠে বাঁটটা। ঘুরে দাঁড়ায় তন্দ্রা। হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা, রাধারানীর বঁটি।(সমাপ্ত)
রীনা দাস (নীলাঞ্জনা)
74/6, গোস্বামী পাড়া রোড
পোঃ-বালী, জেলা-হাওড়া, পঃ বঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
06-07-2020
-
-