অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
প্রপোজ ডে এবং একটা শাড়ির গল্প - রফিকুল নাজিম

     মিথিলা এখনো কাঁদছে। রাত থেকে সে একই গতিতে কেঁদে চলেছে।  অফিসে জরুরি মিটিং থাকায় আরাফকে বের হতেই হলো। বিয়ের পর এই প্রথম আরাফ নাস্তা না সেরে বাসা থেকে আজ বের হয়েছে। মিথিলা এখনো কাঁদছে। আপাততঃ মনে হচ্ছে এই কান্না ম্যারাথন টাইপ। আরাফ এই কান্নার রহস্য উন্মোচনের জন্য সেই রাত থেকে চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে এই ম্যারাথন কান্নার দূরত্ব মাপতে। কিন্তু সে পুরোপুরি ব্যর্থ! অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বাসা থেকে বের হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। যাবার সময় সে মিথিলাকে দরোজা আটকাতে বলে গেছে। কিন্তু বিছানায় বসে বসে এখনো মিথিলা কেঁদেই চলেছে।
     সদর দরোজা খোলা দেখে রহিমা বিবি কটকট করতে করতে মিথিলার বেড রুমে সরাসরি ঢুকে গেলো। মিথিলাকে কাঁদতে দেখে রহিমা বিবি হা করে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাসায় সে দশ মাস তেইশ দিন ধরে আছে। কখনো মিথিলা ও আরাফের মধ্যে ঝগড়ার 'ঝ'ও সে দেখেনি। অথচ আজ তার আপামনি কিভাবে ঠুকরে ঠুকরে কাঁদছে! একটু দম নিয়েই রহিমা শুরু করলো, 
- আফা গো, এই পুরুষ মাইনসের জাতটাঐ খারাপ। বিয়ার আগে কত্তো মিঠা মিঠা কতা কয়। যহোন বিছানাত পাইয়া যায় গো আফা- তহোন নারীর মিঠা চিনিও হেগো কাছে নুনের মত তিতা লাগে! আমার রতনের বাপেও বিয়ার আগে আমারে লইয়া কত্তো জাগাত গেছে। এই ধরেন সিনামা হলে, ফুচকা খাইতে, লাল চুড়ি কিইন্না দিতে। আর বিয়ার পর এহোন আমারে আরে ঠারে কতা কয়। সুমোয় সুমোয় যেই মাইরটাঐ না মারেও গো,আফা। পুরুষ মানুষ হারামিরজাত। একেকটা পাক্কা শয়তান।
     রহিমার কথাগুলো মিথিলার কানে বিষের মত লাগছে। তাই সে তার দুই হাঁটুর মাঝখান থেকে মাথাটা তুলে রহিমা বিবিকে কষিয়ে একটা ধমক দেয়। রহিমা বিবি হঠাৎ ভূত দেখার মতই লাফিয়ে উঠে এবং বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরের দিকে দ্রুত হেঁটে যায়। রহিমা বিবি কথা একটু  বেশি বলে। তবে সে যা বলেছে একদম কড়ায়গণ্ডায় সত্যি। মিথিলাও তার কথায় মোটামুটি একমত। রহিমা বিবির কথাগুলো মিথিলার কানে বারবার অনুরণিত হচ্ছে। আর আরাফের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভের পারদটা তরতর করে ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে। 
     আরাফ অফিস গিয়ে কয়েকবার কল করেছে। কিন্তু মিথিলা মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল কেটে দিয়েছে। মিথিলার মনে পড়ছে-কার মুখে যেন শুনেছে 'অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ!' কথাটা একদম খাঁটি। গতরাতে যদি মিথিলা নিজ চোখে না দেখতো, তাহলে সারাজীবনেও আরাফকে চিনতে পারতো না। আরাফ এতোটা নীচ! দৃশ্যটা মনে আসতেই মিথিলার গা রি রি করে উঠছে। ছিঃ ছিঃ এই না হলে পুরুষ মানুষ! এক নারীকে বুকে নিয়ে শুয়ে থেকে আরেক নারীকে কল্পনা করে! লোক দেখানো ভালোবাসার কারণ তো তাহলে এটাই। নিজের ইবলিশ রূপটাকে আড়াল করে রাখার জন্যই আরাফ বেশি বেশি ভালোবাসার অভিনয় করে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মিথিলা আরো দ্বিগুণ গতিতে-শব্দে কাঁদতে শুরু করেছে। কাঁদতে কাঁদতে মিথিলা তার মাকে বিকেলে এসে তাকে নিয়ে যেতে বলেছে।
     কলিংবেল বাজছে। কলিংবেল বাজতেই রান্নাঘর থেকে রহিমা বিবি দৌঁড়ে গিয়ে দরোজা খুলে দেয়। একজন লোক একটা পার্সেল তার হাতে দিয়েই চলে গেলো। মিথিলার ঘরে পার্সেলটা রহিমা বিবি রাখতে গেলো। 
-আফা, আর কাইন্দেইন না তো। একদিনেঐ যদি এতো বেশি কাঁইন্দালাইলে পরে আরো কেমনে কাঁনবেন? তার উপ্রে বেশি কাঁনলে নাকি চক্ষু কানা অইয়া যায়গা। পরে কিন্তু আর দুইন্নাইডা দেখতেন পারতেন না। ও আফা, আপনের এই বকশোটা আইছে। এইযে এইহানে রাখলাম।
     মিথিলার চোখমুখ ফুলে গেছে। সে মুখ তোলে কটমট করে রহিমার দিকে তাকিয়ে আবার আগের চেয়ে দশ ডেসিবল জোরে ধমক দেয়। আকস্মিক ধমকে আবারো আঁতকে উঠে রহিমা। বাক্সটা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে মিথিলার রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
     আরাফ বাসায় ফিরে এসে মিথিলাকে আগের মতই দেখতে পায়। এখনো কাঁদছে মিথিলা। তবে কান্নার গতি কিছুটা কম। জল পড়ার গতিতেও ভাটা এসেছে বোধ হয়। যাই হোক। আরাফ নিজে শাওয়ার শেষ করে ড্রয়িং রুমে কিছু একটা করছে। সাথে হাত লাগিয়েছে গাড়ির ড্রাইভার রুবেল। রহিমা বিবিও টুকটাক জিনিসপত্র এগিয়ে দিচ্ছে। ড্রয়িংরুমের কাজ শেষ করে আরাফ রুমে গিয়ে মিথিলার পাশে গিয়ে বসলো। মিথিলার মাথায় হাত রাখতেই সে হাত সরিয়ে দেয়। আবারো মিথিলার মাথায় হাত রাখে আরাফ। কিন্তু বরাবরের মতই মিথিলা সরিয়ে দেয়। উজানের ঢল নামে চোখে। এবার আরাফ মিথিলাকে জাপটে ধরে। 
- কেন এমন পাগলামী করছো, মিথি? কি হয়েছে বলো, প্লিজ। তোমার চোখের জল আমাকে তো অপরাধী করে দিচ্ছে। 
- ‎ওহ, অপরাধী লাগছে বলছো! তুমি তো প্রতারক। তুমি আমাকে ঠকাচ্ছো,আরাফ। তুমি আমার সরল বিশ্বাসের সাথে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করছো।
- ‎কি আবাল তাবোল বকছো! তুমি ঠিক আছো তো, সোনা!
- ‎ও এখন তো আমি আবোলতাবোল বলবোই! আমি তো পাগল।
- সোনা, কে বলেছে তুমি পাগল? পাগল আমি। পাগল তো আমার চৌদ্দগুষ্টি। এখন বলো, প্লিজ। কি হয়েছে তোমার, কেন এভাবে কাঁদছো?
- ‎গতরাতে আমি নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। তুমি আমার সাথে শুয়ে আরেকটা মেয়ের সাথে.....!  ছিঃ ছিঃ আরাফ!
- আরেকটা মেয়ে মানে! কি বাজে বকছো, মিথিলা। 
- ‎কেন!  অবাক হচ্ছো। তুমি ধরা পড়ে গেছো, আরাফ। লুকিয়ে লুকিয়ে সারারাত তুমি মোবাইলে সেই মডেল মার্কা মেয়ের ছবি দেখোনি? কত রঙের শাড়ি পরা ছবি! ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখছিলে তুমি। ছিঃ ছিঃ তুমি এতোটা জঘন্য! 
      আরাফ হাসছে। হাসতে হাসতে মিথিলার বুকে শুয়ে পড়ছে বারবার। মিথিলা কিছু বুঝতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আরাফের বিদঘুটে হাসি সহ্য করছে। কিছুটা সময় নিয়ে আরাফ মিথিলাকে মোবাইলে রাখা সেই মেয়ের ছবিগুলো ভালো করে দেখায়। ঝড় কিছুটা গতি হারায়। এই মহাদুর্যোগেও মোবাইলে সংরক্ষিত ছবিগুলোই সুন্দরবনের মত বুক পেতে দাঁড়ায়। 
- মিথি, তোমার মনে আছে আজ কত তারিখ? আজ আমাদের প্রপোজ ডে। এইদিন তুমি আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিলে। আমার মত চালচুলোহীন একটা ছেলেকে। তাই দিনটাকে সেলিব্রেট করার জন্য অনলাইনে ঢুঁ মারছিলাম। অবশেষে একটা বুটিক হাউজে তোমার জন্য একটা শাড়ি অর্ডার করলাম। আর ঐ বুটিক হাউজের সব শাড়ির মডেল ঐ একটা মেয়েই!
     দুই পাটি দাঁতের মাঝখানে জিহ্বা রেখে মিথিলা বললো,
-'সরি, বাবুটা। সারাদিন কিছু খাওনি? মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে আমার বাবুটার! আচ্ছা, দুই মিনিট বসো আমি মুখে পানি দিয়ে আসি। আমারও খুব খিদে পেয়েছে।
     আরাফের বুকে মাথা রেখে মিথিলা রুম থেকে বের হয়ে আসে। রান্নাঘর থেকে হা করে তাকিয়ে আছে রহিমা বিবি। বিড়বিড় করে কিছু একটা যেন সে বলছে! কিন্তু কথাগুলো অস্পষ্ট। ড্রয়িংরুমে গিয়ে মিথিলা তো পুরো তাজ্জব বনে গেলো। কেক, ফুল, বেলুন, রিবন দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে রুমটা। উৎসবের আবহটা ঘরে তুলে এনেছে আরাফ। আরাফ পার্সেলের বক্সটা খুলে দেয় মিথিলাকে। চমৎকার একটা শাড়ি। হ্যাঁ রাতের ঐ মেয়েটাই তো শাড়ির প্যাকেটের গায়েরও মডেল। মিথিলা লজ্জায় মুখ গুঁজে দেয় আরাফের বুকে।
-তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো কেন, রাতিনের বাপ! আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি!

     মিথিলাদের দরোজায় ক্রমাগত কলিংবেল বেজেই যাচ্ছে। আমি শিওর-মিথিলার মা এসেছেন।

রফিকুল নাজিম
পলাশ, নরসিংদী।