অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
মিথ্যে স্বপ্ন - মুহিব্বুল্লাহ কাফি

ই মামা থাম থাম। এখানেই নামিয়ে দাও।
- তোমার ভাড়া কত?
- তিরিশ ট্যাহা।
- এত কেন? এখানে বিশ টাকা দিয়েই তো আসি।
- হ মামা। বিশ ট্যাহাই।
- তাহলে ত্রিশ কেন চাচ্ছ?
- মামা আজ ঈদ না! তাই একটু বেশি ছাইলাম।

শান্ত মুচকি হেসে ত্রিশ টাকাই দেয়। রিকশাওয়ালা ত্রিশ টাকা পেয়ে বিশ্বজয় করা এক মিষ্টি হাসির আভাস ছুড়ে শান্তর দিকে। মামা ঈদ মোবারক বলে রিকশাওয়ালা চলে যাওয়ায় শান্ত দৌড়ে ওঠে পাশে থাকা ফুলের দোকানে।
     কিরে আছিস কেমন বলে ফুল কাটায় ব্যস্ত তুহিনের পিঠচাপড়ায় শান্ত।
     শান্তের আকস্মিক এ আগমনে আঁতকে ওঠে তুহিন। এক দলা থুথু নিক্ষেপ করে বুকে।
শান্ত ভাই এভাবে কেউ আসে, হন্তদন্ত হয়ে বলে তুহিন।
     আজ যে বিশেষদিন। তাই তোকে একটু ভয় দিলাম।
     তা ভাই আজও গোলাপ কিনবেন?
     হু। আজ তোর সব গোলাপ নিয়ে যাব। তুহিনের মাথার চুল নেড়ে দিয়ে বলে শান্ত। আজ ঈদ বলে কথা।
     আচ্ছা শান্ত ভাই আপনি যে প্রতিদিন একটা করে গোলাপ নিয়ে যান ভাবির জন্য কিন্তু ভাবি তো...। 
     তোকে তো আগেও বলেছি এ ব্যপারে কথা বলবি না। তুহিনকে থামিয়ে দিয়ে গর্জে ওঠে শান্ত।

শান্ত আর ফারিহা দীর্ঘদিন প্রেম করে তিনমাস হল বিয়ে করেছে। শান্তদের বাসা থেকে ফারিহাদের বাসা চল্লিশ টাকা রিকশা ভাড়া। এর মাঝে তুহিনদের ফুলের দোকান। কখনো শান্ত গোলাপ কিনত ফারিহার জন্য। কখনো ফারিহা কিনত শান্তর জন্যে। কখনো দুজন একসঙ্গে গোলাপ কিনত। সাদা গোলাপ। তুহিনের দোকান থেকে। কখনো পাশের টং দোকান থেকে চা এনে তুহিনকে নিয়ে খেত শান্ত ফারিহা। আড্ডা হত। তুহিন ফুল বিক্রেতা হয়েও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে বলে ফারিহা ওকে মিষ্টভাষী বলে ডাকত। আবার মাঝে মধ্যে ছোট ভাই সম্মোধন করত। এ সুবাদে শান্ত ফারিহার সঙ্গে তুহিনের ভালো একটা পরিচিতি গড়ে ওঠে। এমনকি শান্ত ফারিহা তাদের বিবাহের কার্ড তুহিনকেই প্রথম দেয়।

     আজ ঈদের দিন শুধু শুধু আপনাকে রাগিয়ে দিলাম শান্ত ভাই। বিরাট অপরাধ করা আসামির সুরে বলল তুহিন।
     রাগ ঝেড়ে স্বাভাবিক হয়ে তুহিনের মাথায় হাত দেয় শান্ত। আরে না.... রাগ করিনি। কিন্তু তুই আর কোনোদিন এসব কথ বলবি না।
     মাথা নাড়ায় তুহিন। বাঁদিকে হাত তুলে বলে, আজ এ সবগুলো তাজা গোলাপ। সাদা গোলাপ। দাম কিন্তু একটু বেশি দিবেন। আজ যে ঈদ। শান্তর দিকে মুচকি হেসে বলে তুহিন।
     হুম, আজ তোকে ডাবল দাম দেব। দে ওখান থেকে কিছু সাদা গোলাপ দে।

দুই
শান্ত প্রতিদিন ফারিহার জন্য গোলাপ নিয়ে যায়। কিন্তু ফারিহা শান্তর সঙ্গে কথা বলে না। ফিরিয়ে দেয় প্রতিদিনই। শান্ত কাঁদে। তবু ফারিহা নিশ্চুপ থাকে। প্রতিদিন ব্যর্থ হয়েই ফিরে আসে শান্ত। 
     কিন্তু শান্ত আজ একটু উৎফুল্ল এ ভেবে যে, আজ ঈদের দিন। হয়ত আজ ফারিহা তাকে ফিরিয়ে দেবে না। আজ কথা না বলে থাকতেই পারে না ফারিহা। আজ তার ডাকে সাড়া দেবেই।

     এসব ভেবে রিকশায় চেপে বসে শান্ত। আজিমপুর চলো। রিকশাওয়ালা আদেশ পেয়ে রিকশা ছুটায় আজিমপুরের দিকে। শান্ত সাদা গোলাপের দিকে তাকিয়ে দুফোঁটা পানি ফেলে চোখ থেকে। ওর মনে ওঠে সেই রাতের কথা। যে রাতে সাদা গোলাপ আননেনি বলে ফারিহা তাকে ঘরে ঢুকতেই দেয়নি।
     সেদিন ফারিহার জন্মদিনে ছিল। শান্ত তাকে কিছু দিক বা না দিক সাদা গোলাপ দিতেই হবে। না হয় শান্তর গোবেচারার মতন হাল হয়ে যায় ফারিহার অভিমান ভাঙাতে। অফিস শেষ করতে করতে রাত দশটা বেজে যায়। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে শান্ত ফারিহার কাছে। অফিসের চাপে ও তাড়াহুড়ায় ফারিহার জন্মদিনের কথা মনে থাকলেও মনে নেই সাদা গোলাপ আনতে। সেদিন শান্ত চকলেট কেক পুতুল চুড়ি আরো কতকিছুই না কিনে ছিল। বাসায় যেই ঢুকতে যাবে ফারিহা বলে উঠলো, আজ আমার মনটা ভালো। তাই তোমার দেড়ি করাতে আজ আমি কিছু বলব না। রুমে আসার আগে আমার জন্মদিনের উপহার দাও। মুচকি হেসে হাত বাড়ায় শান্তর দিকে।
     এ দেখ তোমার জন্য কতকি এনেছি। উপহার গুলো দেখিয়ে সাদা গোলাপের কথা এড়াতে চায় শান্ত। আর মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করতে ছিল ফারিহা যেন সাদা গোলাপের কথা ভুলে যায়।
     আমার সাদা গোলাপ কোথায়? ফোঁসে ওঠে ফারিহা। আনোনি তাই তো!
     বিশ্বাস করো আমি এগুলো কিনতে গিয়ে সাদা গোলাপের কথা ভুলেই গেছি। উপহার গুলো দেখিয়ে বলে শান্ত। আর এতো রাতে.....
     শান্ত কথা শেষ করার আগেই মুখের ওপর জোরের সাথে দরজা লাগিয়ে দেয় রেগে থাকা ফারিহা। সেই রাতে তিনঘণ্টা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল শান্ত। শুধু একটি সাদা গোলাপ না আনার অপরাধে।

পরদিন শান্ত তুহিনদের দোকানে নিয়ে যায় ফারিহাকে। ফারিহাকে দেখে হাতের কাজ রেখে সামনে আগায় তুহিন। ভাবি কেমন আছেন বলে তুহিন টেবিল মুছে শান্ত ও ফারিহাকে বসতে বলে।
     আমি ভালো আছি। তুমি আছ কেমন? বসতে বসতে বলে ফারিহা। 
     জি, আমি ভালো আছি। কিন্তু আজ আপনাকে একটু রাগি রাগি দেখাচ্ছে। শান্ত ভাইয়ের সঙ্গে কি ঝগড়া হয়ছে। পাশে দাঁড়িয়ে শান্তর দিকে ভ্রু কুঁচকে বলে তুহিন।
     এত কথা কেন বলিস। তোর ভাবিকে সাদা গোলাপ দে। কাল তার তার জন্মদিন গেছে। ফারিহার থেকে চোখ সড়িয়ে নিয়ে পাশে সাজানো সাদা গোলাপের দিকে তাকিয়ে বলে শান্ত।
     ভাবি আপনার জন্মদিনের উপহার হিসেবে আমি আপনাকে সাদা গোলাপ দিতে চাই। টাকা নিব না কিন্তু। তুহিন জানে ফারিহা ন্যায্য দামের চেয়ে সবসময় একটু বেশি দাম দেয়। তাই আগেভাগে টাকা নাকচ করে দিল তুহিন।
     মুচকি হেসে তুহিনের মাথায় হাত নাড়ায় ফারিহা। আচ্ছা ঠিক আছে। দেব না। তুমি আজ জেনে তবুও তো দিতে চেয়েছ কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা জেনেও দেয় না। ফারিহা আড়চোখে তাকায় শান্তর দিকে।
     শান্ত মাথা নিচু করে লজ্জা সুলভ হাসি হাসে।

মামা আজিমপুর এসে গেছি নামেন। রিকশাওয়ালার আওয়াজে ঘোর ভাঙে শান্তর। ভাড়া মিটিয়ে আজিমপুর কবরস্থানের দিকে পা বাড়ায় শান্ত। তার চেহারায় খুশির বাতাস খেলে যায় এভেবে যে, যে ফারিহা সাদা গোলাপের জন্য মরিয়া হয়ে থাকত আজ একগুচ্ছ সাদা গোলাপ শান্তর হাতে দেখে ফারিহা কিযে খুশি হবে। আজ কথা না বলে থাকতেই পারে না। আজ কথা বলবেই। এসব কথা ভাবতে ভাবতে শান্ত চলে আসে ফারিহার কাছে। হাঁটু গেড়ে বসে ফারিহার পাশে। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাদা গোলাপগুলো দেখিয়ে শান্ত বলে, ফারিহা দেখ আজ আমি তোমার জন্যে একগুচ্ছ সাদা গোলাপ এনেছি। আজ আর আমার সঙ্গে অভিমান করে থাকতে পারো না ফারিহা!
     কিন্তু ফারিহা নিশ্চুপ। কথা বলে না। শান্ত যে তার পছন্দের সাদা গোলাপ এনে হাঁটু গেড়ে ঝর ঝর করে কাঁদছে ফরিহা তা দেখছে। তবুও ফারিহা কথা বলছে না।
    শান্ত সাদা গোলাপগুলো ফারিহার কবরের পাশে রেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে, এত পাষাণ তুমি। আমি প্রতিদিন তোমার কাছে আসি কিন্তু তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও। আজ ঈদেরদিন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে ভেবে তোমার পছন্দের সাদা গোলাপ এনেছি। কিন্তু তুমি শুধু আমাকে কাঁদিয়েই যাচ্ছ।
শান্ত সাদা গোলাপগুলো ফারিহার কবরের ওপর রেখে ভাঙা মন নিয়ে চলে আসতে থাকে। পেছন থেকে শান্ত শান্ত বলে গলা ফাটিয়ে ডেকে ওঠে ফারিহা। কিন্তু শান্ত শোনে না!!

মুহিব্বুল্লাহ কাফি। বাংলাদেশ