অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
টিনের কৌটা - আশিস চক্রবর্তী

     প্রথমেই বলে রাখি এ লেখার ভাষা আমার হলেও, বিষয় বস্তু আমার উদ্ভাবন নয়। আমি কখনো কল্পনাকে লেখার মাধ্যমে বা বাস্তব থেকে কোনো উপাদান সংগ্রহ করে তাকে কল্পনাশ্রয়ী কাগজের খসড়া করে উঠতে পারিনি। সোজা কথায় আমি লেখা লিখির ব্যাপারে ভীষণ কুঁড়ে। দীর্ঘক্ষণ লেখাতে আমার ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটে। কাজের ক্ষেত্রে ছুটি চাইলে একটা ফোনে সেরে ফেলি। লিখিত দরখাস্তের বালাই অনেক কাল হয়েছে গত হয়েছে। এহেন ব্যবস্থা মন্দ না। তবে এটুকু বুঝি নতুন লেখক এর একজন প্রশংসা করার মতো শ্রোতা, বা পাঠক পাওয়া অমৃতের স্বাদের থেকে কিছু কম না। আর এখন থেকেই আমার গল্পকথনের অবতারণা।
     কর্ম ক্ষেত্র থেকে একটা পত্রিকা বেরোনোর সুবাদে অফিসের কলিগ শ্রীমান বিজয় বড়ুয়ার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ভদ্র লোক হিন্দি ভাষী। কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পন কালে সে নাকি এক মারওয়ারী পত্রিকায় হিন্দিতে কাহিনী লিখে বেশ সুখ্যাতি কামিয়ে ছিল। তবে সবটাই ছদ্মনামে।  
     অফিসের পত্রিকা, বাংলায় বেরোবে কাজেই হিন্দি ভাষা এখানে চলবে না। পাঠক সংখ্যা প্রায় সবই বাঙালি। অর্থাৎ বঙ্গানুবাদ এর দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। এর ও অবশ্য একটা কারণ আছে। আমি বেকার জীবনে হিন্দি পড়িয়েছিলাম সংস্কৃত অক্ষর এর ওপর নির্ভর করে, এই গল্প কোনো একদিন করে বসি বড়ুয়ার সঙ্গে। অগত্যা ভরসা আমি। বড়ুয়া আটপৌরে পল্লী জীবনের একটা দরদ ভরা কাহিনী লিখে ফেললে পত্রিকার জন্য। অতি কষ্টে আমার দ্বারা অনুবাদ ও হলো। পত্রিকার বেশ অনেক গুলি পাতা জুড়ে গল্প ছাপা হলো। একটা আপত্তিকর ঘটনাও ঘটলো। গল্পের প্রথমে লেখকের নাম হিসেবে বেরোলো "পরশপাথর" যেটা বড়ুয়ার ছদ্মনাম। একদম শেষে গিয়ে দেখি অনুবাদক হিসেবে আমার নাম ছাপার অক্ষরে। এটা নিয়ে বড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলে যা বুঝি, পাণ্ডুলিপিতে ওটা পরে ওই বসিয়েছে। সেই গল্প লিখে বড়ুয়া বেশ সুনাম পেল। পত্রিকা প্রকাশ এর দিন সে আমার নামে দু চারটে বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলে বসে। আমার অনুবাদই নাকি আসল সম্মান প্রাপক। তাঁর কথায় এতো কেবল অনুবাদ নয় ভাবানুবাদ। গল্পের অনেক স্থানে পরিমার্জন, পরিবর্ধন হয়েছে যাতে গল্প পুষ্টি পেয়েছে। এরপর পরশপাথরের শুকনো বাগানে ফুটে উঠলো ফুল ফল। আর আমি হয়ে উঠলাম সেই বাগানের মালি। অতি উৎসাহে বড়ুয়া একের পর এক গল্প লিখে সংস্করণের নামে আমায় শোনাতে আসতো প্রায়শই। আর আমার ভূমিকা অমৃত সম পাঠক অথবা শ্রোতা। দীর্ঘ কয়েক বছরে বড়ুয়ার অনেক গল্প আমি বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছি। আজ সে অফিস কর্মের পাশাপাশি একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক ও বটে। এখনও আমার ভূমিকা অনুবাদকের। ভদ্র লোকের প্রতিবারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ সেই প্রথম দিনের মতো  দেখবার জিনিস। মোটা অংশের রয়্যালটি দেবার পীড়াপীড়ি করে যায় রেগুলার। আসলে উদার হস্তে আমার প্রতি কিছু একটু না করতে পারলে আমার ঋণ এর বোঝা দিন দিন বেড়েই চলছে বলে সে মনে করে। এসব কথা এড়িয়ে ভদ্র লোককে বাংলাটা শিখে নিতে বলি প্রতিবারই। তাহলে আর আমার প্রয়োজন থাকে না। তাতেও রাজি নয়। ওর  প্রথিতযশা লেখক হয়ে ওঠার পেছনে কল্পনা শক্তির চেয়ে সে আমার এডিটরের ভূমিকায় অধিক বিশ্বাসী। আজ যেটা বলতে যাচ্ছি তার আসল রচয়িতা সেই পরশপাথরই। আমি কেবল একজন অনুবাদক। ওর মুখে যা শুনলাম অক্ষরে অক্ষরে তা হলো--
     চাকরিতে ঢোকার পর প্রথম বদলি সূত্রে এসে পড়ি এই বাংলাতে। ভাষা, খাওয়া, চলনে বেশ অসুবিধা হতে থাকলেও বেশ কয়েক বছরে আস্তে আস্তে সব রপ্ত হয়ে যায়। প্রতিদিন ভোর বেলা একজোড়া খঞ্জনি আর পাঁচালি গানে আমার ঘুম ভাঙে। যে বাসায় ভাড়াটে হিসাবে উঠেছিলাম তার পেছনে দিকে বস্তির মতো ছোট ছোট কয়েক খানা ঘর।  ওদিকের কোনো একটা কুঠুরি থেকে ভোর বেলায় এই শব্দ আসে। করুন মায়াবী এক সুর ঘুমের মধ্যে শুনে শুনে  সারাটা দিন যেন আছন্ন করে রাখতো।
     ও কুঠুরির বছর দশের এক ছেলে আমার ভাড়ার ঘরের সামনে সকাল সন্ধে ঘুর ঘুর করতে দেখি। একদিন হাতের ইশারায় সায় দিয়ে, আমার ঘরের চৌকাঠের ওপর উবু হয়ে বসে পড়ল। নাম জানতে চাইলে বললো- সুজন। পড়নে ময়লা হাফ প্যান্ট আর ফুটোফাটা গেঞ্জি।
     খাবার জিনিস দিতে চাইলে মাথা নাড়ায়। হাতে গুঁজে দিলে নেয়। জিজ্ঞাসা করলাম ভোরবেলা গান কে গায়?
     উত্তর দিলো - ঠাকুমা।
     মিনিট দশেক কথা বলে যা জানতে পারি ওর ত্রি-ভুবনে আর কেউ নেই। দেশের বাড়ি কোথায় সে তা জানে না। ঠাকুমার হাত ধরে এখানে এসেছে কিছু দিন। এখন ঠাকুমা তাকে পাঁচালি গান শেখায়। খঞ্জনি, রসকলি, সব টাই শিখছে। স্কুল যাওয়া নেই। সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরে। ঠাকুমার নাম জানতে চাইলে বলে
     - তুলসীবালা দাসী।
     এই দশ মিনিটে আমার ঘরের তাকে তোলা টিনের কৌটো টার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখেছে অনেক বার। বুজলাম মনে ধরেছে। ধরবারই কথা। এই জিনিস বাংলায় মিলবে কি করে। খাঁটি শিল্পীর জিনিস বটে। নেপাল থেকে আনা। গায়ে বেশ কয়েকটা কলকে, আর দেব দেবীর চিত্র। এতে ভরা ছিল পুরোনো কয়েকটা পুঁথি। যার কোনোটাই আজ আর নেই কোথায় গেছে সেও জানি না। পূর্ব পুরুষ এর মুখে শোনা, ওখান থেকেই প্রাপ্য। এটাকে ঠিক কৌটা বলা চলে না, তার চেয়ে অনেক টাই বড়ো, খানিকটা বাক্স গোছের। ঘরে ঢুকলেই ওটা আগে চোখে পড়ে।
     সেদিনের পর অনেক বারই ঘরে এসে বাক্সটার দিকে চেয়েছে। আমার আধা হিন্দি বাংলা মেশান প্রশ্নের জবাব ও দিয়েছে। আমার ছুটির দিনগুলো ওর সাথে কাটে বেশ। ঠাকুমাকে একবারও দেখিনি। আমার সকাল সন্ধে আহার সমস্ত কিছুই ওর সাথে ভাগ হতে থাকে। ওর দৃষ্টি কিন্তু টিনের কৌটা থেকে সরে না। এতো সময় কাটালেও, ও আমার কাছে রহস্যের মতোই থেকে যায়। মাঝে মাঝে পাঁচালি গেয়ে শোনায়, যার কোনোটাই আমি বুঝিনা। তবে করুন, আর মায়াবী।
     এরপর একদিন ওর ঠাকুমার কথা জানতে চাইলে বলে
     - শুয়ে আছে।
     বললাম একদিন নিয়ে এসো।
     ঠাকুমা কোথাও যায়না।- বললো সুজন।
     কেন জিজ্ঞাসা করতেই জানলাম সারাদিন শুয়ে থাকে। বুঝলাম বয়সের ভার কিংবা রোগ গ্রস্ত হতে পারে।
     টিনের বাক্সটা দেখবে?-- জানতে চাইলে! ওর চোখ আর মুখ খুশি তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ভাবলাম ওকে কৌতুহল মেটাবার একটা সুযোগ দি। বাক্সটা নামাতেই সেটা হাতে নিয়ে অনেক ক্ষণ নেড়ে চেড়ে দেখলো। হাব ভাব এমন যেন এটাই ও অনেক দিন ধরে খুঁজে চলেছে। ওটাই ওর চাই। বাক্সটার প্রতি ওর আগ্রহ দেখে মনে মনে ঠিক করি ওটা ওকেই দেব।
     বললাম -এটা তুমি নেবে?
     এক কথায় রাজি। যে ছেলে একটা বিস্কুট দিলে নিতে চাইনা হাতে গুঁজে দিতে হয়। তার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। সেটা হাতে নিয়ে ছুটে চলে গেল। ঘটনাটা মোটেও অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কারণ পছন্দের জিনিস নিয়ে সকলেই একান্তে সময় কাটাতে চাই, এটা সহজাত স্বভাব। সুজনও চায়।
     এরপরে বেশ কয়েক দিন সুজনের দেখা মেলেনি। বুঝলাম কৌটা নিয়ে খেলায় মত্ত। এত দিনের সাধের জিনিসের রসটুকু নিংড়ে নিতে চায়। আমার তেমন খারাপ লাগেনি। 
     হটাৎ একদিন এসে খঞ্জনি বাজিয়ে কপালে রসকলি কেটে বেশ হেলে দুলে পা নাচিয়ে  পুরো একটা গান  শুনিয়ে গেল। বোঝায় গেলো ঠাকুমার গানের শিক্ষা পূর্ন হয়েছে। মানে না বুঝলেও করুন আর মায়াবী ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আয়ত্ত করেছে দশ বছরের সুজন।
সুজন আস্তে আস্তে আমাকে ভুলে যেতে থাকলো। আর এলো না। মন খারাপ হলেও বস্তির ওদিকে যাওয়া হয়নি।
     বেশ কয়েক সপ্তাহ পর একদিন রাতে বস্তির ওদিক থেকে লোক জনের উচ্চ স্বরে কথা বার্তা কানে এলো। আন্দাজ কিছু করা গেলো না। অফিস থেকে সন্ধে বেলা ফিরে এসে দেখি ছোট ছোট কুঠুরি গুলো আর নেই। কেবল খুঁটি। জবর দখল উচ্ছেদ। তুলসীবালা, সুজন চিরতরে উধাও হলো। আর দেখা পাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। তবে ছেলেটা মনে দাগ কেটে গেল।
রোজকার জীবন, কাজ, মানুষ ভুলে যায় সব কিছু, বে মালুম।
    এতো টা শোনানোর পর বড়ুয়া চুপ করলো। আমি ভাবলাম এখানে গল্পের শেষ হলে পাঠক অতৃপ্তি পাবে। গল্পের রস না পেয়ে কেমন একটা মন মরা হবে। কোথাও একটা কিন্তু কিন্তু থাকবে। তবে এটা গল্প নয় বরং সত্যি ঘটনায় মনে হতে লাগলো। বড়ুয়াকে বললাম একি করলে পরশপাথর এখানেই গল্প শেষ। বড়ুয়া বললো- না। আজকে সুজন কে দেখলাম।
     আমি চমকে উঠে বললাম- কি বলছো বড়ুয়া, কোথায়? এতো বছর পর চিনলে কি করে? অনেক গুলি প্রশ্ন। 
     বড়ুয়া বললো -টিনের কৌটা।
     আমি বললাম সেটা এখনো ও যত্ন করে রেখেছে?
     বড়ুয়া বললো -না। অনেক বদলে গেছে।
     কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম - কি রকম?
     বড়ুয়া মুখ নামিয়ে উত্তর দিলো- ওতে একটা হাতল জুড়েছে। চড়েছে এক দেব কি দেবী! তেল সিঁদুর আর ফুলে ঢাকা।
     উত্তরটা তেমন পছন্দ না হওয়াতে বললাম- সেকি কেন?
     বড়ুয়া ফের বলে উঠলো- রসকলি টেনে, আর খঞ্জনি বাজিয়ে সুজন এখন রাস্তায় টিনের কৌটা হাতে ভিক্ষা করে।

আশিস চক্রবর্তী। পশ্চিমবঙ্গ