পূর্ণিমা রাত - মোবারক মন্ডল
সূর্য পশ্চিম দিকে কখন অস্ত গিয়েছে, আকাশে চাঁদের আগমন ঘটেছে, আজ পূর্নিমা তিথি,
পূণিমার চাঁদ যেন আজ বড়ই উজ্জ্বল,
শিশিরের ঝিলমিল জোৎস্নার আভায়
ঝিরঝির করে বয়ছে শীতের হিমেল বাতাস।কনকনে শীত।
তারারা বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে হাট বসিয়েছে উর্ধালোকে, চারিদিকে নিরবতা বিরাজ করছে, সারা রাজ্যে ঘুম নেমে এসেছে, দূরে কোথায় কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে, অদূরে ঝিঝি পোকার আওয়াজ কানে আসছে, রাস্তা জনশূন্য। এমন সময় তোমাকে ঘুম থেকে তুললাম, আমার বরাবরই স্বপ্ন ছিল এইরকম নির্জন রাস্তায় তোমার হাত ধরে হাঁটব। আমার মত তোমারও ইচ্ছে আমার বাহু ধরে কাঁধের উপর ভর দিয়ে একাকি রাস্তায় হাঁটার। খাঁটি বাঙালি গৃহবধূর বসনে বেরিয়ে পড়লে তুমি। পরনে লাল শাড়ি, সাথে কালো ব্লাউজ, হাতে কালো - নীল রঙের চুরি, কপালে সূর্যের রঙের লাল টিপ, চোখে গাঢ় কাজোল ছুঁয়া আর ঠৌঁঠে লাল লিপিষ্ঠিক, চর্চিত ভুরু, অপরুপা লাগছে আজ তোমায়।
ইট পাথরের রুক্ষ প্রান্তর ধরে। হাঁটছিলে তুমি, নিশ্চিন্তে, সাবলীল পদক্ষেপে আমার বাহু শক্ত করে ধরে। ধুধু নির্জন পথ, রাস্তার বাম পাশে বয়ে চলেছে ছোট নদী, নদীর কলকল শব্দ কানে মিষ্টি আওয়াজ তুলছে। চাঁদের আলো নদীতে প্রতিফলিত হচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যেও ঝলমল করছে চারিপাশ। নদীর ওপাড়ে শষ্যক্ষেত দারুন শোভা বিস্তার করছে।
বিষন্ন চাঁদটা দেখছে তোমায় আর তোমার সৌন্দর্যে হিংসা ও আক্ষেপ করছে, হয়তো তোমায় প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে। অপলক চোখে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তোমার সুন্দর্য আমাকে বিমহিত করে তুলছিল। চুলগুলো হালকা বাতাসে উড়ে এসে আমার মুখে ঠেকছে, চুলের মনোমুগ্ধকর গন্ধ আমাকে পাগোল করে তুলছে। তার সাথে তোমার দেহের মাদকতাময় সুগন্ধি বাতাসে মিশে, বাতাসকুলকে সুগন্ধি করে তুলেছে।
পূর্নিমার আলোয় তোমার শুভ্র চাদের ন্যায় উন্মুক্ত পিঠ যেন আশে পাশের অন্ধকার দূরভিত করছে।
কোমল দেহলতা, বর্ণিল সাজসজ্জা, অলঙ্কার রূপের বাহার, সরু কটিদেশ, উন্নত নাসা
কোমল কপোল রেশমের মতো ঠোঁট, অষ্টাদশী যৌবনা, মায়াবী চোখের আড়ালে হাসে গোলাপ ফুল। অঙ্গে তোমার বাঁশীর সুর,
সুরেলা যৌবন, আঁচলে ছড়ানো মিষ্টি নিক্কন।
আঁচল টানলে এমন সময় তুমি ভাল করে- গোটা দেহে আরো ভাল করে।
এমনিতেই পূর্ণিমা রাত, তার চেয়ে বেশি জ্যোৎস্না
তোমার বিথর দেহ, প্রতি স্বেদবিন্দুতে হীরক দীপ্তিকণা থইথই করছে।
তোমার উপমা শুধু তুমি
তুমি আছ সব সৌন্দর্যের মাঝখানে
সৌন্দর্যের রাণী হয়ে সগৌরবে মহিয়সী।
তোমাকে বাদ দিলে ভালো লাগার মত এই পৃথিবীতে আমার আর কিছুই নেই।
খুব গোপন সত্যিটা হল, স্বামী হওয়া সহজ কিন্তু প্রেমিক হওয়া কঠিন। আমি প্রেমিক হতে চাই। সব প্রেমিক স্বামী হয় না, কিন্তু সব স্বামী প্রেমিক হতে পারে। স্বামী মানেই সে তার অধিকারের বলে বা কখনও তার মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সবকিছু পাবে। এইরকম আমি চাই না, চায় সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভালোবাসা দিয়ে আমাকে ভরিয়ে দিক। স্বামীর অধিকার পূর্ণ করার জন্য নয়। বিয়েটা শুধু একটা কাগজের টুকরো মাত্র, প্রেমিকার পদবী বদলে স্ত্রী হয়েছে কিন্তু মানুষটা একই। স্ত্রী হলেই যে তার ভালবাসা পাওয়া যাবে এই ধরনা সম্পূর্ণ ভুল। বিয়ের পরেও ভালবাসা জয় করে নিতে হয়। আর যে বিয়ের পরে প্রেমিক হতে পারে সেই সারা জীবনের জন্য একটা প্রেমিকা পায়, যে তাকে সমস্ত ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখে।
হঠাৎ ছোট্ট পাথরে হোচট খেয়ে সম্বিত ফিরে পেলাম। তখনও তোমার মুখের দিকে আমার দৃর্ষ্টি নিবন্ধ। তুমি হেসে বলে ওঠলে 'পাগোল দেখে হাটো'।
আমার দৃষ্টি সামনের রাস্তায় প্রসারিত হল, গুটি গুটি পায়ে তোমার ঘ্রান শুকতে শুকতে এগিয়ে চলছিলাম, আমাদের পায়ের চলার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ উৎসারিত হচ্ছিল না, চাঁদটাও আমাদের সাথে সাথে হেটে যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে তুমি আমায় আবেগে জড়িয়ে ধরছিলে, ঐ সময় মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সুখের ভান্ডারটা আমার কাছে রয়েছে। কিছুটা পথ এইভাবে যাওয়ার পর কংক্রিটের রাস্তা ছেড়ে নদীর কিনারায় যাওয়ার মেঠোপথ ধরলাম। কুয়াশায় ভেজা ঘাসগুলি তোমার কাপড়ের নিচের অংশ ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
নদীর জল কিনারায় এসে আছড়ে পড়ছিল। তোমার ঠোঁটে খেলা করছিল প্রেম, বহতা নদীস্রোতে দুলছিল মন। মেঘধনু আঁচড় কাটছিল সঙ্গোপনে, মনরম বনলতা জোছনা স্নানে- অজানা সুর তোলছিল উতাল বাতাসে। চাঁদোয়া অশরীরী অবয়ব আকাশ।দূর আকাশে শুভ্র এককোনা মেঘ খেলায় মত্ত। বরণ ডালা হাতে প্রকৃতি তোমাকে বরন করতে প্রস্তুত, আসলে আমি তোমার প্রেমিক হওয়ার যোগ্য নই, তাই পূজারী হতে চাইছি তোমার। প্রেমিকের অনেক চাওয়া পাওয়া থাকে,দাবী দওয়া থাকে।পূজারীর সেরকম কিছুই থাকেনা আনুগত্য প্রকাশ ছাড়া।প্রেমিকের অনেক মান অভিমান থাকে, রাগ গোস্বা থাকে।পূজারীর সেসব কিছুই থাকে না অনুগত হয়ে থাকা ছাড়া। তুমি নদীর জলে পা ছড়িয়ে বসলে, ঐ সময় তোমার রুপের প্রতিফলন প্রবাহমান জলের উপর পড়ছিল। তোমার শায়িত কোলে মাথা দিয়ে বালির উপর শুয়ে পড়লাম। কি অপরুপ দৃশ্য। এদিকে তোমার সৌন্দর্য অপরদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। সবাই যেন আজ সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। মৃদুস্বরে চলছিল আমাদের ভালোবাসার রুপকথা। ধীরে ধীরে চাঁদটা অস্তমিত যাওয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল। অদূরে মসজিদের মাইক থেকে আজান ভেসে আসছিল। রঙিন এই মুহূর্তটা দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছিল। আমরাও ওঠে দাড়ালাম বাড়ির দিকে রওনা দিতে। গুটি গুটি পায়ে একইভাবে বাড়ি ফিরে আসলাম।
মোবারক মন্ডল। করিমপুর, পশ্চিমবঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
23-06-2020
-
-