অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
আশ্রম - রাজীব দত্ত

     মি দেবাশিষ, নতুন কাজ পেয়েছি কিছুদিন হল আর সেই সুত্রেই কোলকাতা থেকে বর্ধমান আসা। এখানে একটা বেসরকারি ইন্সটিটিউট-এ ক্লার্ক পদে চাকরি। ১০টা ৫টা ডিউটি বাকি সময়টা বাড়িতে থাকি আর নাহলে খেলারমাঠে। এছাড়া আমার আর একটা জায়গা আছে আমার সেখানে আমি মাঝে মাঝেই যাই, সেটা হল কুঞ্জবন বৃদ্ধাশ্রম ওখানে গেলে আমার সময় খুব ভালভাবেই কেটে যায়, অনেক নতুন দাদু, দিদাকে আমি পেয়েছি, আর তাদের সাথেই সময় কাটাতে কাটাতে সন্ধ্যা থেকে রাত হয়ে যায়। 
     আমি যে বাড়িতে থাকি সেটার থেকে আশ্রম মিনিট খানেকের রাস্তা, তাই মাঝে মধ্যেই ওখানে খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলি। আশ্রমের রমা দিদার রান্না অসাধারন যেদিন দিদা রান্ন-বান্না করে সে দিন তো আমি ওখানেই খাই। এছাড়া অনিমেষ দাদু, স্বপন দাদু, তুলসি দিদা এরাতো একবার গল্প শুরু করলে আর থামেইনা। কেউ পুরোনোদিনের কেউবা আবার নিজের ছোটবেলার তবে এদের মধ্যে একজন আছে যার পুরোনো কোন গল্পই আমরা কেউই যানিনা সে হল নারায়ন দাদু, আর তাই সেদিন খুব ইচ্ছা হল, ইচ্ছাটা আর চেপে রাখতে পারলাম না, শেষমেশ জিঞ্জাসা করে ফেললাম, কিন্তু নারায়ণ দাদু কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলো সেটা আমি স্পস্ট বুঝতে পারলম তাই বেশি কিছু বললাম না বয়স্ক মানুষ যদি দুঃখ পায় সেই কারনে ব্যাপারটা অন্য দিকে ঘুড়িয়ে দিলাম, ইতিমধেই রমা দিদা আলুরচপ নিয়ে গল্প শুরু করে দিল, তার পর আমিও বাড়ি চলে এলাম, কিন্তু বাড়ি ফেরার পর আমার মনের মধ্যে বার বার নরায়ণ দাদুর অস্বস্তির কথা আঁচর কাটতে লাগলো, বেশ কিছু দিন পর আশ্রমে আবার গেলাম।   
     সেদিন বেশ তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম কাজ থেকে, তাই চলে গেলাম আশ্রমে বেশ অনেকটা সময় কাটাবো বলে, আশ্রমে যেতেই নারায়ণ দাদু আমাকে দোতলা থেকে হাতের ইশারায় উপরে ওনার ঘরে ডাকলো আমি আর কাউকে কিছু না বলেই চলে গেলাম উপরে। ওনার ঘরে বসতেই উনি বলল ‘দাদু ভাই সেদিন তুমি আমার আগের কথা বলতে বলেছিলে না’। আমি বললাম হ্যা দাদু কিন্তু আমি যদি ভুল করে থাকি তাহলে … উনি আমাকে থামিয়ে বলল ‘নানা ভুল তোমার না, ভুলটা আমার’। আমি সত্যি হতবম্ভ হয়ে গেলাম, আমি বললাম মানে— দাদু বলল হা দাদুভাই আমি আমার দুঃখর কথা কাউকে আজ পর্যন্ত বলিনি সবাই যখন জিজ্ঞাসা করেছে যে কি কারনে আমি এখানে আছি, তখন আমি একটা উত্তর দিয়ে এসেছি যে কারনে তুমি এখানে আমিও সে কারনে আজ এখানে আছি। কিন্তু আমি সত্যি বলিনি কারন তাহলে আমার প্রতি নানান ধারনা জন্মাত, আমি যে একটা খুনি। আমি বললাম কি বলছেন আপনি, হুম… আমি আমার নিজের জিবনের প্রিয় মানুষটাকে খুন করেছি। আমার বৌ – পরমা, যানো ও দেখতে খুবই সুন্দর ছিল আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট, আমরা সুখে শান্তিতে সংসার গড়ে তুলেছিলাম। আমাদের ঘরের দেওয়াল গুলো বালি, সিমেন্ট দিয়ে গাঁথা থাকলেও তাতে জরিয়ে ছিল ভালবাসা, মায়া, মমতা। আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর পর আমাদরে সন্তান না হওয়ায় আমরা একটা বাচ্চা দত্তক নিই আমার ছেলে অভিজিৎ ও ছোটবেলায় খুব সুন্দর নাদুস-নুদুস দেখতে ছিল, এ দ্যাখো বলে দাদু একটা আধছেড়া ফাটা মানি ব্যাগ থেকে দুটো ছবি বার করলেন একটা ওনার ছেলে আর একটা ওনার স্ত্রী পরমা দেবীর। সেই সাথে আমি লক্ষ করলাম ওনার দুই চোখেই জল চলে এসেছে, চোখ মুছে দাদু আবার শুরু করলেন – আমার বেশ সুখি পরিবার ছিল সেই সুখ সাতাশ বছর পর দুঃখতে পরিনত হল, আমি যা রোজগার করতাম তাতে বেশ ভাল ভাবেই আমাদের চলেযেত, সেই সাথে সাথে ছেলেকে ইঞ্জিয়ারিং পরিয়েছি, আজ সে একটা বেসরকারি অফিসে কর্মরত, ছেলের বিয়ে দিলাম ওর নিজের পছন্দ করা মেয়ের সাথে, ভাবলাম ঘরে লক্ষী আনলাম কিন্তু সেটাই আমার জিবনের কাল হয়ে দাড়াল, দুমাস যেতে না যেতেই বৌমার আসল রূপ দেখাতে শুরু করল, মাস পাঁচেক পর সংসার আলাদা হয়ে গেল, ছেলে আমাদের টাকা দিতো, কিন্তু বৌমাকে জানাতে বারন করত, সে জানলে নাকি চরম অশান্তি হবে। এক, দুবার জেনেও গেছিল বৌমা অ-শান্তিও হয়েছে প্রচুর। আমাদের পাড়ার প্রতিবেশীরাও এ ব্যাপারটা জানতো, যদি আমি আর আমার বৌ পাড়ার কারুর সাথে কথা বলতাম তাহলে আমাদের বলতো পাড়ার লোককে বৌ-এর নামে নিন্দা করছি, আর কথায় কথায় বলতো বুড়ো-বুড়ি ঘাটে যাবে কবে তাহলে বৌমা শান্তি পাবে। আমার ছেলের একটা ছেলে ছিল আমার নাতি তাকে আমি খুব ছোটই দেখেছি, তাকেও আমাদের থেকে দুরে রাখতো বৌমা, আর সেই কারনে আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে খুব কাঁদতো।  
     একদিন হটাৎ কাশতে কাশতে পরমার মুখ থেকে রক্ত পরতে শুরু করলো ডাক্তার ও দেখালাম কিছু পরিক্ষাও করলাম কিছুই ধরা পরলনা, এভাবে বছর দুয়েক বাদে পরমার শরিরের অবস্থা আরোই যেন খারাপ হতে লাগলো। এক প্রতিবেশির পরামর্শে বড় ডাক্তার দেখালাম, তিনি একটি পরিক্ষা করার পর বলেলন যে এটি ক্যান্সার। ঠিক তখনই যেন পরমার মরা মুখের একটা ছবি দেখতে পেলাম, সে সময় চোখের জল মুছে ফেলা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। বাড়ি ফিরে ছেলেকে সব জানাই ছেলে বলল দেখছি কি করা যায়, আমি যেই ছেলের ঘর থেকে রেড়ালাম আমি স্পস্ট শুনতে পেলাম বৌ মা ছেলেকে বলছে- যদি ছেলে একটাকাও ওর মায়ের চিকিৎসায় বেফালতু খরচ করে তাহলে ওদের ভবিষ্যৎ কি হবে? তাই কোন অজুহাত দেখিয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে আর তা না হলে বৌমা নাতিকে নিয়ে ডিভোর্স দিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে, সেই সঙ্গে বৌমার বাবাকে বলে ছেলের চাকরিটা ও ছাড়িয়ে দেবে, সে সময় আমি যেন অবাক হয়ে গেলাম কারন, আমার ঠিক পিছনে দাড়িয়ে পরমাও পুরো কথা গুলো শুনে ফেলেছে। সেদিন রাতে পরমা আমার কাছে প্রথম বারের মতো কিছু চেয়ে ছিল আর সেটা হল ‘আমাকে একটু বিষ দেবে আমি চিরশান্তি পেতে চাই’ সেই কথাটা আজও আমার কানে ভেসে আসে বার বার। সত্যি সেই সময় দাড়িয়ে আমি যে কিছু করব তারও উপায় নেই কারন আমার সারাজীবনের উপার্যন ঐ বাড়ি আর ছেলের পিছনেই খরচ করে ফেলেছি। আস্তে আস্তে দিন গুলো কেমন যেন ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল আমার মাথায় চিন্তারা যেন মিছিল করা শুরু করেছিল। ঠিক এমনই সয়ম আমার মনের শয়তানটা যেন আমাকে বলল আমাদের মরা ছাড়া আর কোন উপায় নেই, শেষমেষ ঠিক তাই  সে দিন রাতে খাওয়া দাওয়া করে দুজনে গল্প গুজব করে শুয়ে পরলাম, কিন্তু আমার মনে অন্য কিছু বাসাবেধেছে আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না, নিজের বালিশটা দিয়ে পরমাকে শেষ করে ফেললাম তার পর ওকে ঝুলিয়ে দিলাম আর আমিও ঝুলে পোড়লাম কিন্তু কথায় আছে অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায় তাই আমি কখন দড়ি ছিরে ঘরের মেঝতে পরছিলাম কে যানে, যখন আমার জ্ঞান এলো ভাবলাম সব শেষ, সব থেকে মুক্তি পেয়েছি আমরা কিন্তু একটা নার্স বলল আপনার জ্ঞান এসেছে তখন বুঝলাম না আমি মুক্তি পাইনি কেবল পরমা আমাকে ছেড়ে দুঃখ দিয়ে আর ওদের সূঃখ দিয়ে চলে গেছে অনেক দূরে। কিছু দিন বাদে হাসপাতাল থেকে ওরা আমাকে বাড়ি নিয়ে গেল, তার কদিন পর থেকেই ছেলে কাজে চলে যেত, আব শুরু হতো আমার কাজ বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা সব করাতো আমাকে দিয়ে। দিনে দিনে অত্যাচার বেরেই চলেছিল। আমি একদিন ছেলেকে সব বললাম আর বৌমা সে দিনও আমাকে বলল মরার বয়স হয়েছে তবুও নাকি আমি মিথ্যে বলছি, আমাকে বের করে দিতে, আমি কিছু দিন ভেবে দেখলাম সত্যি চলে গেলে হয়তো একটু শান্তি পাবে, তার পরই চলে এলাম এই বুড়ো-বুড়ির ঠিকানায়। ভালোই আছি পরমার কথা ভেবে দিন কাটাচ্ছি, এই তো আর কদিন তার পর ব্যাস… জানোতো দাদু ভাই ওরা যানে যে না অভিজিৎ মানে আমার ছেলে আসলে আমার কেউনা, এক সময় ওকেই এক অনাথ আশ্রম থেকে তুলে নিয়ে গেছিলাম, আর দেখ সেই আরএক আশ্রমেই এখন আমার ঠিকানা….. 
     সত্যি মানুষ কি বৈচিত্রময় যে নিজে আশ্রম থেকে অট্টালিকায় গেল সে আবার নিজের জীবন দাতাকেই অট্টালিকা থেকে আশ্রমে পাঠালো হয়তো এটাই বাস্তব… এটাই সত্যি… এটাই জীবন… 

রাজীব দত্ত। কোলকাতা, ভারত