অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
স্নেহের সন্তান - পার্থ প্রতিম হালদার

     'আমাকে আর মারিস নি রে বাবা, আর মারিস নি, আমি এবার মরে যাবো। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তোর পায়ে পড়ি আমাকে তুই ছেড়ে দে। আর মারিস নি রে আমি মরে যাবো।'  সাতাশ বছর বয়সের ছোট ছেলে কালুর  হাতে মার খেতে খেতে ঘন্টুর বাবা  বললে। তা শুনে সঙ্গে সঙ্গে কালু তার বাবার মাথাটা ধরে আবার ইঁটের দেওয়ালে জোর করে ঠুকিয়ে দিয়ে বুকে পেটে লাথি মারতে শুরু করে। তখন কালুর মা তার ছেলেকে আটকাতে গিয়ে ঠেলা খেয়ে পড়লে পাশে থাকা বেঞ্চের ওপর। তারপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বাবাকে বের করে দিয়ে কালু বলে, ' তোকে আজ মেরেই ফেলবো। তুই আমার ভবিষ্যত নষ্ট করে দিয়েছিস।'  বলে বাইরে ঠেলে ফেলে দেয় ৬৩ বছর বয়সের রোগা পাতলা বাবাকে। কালুর  মা গ্লাসে করে জল নিয়ে ছুটে যায় স্বামীর চোখে মুখে বুকে দেবে বলে। কিন্তু কালু লাথি মেরে সেই গ্লাস মাটিতে ফেলে দেয়। তার মা ওষুধ আনতে ঘরে ঢুকলে, কালু ঘরের লাইট গুলো বন্ধ করে দেয়। আর বলে তুই একদম ওর মুখে ওষুধ দিবি না। জল দিবি না। বাইরে ছটকে ছটকে মরুক। মা কাঁদতে কাঁদতে ছেলের পায়ে ধরে বলে তোর বাবাকে ছেড়ে দে বাবা তোর বাবা মরে যাবে।
     রাত তখন ১১ টা হবে। পাড়া পড়শিরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আর অন্যদিকে ঘন্টুর বাড়িতে চলছে এমন কুরুক্ষেত্র। বাবাকে ইচ্ছে মত মেরে ঝগড়া করতে করতে কালু ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লে। এমন করে রাত তিনটে পর্যন্ত রাগ দেখাতে থাকে, বার বার তেড়ে আসতে থাকে আবার মারার জন্য। তারপর হঠাৎ আরো রেগে গিয়ে বলে উঠল ওকে আজকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো। বলে বিছানা থেকে উঠে পড়ে কেরোসিন তেল খুঁজতে লাগলে। কালুর মা তাড়াতাড়ি করে কালুর বাবাকে পেছনের দরজা থেকে বের করে দিয়ে দূরে গিয়ে থাকতে বললে, না হলে তো ও এখনি মেরে ফেলবে। কালুর বাবা হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাঁদতে কাঁদতে দূরের রাস্তার দিকে বেরিয়ে অন্ধকার এক আটচালা ঘরের সামনে গিয়ে চোরের মতো লুকিয়ে বসে থাকলে ছেলের হাতে মার খাওয়ার ভয়ে। ওদিকে কেরোসিন তেল না পেয়ে, শাবল হাতে নিয়ে বাবার ঘরে ঢুকে গিয়ে বলে 'আজকে ওর পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে মেরে ফেলবো। কোথায় গেল সে। ওর পেটের সব ভাত আজ বের করে নেবো।'  বলে সে কি গালিগালাজ। সেইসব গালিগালাজের দ্বারা সে তার বংশের ষষ্টি পুজো করে ছেড়ে দিয়েছে।
     ছেঁড়া ধুতি ছেঁড়া পাঞ্জাবি পরিহিত রক্তাক্ত ঘন্টুর বাবা হাঁপাতে হাঁপাতে পাশে শুয়ে থাকা একটা কুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে কুকুরটা কত নিশ্চিন্তে ঘুম দিচ্ছে - কোন চিন্তা নেই, অশান্তি নেই, সংসার নেই - ছেলের হাতে মার খাওয়ার ও কোনো দরকার নেই। কুকুরের জীবন অনেক ভালো। কুকুর কে যদি আপনি  কয়েক মাস খেতে দেন তাহলে সে যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন সে আপনাকে মনে রাখবে। কিন্তু জন্ম থেকে সাতাশ - আঠাশ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করার পরেও সে বলবে তার ভবিষ্যত আপনি নষ্ট করে দিয়েছেন। এত বছর বয়স পর্যন্ত বাবার হোটেলে খেয়েও একটুও মানবতার জন্ম হয় না। উল্টে বাবাকে ধরে পিটছে, মেরে দিতে চাইছে।
     ঘন্টুর বাবার মনে পড়ে, কালু আর ঘন্টু যখন খুব ছোট ছিল তখন দুই ছেলেকে নিয়ে কতবার লুকোচুরি খেলেছে আর ইচ্ছে করে ধরা দিয়েছে - বাবা খেলতে পারছে না ভেবে দুই ভাই মহানন্দে হেসেছে আর তা দেখে আনন্দে বাবার বুক জুড়িয়ে গেছে। আর সেই লুকোচুরি খেলা এখনও চলছে, এখনও বাবা হারছে প্রতিনিয়ত - নিজের সম্মানের কথা ভেবে, স্নেহের টানে, ভালোবাসার টানে। তাই এর আগে তিন তিন বার ছেলে যখন বাবাকে মেরে ছিল তখন সম্মান বাঁচাতে পাড়ার কাউকে বলেনি, ছেলেকে ঘর থেকে বের করে দেয়নি। পুলিশে দেয়নি। কাউকে দিয়ে ছেলে কে পেটায়নি - বাবা মা হয়ে ছেলের কষ্ট সহ্য করতে পারবে না বলে। ভেবেছে পরে হয়তো সে তার নিজের ভুল বুঝতে পারবে, শুধরে যাবে। তাই বার বার অপত্য স্নেহের কাছে, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে চুপ করে থেকেছে, আর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বারবার সন্তানের কাছে হেরেছে। বাবা মায়ের এই অনুভূতি বুঝতে পেরে সেই সুযোগটা সন্তান বারবার নিয়েছে।
     এদিকে ঘন্টুর বাবার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কপাল থেকে রক্ত বেরিয়ে এসে গড়িয়ে গড়িয়ে মুখে পড়ছে। মাথাটা ঘুরছে, পেটে বুকে খুব ব্যথা করছে। এমন সময় দেখলে ঘন্টুর মা আসছে কাঁদতে কাঁদতে। এসে বললে 'চলো আর এখানে থাকা যাবে না। সে পাগলের মতো চীৎকার করছে। বাড়িতে ঢুকলেই মেরে দেবে। চলো হসপিটালে গিয়ে পড়ে থাকি।'  কিন্তু হসপিটাল তো অনেক দূর। গাড়িও তো পাওয়া যাবে না লকডাউনের সময়ে - ঘন্টুর বাবা বললে। তখন ঘন্টুর মা বললে চলো হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাই, তাছাড়া এখন কি বা আর করার আছে। বলে তারা হাঁটতে শুরু করলে। কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পর চৌরাস্তার মোড়ে ঘন্টুর কাকাদের বাড়ির সামনে এসে ঘন্টুর বাবা ঘন্টুর মাকে বললে দাঁড়াও, মা ভাইদের সঙ্গে একটা বার দেখা করে আসি। আর বাঁচবো কিনা তো ঠিক নেই - একটা বার বলে আসি আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
     এটা হয়তো ঠিক, ছোট থেকে ঘন্টুরা বড়ো বাড়ির ছেলে মেয়েদের মতো ভালো ভালো খাবার, ভালো ভালো পোশাক, ভালো বাসস্থান পায়নি। বড়ো বাড়ির ছেলে মেয়েদের মতো সমস্ত সুযোগ সুবিধা, আর্থিক সাপোর্ট পায়নি। কিন্তু তাই বলে ছেলে গুলো তো গাছ থেকে পড়ে একেবারে মানুষ হয়ে যায়নি। তাদের খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করাতে তবেই না তারা আজ এত বড় হতে পেরেছে। না খেতে পেয়ে তো কেউ মরে যায়নি। ঘন্টু ছিলো কালুর পুরো বিপরীত - রোগা, আবেগপ্রবণ, সহৃদয়। সেইসঙ্গে দিনরাত পড়াশোনা করতো। সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে থেকে পড়াশোনা করে করে তার মনটা মেয়েদের মতো খুব নরম হয়ে গেছিল। মেয়েদের মতো বললে ভুল বলা হবে - মেয়েদের থেকে অনেক বেশি নরম মনের হয়ে গেছিল। কারোর কষ্ট দেখলে সে খুব কষ্ট পেতো, সিনেমাতে দুঃখের দৃশ্য থাকলে সে উঠে গিয়ে চোখের জল মুছে আসতো লজ্জাতে। সিনেমাতে যেসব দৃশ্য দেখে কোনো মানুষের বা পরিবারের কারোর চোখে জল আসতো না কিন্তু ঘন্টুর চোখে জল আসতো। এতটাই নরম মনের ছিলো সে। শুধু তাই নয়, তার জীবনের প্রথম ও শেষ প্রেমিকা মাম্পির সাথে যখন সম্পর্ক ছিল তখন মাম্পির একটু কষ্টতে সে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলতো। কোনো পরীক্ষাতে কম নাম্বার আসলে হাউহাউ করে কাঁদতো। কতবার আত্মহত্যা করার কথা ভেবেও নিয়েছিল - ভালো পড়াশোনা করে আশানুরূপ রেজাল্ট না হওয়ার কারণে বা পরবর্তীতে চাকরি না পাওয়ার কারণে। অন্যদিকে ছোট থেকেই কালু পড়াশোনা করতে চাইতো না। বাড়ির ছোট ছেলে তাই একটু বেশি আদরেরও। বি. এ. পাশ করতে তার সময় লেগে গেছিল ৬ - ৭ বছর। সেইসঙ্গে খামখেয়ালী জীবন যাপনে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। যখন যা মনে হতো তাই সে করতো। বাবার সারাজীবনে জমানো ঊনত্রিশ হাজার পাঁচশো টাকা সে বাবা কে না বলে এটিএম থেকে তুলে নেয়। না বলে তুলে নিয়েছে মায়ের কিছু টাকাও। তা জানতে পেরে ঘন্টুর বাবা  সারাক্ষণ ঝগড়া ঝাটি করতে থাকে। কিন্তু ঘন্টুর মা বলে বাইরের লোকে তো নেয়নি আমাদের ছেলে নিয়েছে। যদিও এসব কথাতে ঘন্টুর বাবার মন ভেজে না। ঘন্টুর মা ছেলেদের কে কখনও কিছু বলেনি, কখনও বকাবকি করেনি। ছেলেদের দুষ্টুমি সবসময় মেনে নিয়েছে। মেনে নিয়েছে ছেলে মেয়েদের সমস্ত আবদার। তাই হয়তো কালু একটার পর একটা কোম্পানির চাকরি ছেড়েছে কিছুদিন পরপর। আর বাড়ি এসে  কাজ না করে চুপচাপ বসে থেকেছে, খেয়েছে, ঘুমিয়েছে। আর মাকে বলেছে জানো মা কোম্পানির কাজে খুব কষ্ট। দশ বারো ঘন্টা ডিউটি দিতে হয়। খাওয়ার সময়ও পাওয়া যায় না । ভালো ভাবে ঘুম ও হয় না। তা শুনে তার বাবা বলেছে, বাইরে কাজ না করলে এখানে থেকে আর কি কাজ করবি। গ্রামের বুকে আর কি কাজ আছে। পাকা বাড়ির রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ ও করতে পারবি না, একশো দিনের কাজ ও করতে পারবি না, ঘরের জমি গুলো ও তো চাষ করতে পারবি না। তাহলে কি করে খাবি। কালু কিছু না বলে চুপ করে থাকে, রাগে ফুঁসতে থাকে। এইভাবে ঘরে বসে বসে কিছু মাস কাজ না করে খায় আর ঘুমায়। তারপর কারোর কাজ থেকে শুনে, সিনেমাতে ঢোকার জন্য মায়ের কাছ থেকে আট হাজার টাকা নিয়ে অভিনয় শিখতে ভর্তি হয়। একমাস পর আবার তা ছেড়ে দেয়। তারপর রেল, ব্যাঙ্ক , সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে বলে মায়ের কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা নিয়ে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে যায়। কিছুদিন পর মাকে বলে জানো মা অঙ্ক ইংরেজি খুব কঠিন। আর কত কত জেনারেল নলেজ পড়তে হয় - ছেড়ে দেব ভাবছি আর পড়বো না। মা বলে থাক বাবা ওসব পড়তে হবে না। এরপর যদিও ভগবানের কৃপায় লেদার কোম্পানিতে কয়েক মাসের ট্রেনিং করে সে একটা কাজ পেয়ে যায়। মাসে সব খরচ করেও তার হাতে থাকতো প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।  এমন সংবাদে বাড়িতে আনন্দের  বন্যা বয়ে যায়। গরীব পরিবারে মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা ইনকাম মানে স্বর্গের চাঁদ হাতে পাওয়া।
     ঘন্টু যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়তো তখন তার বড়দি বুনুদির বিয়ে হয়েছে। তখন ২০০৭ সাল। তার বড়দির থেকে দু বছর সাত মাসের ছোট তার ছোড়দি টুনুদির এখনও বিয়ে হয়নি। ত্রিশ বছর বয়সের দাদা ঘন্টুর ও এখনও বিয়ে হয়নি। তা সত্ত্বেও লেদার কোম্পানিতে কাজ পেয়েই কালু তার বাবা মাকে না জানিয়ে একটা বিয়ে করে বউকে ঘরে নিয়ে চলে আসলে। তার বাবা মা প্রথমে মানতে রাজি হয়নি কিন্তু ছেলে বৌমা যখন বাবা মায়ের পা জড়িয়ে ধরলে আর পাড়ার লোকজন বললে ছেলে বউকে ঘরে তুলতে তখন বাধ্য হয়ে মেনে নিলে। কিন্তু একমাস না হতে হতে সেই নতুন বউ রাগারাগি করে বাপের বাড়ি চলে গেলে। ঘন্টুর বাবা মাও বৌমাকে আসার জন্য বারবার ফোন করলে কিন্তু তার আসার কোনো ইচ্ছা দেখা গেল না। কালু নিজে গেলে শ্বশুর বাড়িতে, বউকে ডাকতে কিন্তু সে এলো না। কালুর বউ চেয়েছিল কালুকে নিয়ে গিয়ে ঘরজামাই করে রাখতে, আর চেয়েছিল ইচ্ছা মতো ঘুরে বেড়াতে, কোম্পানির কাজ করতে। কিন্তু কালুর বাড়ি থেকে তা মেনে নেয়নি। ঘরের বৌমা বাড়ির বাইরে যাবে কোম্পানির কাজের জন্য তা তারা মেনে নিতে পারেনি। এই হয়ে উঠেছিল সমস্যা। যে কারণে কালুর বউ কালুকে ছেড়ে চলে গেলে। যার ফলে বউয়ের বিরহে কালু দিনরাত মনমরা হয়ে বসে থেকেছে। ওদিকে তার বউ হাতের সাঁখা, মাথায় সিঁদুর মুছে ফেলে অবিবাহিতা মেয়েদের মতো চুড়িদার পরে কোম্পানির কাজে ঢুকে আনন্দে বিভিন্ন ছেলেদের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করছে। আর সেইসব পোস্ট বাড়িতে বসে বসে, রাত জেগে শুয়ে থেকে থেকে কালু দিনরাত এসব দেখছে আর পরিবারের লোকেদের সঙ্গে রাগারাগি করছে। কিছুদিন এমন চলার পরে বাড়ির সবাই বললে কোনো একটা কাজে ঢুকে যেতে। কারণ কাজে ব্যস্ত থাকলে কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলে থাকা যায় কাছের মানুষের দেওয়া কষ্ট গুলোকে। কিন্তু কালু দশ থেকে পনেরো দিন একটি কাজে ঢুকলে কি হবে মন বসাতে না পেরে আবার কাজ ছেড়ে দিয়ে ঘরে চলে আসে। কাজ করতে তার মন চায় না, শুধু ঘরে বসে বসে খায় আর ঝগড়া মারপিট করে। 
     লকডাউনের সময়ে রাস্তায় কোনো ভ্যান রিক্সা নেই। প্রায় দু ঘন্টার রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে ঘন্টুর বাবা মা গেলে নদীর ধারে। লকডাউনের সময় পারাপার করার নৌকাও বন্ধ। কিন্তু নৌকার মাঝিকে এমন সমস্যার কথা জানাতে, কান্না কাটি করতে, একটু পয়সা হাতে গুঁজে দিতে মাঝি পারাপার করতে রাজি হলে। কিন্তু নদী পেরিয়ে আবার তারা বসে থাকলে গাড়ির অপেক্ষায়। একে শরীরের অবস্থা ভালো নেই তারওপর সকাল থেকে কিছু খাওয়া নেই। আর তাছাড়া হেঁটে যাবেই বা কি করে সাত থেকে আট ঘন্টার রাস্তা। ঘন্টুর বাবা মা ভাবলে গাড়ি না পেলে আর কি হবে সারারাত নদীর পাড়ে বসে কাটাতে হবে, নদীর পাড়ে বসে বসে মরতে হবে। এমন সময় ঘন্টুর বড়দি বুনুদি মা বাবাকে ফোন করল। শুনতে পেল মায়ের কাঁদো কাঁদো গলার স্বর। বুঝতে পারল সব কিছু। কিন্তু বাবা মাকে ওখান থেকে হসপিটালে নিয়ে আসবে বা কি করে। বুনুদির বাড়ি হসপিটালের কাছে হলে কি হবে লকডাউনে রাস্তায় তো পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। তবুও জামাইকে অনেক বার বলল বাইকে করে গিয়ে বাবা মাকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু জামাই যেতে রাজি হলো না। তারপর বুনুদির অনেক মান অভিমানে পুলিশের ভয়ে ভয়ে রাস্তায় বের হল শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে আসার জন্য। শ্বশুর শাশুড়ি কে বাইকে তুলে সোজা হসপিটালে নিয়ে গেল। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে হসপিটালে স্পেশালিস্ট ডাক্তারের ও দেখা নেই।
     তবে একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান ছিল, তার কাছে দেখিয়ে কিছু ওষুধ কিনে শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে জামাই বাড়ি ফিরল। বাবা মায়ের অবস্থা দেখে বুনুদি কান্না জুড়ে দিলে, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিল ঘন্টুর বাবা মা ও। একটু পরে ঘন্টুর মা বলল অমন ছেলেকে আর বাড়িতে রাখবো না, পাড়ার লোকেদের দিয়ে মারধোর করিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেবো। ঘন্টুর বাবা বোঝে এটা ঘন্টুর মায়ের মনের কথা নয়। স্বামীকে সান্ত্বনা দিতে মা ছেলের ওপর রাগ ঝাড়ছে। যে মা ছেলে মেয়েদের জন্য পাগোল, যে মা বিয়ের পর থেকে শত কষ্ট অত্যাচার অপমান সহ্য করেও আত্মহত্যা করেনি শুধুমাত্র ছেলে মেয়ে দের মুখের দিকে তাকিয়ে, সেই মা এমন করে মারধোর করে ছেলেকে কখনও যে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারবে না এটা স্বাভাবিক। শুধু তো এই একবার নয়, এই নিয়ে চার চারবার কালু তার বাবাকে পিটেছে। ঘন্টুর সব ভাইবোন রেগে গিয়ে ছোট ভাই কালুকে ফোন করে খুব ঝাড় দিয়েছে। তাকে মরতে বলেছে গলায় দড়ি দিয়ে বা বিষ খেয়ে। দিয়েছে মনের মতো করে নানা অভিশাপও । তুলে দিতে চেয়েছে তাদের আদরের ছোট ভাইকে পুলিশের হাতে। লকডাউনের কারণে ঘন্টুও বাড়ি ফিরতে পারেনি, বাইরের রাজ্যে আটকে গেছে। তাই ফোন করে করে সে পাড়ার লোকেদের জড়ো করেছে ছোটো ভাইকে পিটিয়ে পুলিশের হাতে, না হলে পাগলা গারদে দেবে বলে। পাড়ার লোকেরাও মারার উৎসাহে মেতে উঠেছে আর বলেছে তোমরা চিন্তা কোরোনা, এক ঘণ্টার মধ্যে অনেক লোক জড়ো করে পিটিয়ে পা হাত পা খোঁড়া করে আধামরা করে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছি। তা শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘন্টু ফোন রেখে দিলে। মনে মনে ভাবল এই বার উচিত শিক্ষা হবে, যেমন বাড় বেড়েছে তেমন এবার টের পাবে। এ সমস্ত ভাবতে ভাবতে বদ্ধ ঘরের মধ্যে পাইচারি করতে লাগল। কিন্তু এমন ভাবনা আর বেশিক্ষণ তার মনে স্থান করে নিতে পারলো না। ভাবলে এতক্ষণে হয়তো সবাই মিলে ছোট ভাইটাকে খুব মার মারছে। এ কি নিজেরা মারছি যে দেখেশুনে মারবো। আনাড়ি লোকেদের প্রচন্ড মারে যদি ছোট ভাইয়ের কোনো ক্ষতি হয়ে যায় সেই আতঙ্কে ঘন্টু আবার পাড়ার লোকেদেরকে ফোন করল। ফোন করে বলল, আচ্ছা মারধোর না করে সবাই মিলে বসাবসি করে যদি সমস্যাটার সমাধান হয়ে যায় তো তাহলে ভালো। এমনি আস্তে জোরে এক দুবার না হয় একটু আপনারা মারবেন এখন - যেমন ছেলে তার তেমন শাস্তি হওয়া দরকার। আর বাবা ঘরে ফেরার পর বাবার পায়ে ধরে সে যদি ক্ষমা চেয়ে নেয় তাহলে তো আর কোনো কথা নেই। এমনটা শুনে মারমুখী লোকেরা উল্টে ঘন্টুর ওপর রেগে গেল। এতক্ষণে তারা লোকজন জড়ো করে লাঠি সোঁটা রেডি করে নিয়েছে। ঘন্টুর কথা শুনে তারা রেগে গিয়ে বলল ঠিক আছে তাহলে তোমার বাবা মা বসে বসে মার খাক। কখন বলতে কখন তোমার বাবা মাকে মেরে দিয়ে পালাবে বা সমস্ত সম্পত্তি অধিকার করে নেবে তখন বুঝবে। তখন আবার আমাদের কে বলতে এসো না। এখন আমরা সবাই গ্রামে ছিলাম মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারতাম, পরে কে কোথায় কাজে বেরিয়ে যাবে সবাইকে পাওয়া যাবে কিনা তার নেই ঠিক - তখন কিন্তু আর আমাদের বলতে এসো না আমরা দায়িত্ব নিতে পারবো না।
     ওদিকে ঘন্টুর বাবা ঘন্টুর দিদিকে বলল কাল আমি ঘরে যাবো মা, শুনতে পাচ্ছি দুদিন পরে নাকি আমফান ঝড় আসবে, গাছের আমগুলো বোধ হয় সব পড়ে যাবে, প্রবল বৃষ্টিতে পুকুরের মাছগুলো হয়তো বেরিয়ে যাবে। কত গাছ ভেঙে পড়বে তারও নেই ঠিক। গাছ ভেঙে পড়লে লোকেরা যে পারবে সে তো চুপি চুপি কেটে নিয়ে চলে যাবে। ছেলের হাতে মার খেয়ে খেয়ে মরতে হয় হবে নিজের ঘরে গিয়ে মরবো। তোদের এখানে বা কতদিন পড়ে থাকবো বল। ঘন্টুর মা বলল বাড়িতে গেলে যদি তোমাকে আবার মারে - এমনি তে তোমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে বারবার। যন্ত্রণাতে ছটপট করছো তারওপর যদি আবার মারে তখন কি হবে - তাই ওকে পুলিশের হাতে তুলে দাও। থানাতে গিয়ে চলো আমরা বলে আসি ছেলে আমাদের ওপর এমন অত্যাচার করছে। ওকে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হোক। ঘন্টুর সব ভাইবোন, ঘন্টুর বাবা খুব ভালো করে জানে কোলের ছেলেকে মারধর করে জেলে ঢুকিয়ে দিলে ঘন্টুর মা যে পরে হার্ট এটার্ক করে মরবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তখন ঘন্টুর বাবা বলল, কি হবে বলো জেলে ঢুকিয়ে। ছেলের ভবিষ্যৎ আছে - বাবা মা হয়ে কেমন করে ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিই। বলে কাঁদতে লাগল। এমন সময় ঘন্টুর ঠাকুমা কাঁদতে কাঁদতে ঘন্টুর বুনুদিকে ফোন করল। যে সৎ মা কখনও ছেলেকে ভালোবাসেনি আদর করেনি, ছেলেকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে সেই সৎ মাও এমন ঘটনাতে কষ্ট পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘন্টুর বুনুদিকে বলল মা মরা ছেলেটাকে ধরে কি মার না মারল। ছেলে আমার, কাঁদতে কাঁদতে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে বলল ' মা গো তোমার নাতি আমাকে মেরে মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি মা গো। তোমরা ভালো থেকো।'  এই লকডাউনের বাজারে ছেঁড়া ধুতি পাঞ্জাবি পরে ছেলে আমার বেরিয়ে গেল বৌমার সঙ্গে। তোর কাকারা বলল তুমি থেকে যাও দাদা কোথাও যেতে হবে না তোমাকে। কিন্তু শুনলে না। হয়তো তার নিজের মা বেঁচে থাকলে অনেক ভালোবাসতো ছোট থেকে খুব ভালো করে মানুষ করতো। কিন্তু আমি একটু হলেও তো তোর বাবাকে কখনো খাইয়েছি, একটু আধটু দুষ্টুমি ও তো সহ্য করেছি। আমি বললাম তুই এখানে থেকে যা তোর ভাইদের কাছে। শুনলে না আমার কথা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলে - বলে ঘন্টুর ঠাকুমা কাঁদতে লাগল। তখন বুনুদির কাছ থেকে ফোন নিয়ে ঘন্টুর বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললে, মা গো আমি কি দোষ করেছি মা, আমি কি পাপ করেছি মা, যার জন্য আজ আমার ছেলে আমাকে ধরে মারছে। তোমরা এর বিচার করো মা। মা গো তুমি বলে দাও কি ভুল করেছি আমি - না খাইয়ে ছেলে মেয়েদের খাইয়েছি সেটা কি আমার ভুল, ওদেরকে সাধ্যমত পড়াশোনা শিখিয়েছি সেটা কি আমার ভুল, কখনও কাজ করতে দিইনি পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে সেটা কি আমার ভুল - তোমরা এর বিচার করো মা গো, তোমরা এর বিচার করো।

পার্থ প্রতিম হালদার। করিমগঞ্জ, আসাম
(পার্থ প্রতিম হালদার,  অতিথি অধ্যাপক, স্বামী বিবেকানন্দ কলেজ, করিমগঞ্জ, আসাম।)