অটোয়া, সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫
ভোররাতের স্বপ্ন - মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন

     বালুদ্বীপের বাসিন্দা বিমল বাঢ়ৈর ছোট বেটা বিদ্যেসাগর ফেল করতে করতে মাধ্যমিক পাশ করে ফেললো। শেষে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়ে কিছুদিন কলেজে আসাযাওয়া করেছে। তবে কলেজের পড়া তার আর ভাল লাগেনি বলে, কলেজের গণ্ডি আর পেরোয়নি। এদিকে খানিকটা লেখা পড়া করার কারণে কৃষি কাজে যোগ দিতেও লজ্জা বোধহয়। মাঝে মাঝে ভাবে, বিদেশে যাবে। তার জন্য টাকা লাগবে, বাবা তার পেছনে আর কানাকড়িও খরচা করতে নারাজ। কাজেই বাবার হোটেলের অন্ন ধ্বংস করা ছাড়া তেমন কাজে তাকে দেখা যায়না। এ নিয়ে বাবা তাকে বকাঝকা যে করে না এবং খাবার বন্ধের ঘোষণা দেননা তা নয়, তবে মা আছেন বলে, লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার পরিবেশন নিয়মিত রাখার কারণে তাগড়া শরীরের ওপর কোন প্রভাব পড়েনি।
     বিমল বাবাকে ভয় পায় এমন নয় তবে তার বাবা বাড়ি হতে বের হলে, তবেই সে ঘরে ঢোকে। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে তার পাশের গ্রামে। সেখানে তার বেশ কিছু বন্ধু আছে তাদের সাথেই চলে। 
     একদিন বিদ্যেসাগর বাইরে যাচ্ছিল, এসময়ে বাবার সাথে দেখা। বাবা অসময়ে বাড়িতে ফিরল বলে বিদ্যেসাগর তার সামনে পড়ে গেল। মাথাটা নিচু করে একপাশ দিয়ে চলে যাবার উদ্যোগ করতেই বাবার ভারী গলায় সেই চেনা গালি,
     এই হারামজাদা, দাঁড়া। 
     বিমল মুখ লুকিয়ে হাসে, আর মনে মনে বলে হারামজাদার মানে জানলে বাবা তাকে আর এগালিটি দিতেননা। গালিটি যে বাবার নিজের গায়েই লাগে, তা তার খেয়াল নেই। 
     - কোতায় যাওয়া অচ্ছে? 
     - একডু বাইরে।
     - বাইরে কোতায় ? 
     - পাশের গ্রামে, গোবিন্দগের বাড়ি। 
     ছেলের জন্য বাবার মায়া হয়, কষ্টও লাগে। কষ্ট লাগে ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। বড় হয়েছে, বিয়ে করবে সংসার করবে কিন্তু কিছু না করলে ওর চলবে কি করে। বিমল ছেলেকে জিজ্ঞেস করে,
     - বলি এভাবে কতদিন চলবি ? 
     বিদ্যেসাগর কোন কথা বলে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কি করবে জবাব দিলে বলবে মুখে মুখে তর্ক করে, আবর চুপ করে থাকলে রেগে যায়। 
     চুপ করে থাকতে দেখে বিমল দিগুণ জোরে ধমক দিয়ে বলে, 
     - দুরহ হারামজাদা আমার সামনেরতে, তোরে যেন আর কোন দিন আমার সামনে না দেহি। 
     বাড়ির ভেতরের দিকে তাকিয়ে, 
     - তোরে যে ভাত দেবে, তার ভাতও আজকেরতে বন্ধ কিইরে দিবানি। 
     আজ বাবার কথায় বিদ্যেসাগরের খুব রাগ হল, বাবার সামনে দিয়ে হনহন করে চলে গেল। ভাবলো যাহ, যা থাকে কপালে আর বাড়ি ফিরব না। সারা দিন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করলো। বন্ধুদের কাছেও গেল না। শেষে রাত হলে, গ্রামের স্কুল ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিলো। কাছে থাকা মুঠোফোনটিও বন্ধ করে রেখেছে। মা ভাবল, এমন তো মাঝে মধ্যে হয় আবার ফিরেও আসে। হয়ত ফিরে আসবে। বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লেও মা খাবার ঘরে ভাত নিয়ে বসে আছে। এই বুঝি আসবে ছেলে, এমনি ভাবতে ভাবতে মাও ক্লান্ত শরীরে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যায়। 
     বিদ্যেসাগর, মনে মনে নানা পরিকল্পনা করে। কিছু একটা করে বাবাকে দেখিয়ে দেবে। কিন্তু কি করবে, ব্যবসা করবে, কিন্তু টাকা? বিদেশ যাবে, টাকা? যা কিছু করতে চায় শেষে টাকায় গিয়ে থামে। কখনও ভাবে, তবে যে শুনি অনেকে, একশত টাকা থেকে একশত কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এমনিতে সারাদিনে পেটে  কিছু পড়েনি শেষে নিজের অজান্তে একসময় বেঞ্চির ওপর ঘুমিয়ে পড়ে। 
     হঠাৎ দেখে কয়েক দিন আগে আইলার ঝড়ে গ্রামের সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। নিজেকে আবিষ্কার করে একজন চেয়ারম্যান হিসেবে। সকলকে ত্রাণ দিচ্ছে আর ছবি তুলছে। নিজেকে তার বেশ নেতানেতা লাগছে, এবার বাবাকে বলতে পারবে, সে কিছু একটা করতে পেরেছে। কিন্তু স্বপ্নের দৃশ্য খুব দ্রুত বদলায় এ যেন জীবনের মত। এই এখানে তো একটু পরেই সেখানে, কেমন যেন জ্বলতে না জ্বলতেই নিভে যায়, উপভোগ করতে না করতেই ফুরিয়ে যায়। 
     একজন মুরুব্বি গোছের মানুষ এসে বলে,
    -  চেয়ারম্যান বাবু এইডা কি কইরেছেন? 
     বিদ্যেসাগর, এখন সে চেয়ারম্যান ভাবগম্ভির গলায় উত্তর দেয়, 
     - কেন কি অয়েছে? 
     - আপনি গরিব মানুশগের এরাম কইরে ঠগালেন কেন, বাবু?
     - কি কইরেছি, খুইলে কনদিনি। 
     - আপনি যে গরিব মানুশগের লিস্টি কইরেছেন, সেকানেতো বেশির ভাগ আপনের ঘরের মানুষ, আত্মীয়,  স্বজন।
     বিদ্যেসাগর একটু বিচলিত না হয়ে, স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেয়, 
     - কাকা, আপনে বুজদি ভুল কইরেছেন, আমি ঠিকি কইরেছি। 
     - ইডা কেরাম কতা কতিছেন, নিজের লোগগের সরকারি ত্রাণ দিতিছেন আবার কিতিছেন ঠিক কইরেছেন? ছবি তুইলে ফেসবুকে দিতিছেন, মানশির সম্মানহানি কত্তিছেন না? 
     বিদ্যেসাগর এবার স্কুলের শিক্ষকের মত মুরুব্বিকে বোঝাতে লাগল,
     - চাচা আপনে শুনিছেননা? আপনি বাঁচলি বাপের নাম, অথবা চাচা আপন পরান বাঁচা। আবার ইংরাজ সাহেবরা কয়, চ্যারিটি বিগিন্স এট হোম। বুজদি পারিছেন?  
     - চারিডি কি কলেন, সিডাতো বুজদি পারলামনা। 
     - ধর্মে কতা আছে না, আগে নিজেগে দেকতি অবে, পর পরো সদা। 
     মুরুব্বি কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিলনা। গ্রামের লেখাপড়া না জানা মানুষ কি আর বলবে। ভাবে ধর্মেও একথা লেখা, কি জানি। তিনি বিশ্বাস করতে যেমন পারেননি, আবার প্রতিবাদও করতে পারলেন না। 
     এদিকে ত্রাণ নিতে আসা মানুষজন হইহুল্লোড় শুরু করেছে। বিদ্যেসাগর চেয়ারম্যান এগিয়ে দেখে পুলিশের লোক তার দিকেই ধয়ে আসছে। সে আর বিলম্ব না করে, দৌড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু যত জোরে দৌড়ায়, পা ততো আগায় না। অনেক দূরে পা ফেলবার চেষ্টা করেলও পা যেন কাছেই পড়ছে। ভাবছে পুলিশ এই বুঝি তাকে ধরে ফেলবে। আর রক্ষা পাওয়া যাবে না। একেবারে হাঁপিয়ে উঠতেই হঠাৎ তার মায়ের ডাকে তার ঘুম ভাঙ্গে। বুক ধড়পড় করতে থাকে। মাকে দেখে কি বলবে, ভেবে পায় না। মা কিছু জিজ্ঞেস না করতেই, সুবোধ বালকের মতো মাকে প্রশ্ন করে, 
     - মা ভোর রাত্তিরের স্বপ্ন কি সত্যি অয়? 
     - শুনিছি ডানকাতি শুয়ে দেখলি সত্যি অয়। 
     তারপর আর কোন কথা না বাড়িয়ে বিদ্যেসাগর মায়ের পিছুপিছু বাড়ির দিকে রওয়ানা হল। 

মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন। অটোয়া, বাংলাদেশ