অটোয়া, সোমবার ৪ নভেম্বর, ২০২৪
একজন সমাজকর্মী- রাজনীতিক মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদ

     বেলাল উদ্দিনঃ ভাবছি আর ভাবছি চিন্তার মধ্যে আছি। কেমন করে লিখি? খাতা খুললাম, আনলাম, কলম ধরলাম, মনের চিন্তার দরজা খুললাম। কলম দিয়ে কী লিখব? হ্যাঁ লিখব একজন সমাজকর্মীকে নিয়ে, রাজনীতিককে নিয়ে। সমাজে অনেক মানুষ জন্মগ্রহন করেছে, ভবিষ্যতে জন্মগ্রহন করবে, অনেক চলে গেছেন আমরা সবাই চলে যাবো একদিন এটাইতো আমাদের নিয়তি। চলে যাওয়াদের পেছনে থাকে ভালমন্দের পাঁচমিশালী স্মৃতি যা জীবিতদের চেতনাকে নাড়া দেয়, স্মৃতিকে রোমন্তন করার প্রয়াস যোগায়। সবাইতো আর স্মৃতি রোমন্তনের উপজীব্য হতে পারেন না আবার কেউ কেউ হয়ে যান। এরা কেউ সমাজপতি, কেউ পুঁজিপতি, কেউ রাজনীতিক, কেউ শিক্ষাবিদ অর্থাৎ স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্বল আপন আলোয়। সমাজে এদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তারপরও অনেক স্মৃতির অন্তরালে চলে যান গোচরে বা অগোচরে। কালেভদ্রে স্মরণ করলেও তা জৌলুসবিহীন আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ। আজকের এ লেখনিতে আমি একজন গুণীজন সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাচ্ছি। অনেক দিন থেকে লিখব লিখব ভাবছি কিন্তু ব্যস্ততা আার যান্ত্রিক জীবনের দাপটে পিছিয়ে যাই। যাকে নিয়ে আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস তিনি হলেন আমার এক প্রিয়জন বিশিষ্ট সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ, ৭১ এর রণাঙনের বীর যোদ্ধা মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদ।
     বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদ ঐতিহ্যবাহী গোলাপগঞ্জ উপজেলার সাবেক পূর্ব আমুড়া ইউনিয়ন পরিবর্তিত বর্তমান ৫নং বুধবারী ইউনিয়নের বহরগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৫ সালের ১৫ই নভেম্বর জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ্ব সজ্জাদ আলী এবং মাতার নাম সারিজুন নেছা। এক ভাই ও এক বোনের সংসারে তিনিই ছিলেন বড় সন্তান। তাঁর পিতা ছিলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী। বাড়ির বড় সন্তান হিসেবে অত্যন্ত আদর ও জৌলুসের মধ্যে বড় হয়েছিলেন। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষার সমাপ্তি টেনে নিম্নমাধ্যমিক শেষ করেন ঐতিহ্যবাহী বিয়ানীবাজার পি.এইচ.জি. উচ্চ বিদ্যালয়ে। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন সিলেট সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৬১ সালে। ১৯৬৩ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে এম. সি. কলেজে (বর্তমানের সরকারী কলেজ) ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঐতিহ্যবাহী মুরারী চাঁদ কলেজে ( তৎকালীন সরকারী কলেজ) স্নাতক লেখাপড়া করেন।
     মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদের সাংগঠনিক, রাজনৈতিক চেতনা স্কুলজীবন থেকেই শুরু হয়ে যায়। সিলেট সরকারী পাইলট স্কুলের নির্বাচিত ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। আর ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে ছাত্রলীগে যোগ দেন ১৯৬১ সালে। কলেজ পর্যায়ে এসে নিজেকে আরো বিকশিত করে তৎকালীন সমরিক জান্তা বিরোধী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ৬২-এর শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে ছিলেন। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙবন্ধু প্রণীত মুক্তি সনদ ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলনে ছাত্রনেতা হিসেবে সম্মুখ সারিতে ছিলেন। তিনি ১৯৬৮-৬৯ সালে বহত্তর সিলেট জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। আইযুব বিরোধী আন্দোলন করার কারণে তাঁকে মাসাধিককাল কারাবরণ করতে হয়। উল্লেখ্য যে উনার বিবাহের এক মাসের মধ্যে উনাকে আইয়ুব প্রশাসন কারান্তরীণ করে। কারামুক্তির পর ৬৯ এর গণঅভ্যূথানে শরীক হন। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সমর্থনে বৃহত্তর সিলেটের প্রায় প্রতিটি আসন বিচরন করেন। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে মহান নেতার ডাকে সরাসরি অংশগ্রহন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেন।
     মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে তৎকালীন ৫ নং পুর্ব আমুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়ে এলাকার পূণর্গঠনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বাংলার ইতিহাসের নিকৃষ্টতম, জঘন্যতম ঘটনা তথা বঙবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকান্ড ঘটলে রাজনীতিতে আধার নেমে আসে। লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মীদের মত মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদের উপরও অত্যাচার আর নির্যাতনের খড়গ পড়ে। প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে লন্ডনে রাজনৈতিক নির্বাসনে চলে যান ১৯৭৫ এর শেষে। সেখানে গিয়ে সক্রিয় হন আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে। বঙবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের দাবীতে বিভিন্ন সভা, সমাবেশে অংশগ্রহন করেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটু অনুকুলে আসলে বছর দুই পরে দেশমাতৃকার টানে চলে আসেন এবং পুরান ঢাকায় ব্যবসা ও রাজনীতি যুগপৎ চালিয়ে যান। ১৯৮৩-৮৪ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট হন এবং কাপ্তান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনীতি ও ব্যবসার বাইরে নিজেকে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজসেবী সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ঢাকা লায়ন্স ক্লাবের ১৯৮৫-৮৬ সেশনের ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ঢাকাস্থ জালালাবাদ এসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী সদস্যও ছিলেন। নব্বই দশকের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে যান। সেখানেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জালালাবাদ এসোসিয়েশন USA,Inc এর প্রতিষ্টাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি আরও অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নিউইয়র্কস্ত ওজন পার্ক আল আমান জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন।
     মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদ এলাকায় একজন সর্বজন বিদিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এলাকার প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ছিল অসাধারণ। এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রতিটি মূহুর্ত ছিলেন উূদগ্রীব। তিনি নিজ গ্রামের বহরগ্রাম জনমঙল সমিতি, বহরগ্রাম পোষ্ট অফিস, বহরগ্রাম হাফিজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় অগ্রনী ভূমিকা রেখেছেন। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন। শুধু নিজ গ্রাম নয় গোটা ইউনিয়নের প্রতি তাঁর নিবিড় টান ছিল। ঐতিহ্যবাহী দেউলগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি তাঁর দরদ ছিল বর্ণনাতীত। তিনি বাগিরঘাট উচ্চ বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন, বহরগ্রাম হাফিজিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার ও সভাপতি ছিলেন। বানীগ্রাম-বহরগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্টায় তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি বহরগ্রাম কমিউনিটি ক্লিনিকের ভূমিদাতা।
     মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদের আজীবন স্বপ্ন ছিল গোলাপগঞ্জ- আমুড়া- শিকপুর-বহরগ্রাম- বিয়ানীবাজার রোড। তিনি এলাকার গণ্যমান্য লোকজন সমন্বয়ে প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ, দাফতরিক যোগাযোগ করে রোডটি বাস্তবায়নে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। সূদুর প্রবাসে থেকেও এলাকার প্রতিটি মানুষের খোঁজখবর রাখতেন। তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ সমাজহেতৈষী ব্যক্তিত্ব, নির্মোহ মানবিক গুণাবলীর অধিকারী।
     মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদ রাজনীতিতে নির্লোভ, আদর্শবান ছিলেন। বহুধরনের রাজনৈতিক টোপ তাঁকে আদর্শ থেকে বিচ্যূত করতে পারেনি। সামরিক জান্তারা অনেক টোপ দিয়েছিলো কিন্তু তাঁকে টলাতে পারেনি। বলেছিলেন, " বঙবন্ধুর স্নেহধন্য সিরাজ, আওয়ামী লীগের সিরাজ, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ হয়ে মরতে চাই।আদর্শের সাথে, মুক্তিযুদ্ধের সাথে বেঈমানী করতে পারিনা"।আদর্শিক রাজনীতির বরপুত্র ছিলেন মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদ। প্রয়াত জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের সাহচর্যে ছিলেন। মরহুম জাতীয় নেতা আব্দুর রাজ্জাক, বর্তমান রাজনীতির কিংবদন্তী তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিমের সাথে খুব হৃদ্যতাপুর্ন সম্পর্ক।
     মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদ সম্মোহনী শক্তির অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন। অতি সহজে অশান্ত পরিবেশ শান্ত করতে পারতেন। সালিশী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর ধীশক্তি অনন্য। অসাধারন বাগ্মী ছিলেন, অনর্গল বক্তব্য রাখতে পারতেন। বহুবিধ গুণে গুনান্বিত কুশিয়ারা তীরের এ নরশার্দুল, সমাজ ও রাজনীতির আইকন, গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজারের আদর্শিক রাজনীতির প্রতীক ২০১৩ সালের ১৩ই জুন নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। দোয়া করি মহান আল্লাহ উনাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকামের বাসিন্দা করুন।
     পৃথিবীতে কেউ কেউ মহৎ হয়ে জন্মে, কেউ কেউ মহত্ব অর্জন করে। মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদ একজন মহত্ব অর্জনকারী। জানিনা তাঁকে কতটুকু স্মরণ করি, করছি বা করবো। সমাজ বড় কৃপণ হয়ে যাচ্ছে, আমরা গুণীজনকে স্মরণ করি না বা করতে চাইনা। বড় দৈন্য দশায় আমাদের মানসিকতা। মরহুমের স্মৃতি রক্ষার্থে উনার প্রবাসী আত্নজ সন্তানরা প্রতিষ্টিত করেছে " বীর মুক্তিযুদ্ধা সিরাজ উদ্দিন আহমেদ ফাউন্ডেশন"। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এলাকার আর্থ-পীড়িতদের কল্যাণে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। আমি দোয়া করি তাদের এ প্রয়াস যুগ যুগান্তর চলমান থাকুক।

লেখকঃ
Md. Belal Uddin
MBA BEd
Senior Assistant Teacher
Dasura High School
Beanibazar, Sylhet.