রহস্যের মায়াজাল (ছয় ) - সুজিত বসাক
জোরালো আলোর টর্চ জ্বালা বারণ। মৃদু একটা আলো নিয়ে ওরাই রাকিবকে পৌঁছে দিল দীপঝিলের ধার পর্যন্ত। গুপ্তধনের সন্ধানে তো ওরা শহরেও বাস করতে পারত… কিন্তু বছরের পর বছর ঐ জরাজীর্ণ অট্টালিকার মরণ ফাঁদে কেন? প্রশ্নটা মনে এলেও শেষপর্যন্ত ওদের জিজ্ঞেস করল না রাকিব। এসব রহস্য ওরা এক্ষুনি ফাঁস করবে না। সুতরাং প্রশ্ন করা নিরর্থক। এসব প্রশ্নের উত্তর তাকেই বের করতে হবে। সত্যি সত্যি এবার গোয়েন্দা গিরিতে নামতে হবে তাকে। মনে মনে হাসল রাকিব। যত গভীরে ঢুকছে, একটা পাগল করা কৌতূহল তত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার মনাঞ্চল। রহস্যের আকর্ষণ বুঝি এমনই হয়!
ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে রাকিব ভাবতে শুরু করল, কোথা থেকে শুরু করা যায়? রাজবাড়ির গুপ্তধনকে কেন্দ্র করে একটা মিথ তৈরি হয়েছে। সেই মিথের পিছনে ছুটছে অনেকেই। কে জানে ধীরেন্দ্র প্রতাপ হয়তো খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল তার লক্ষ্যের। সেজন্যই হয়তো তাকে খুন হতে হয়েছিল। তাই যদি হয় তবে যে বা যারা তাকে খুন করেছে তারা এখানেই বাস করে। বাইরের কারও এতসব জানার কথা নয়। সুতরাং অনুসন্ধান শুরু করতে হবে এখান থেকেই। কিন্তু মুশকিল হল রাকিব একজন অতিথি, তার পক্ষে সরাসরি অনুসন্ধানের কাজ করা সম্ভব নয়। একজন অতিথি হয়ে গুপ্তধন সংক্রান্ত প্রশ্ন তুললে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠবে। মহারাজাও সেটা ভাল চোখে নাও দেখতে পারেন। তাছাড়া সেটা রাকিবেরও জীবন সংশয় বাড়িয়ে দিতে পারে। নেপথ্যের লোকেরা যে ভাল নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
হঠাৎ রাকিবের মনে হল, যাকে ঘিরে এত কান্ড তার ঘর থেকেই তদন্তের শুরু করলে কেমন হয়? অর্থাৎ ধীরেন্দ্র প্রতাপের ঘর। ওখানে কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে যেটা ধরে এগোনো যায়। কিন্তু ওঘরে যাওয়া যাবে কেমন করে? রাজবাড়ির অতিথি হয়ে অন্দরমহলে ঢুকে পড়া শোভন দেখায় না। তক্ষুনি মনে হল, এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে পারে হীরুদা। কিন্তু হীরুদাকে এসব অনুসন্ধানের কথা বলাটা কী ঠিক হবে? অনেক ভেবে চিন্তে দেখল রাকিব, এছাড়া বিকল্প কোন পথও খোলা নেই। একা কিছু করা সম্ভব নয়, কারও সাহায্য লাগবেই ।
পরের দিন সকালেই কথাটা বলল হীরুদাকে। সব শুনে হীরুদা বলল- “এসব করে তোমার কী লাভ? এখানে সবাই ভাল নয়। অযথা কেন প্রাণের ঝুঁকি নেবে?”
-“ধীরুভাই দাদাবাবুর হত্যাকারী ধরা পড়ুক তুমি চাও না?”
-“চাই… অবশ্যই চাই। কিন্তু কারও প্রাণের বিনিময়ে নয়। সবে যৌবনে পা রেখেছ তুমি। আমার কিন্তু ভয় করছে।”
রাকিব হাসল –“সব কিছুতে ভয় পেলে চলে? আমি পুলিশ নই তবুও চেষ্টা করছি তার একটাই কারণ , সত্যটা তুলে আনা।”
এই কথায় কাজ হল। হীরুদা কী বুঝল কে জানে। বলল –“ঐ ঘরের চাবি আমি তোমাকে গোপনে জোগাড় করে দেব। গভীর রাতে তোমাকে আসতে হবে। দিনের বেলা গেলে সন্দেহের মুখে পড়বে।”
আপাতত হীরুদাকে গাইড হিসেবে মেনে নিয়ে কিছু গোপন আলোচনা সেরে নিল। তারপর বেড়িয়ে এল।
রাত একটা। রাজবাড়ির সদর গেটের ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দে জানান দিল। রাকিব তৈরি হয়ে নিল। ঘর থেকে বেড়িয়ে চারপাশটা ভাল করে পরীক্ষা করে নিল। কোথায় বিপদ ওৎ পেতে আছে কেউ জানে না। নিজের ইন্দ্রিয় গুলোই একমাত্র ভরসা। একটা শর্টকাট রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছিল হীরুদা। সেটা ধরে খুব সহজেই অতিথি শালা থেকে রাজবাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করা যায়। সেটা ধরেই রাজবাড়ির অন্দরে প্রবেশ করল রাকিব। এর আগে মহারাজার সাথে দু তিনবার অন্দরমহলে ঢুকেছে, কিন্তু একা একা এই প্রথম। বাইরে থেকে এই গোপন রাস্তাটির অস্বিত্ব বোঝার উপায় নেই। এ থেকে আরও অনুমান করতে পারল, রাজবাড়ির এই বিশাল অট্টালিকার মাঝে আরও অনেক গোপন অলি গলি, চোরাকুঠুরি ইত্যাদি থাকাই স্বাভাবিক।
হুটহাট করে যেখানে সেখানে ঢুকে পড়া ঠিক হবে না। হীরুদার নির্দেশই অনুসরণ করল রাকিব। ঢিমে আলোর একটা টর্চ সঙ্গে নিয়েছে রাকিব। পথটি একেবেকে চলেছে সামনের দিকে। শেষ হল অন্দরমহলের একটা অন্ধকার কুঠুরির সামনে। এদিকটাতে কোন পাহারা নেই। রাকিব ধীরে ধীরে উঠে এল দোতলার বারান্দায়। আগে থেকেই জানা ছিল ধীরেন্দ্র প্রতাপের ঘর কোনটা। সে মারা যাবার পর থেকে ঘরটি তালাবদ্ধ অবস্থাতেই আছে।
নিঃশব্দে তালা খুলল রাকিব। এই তলাতে রাজবাড়ির অনেকেই থাকেন। স্বয়ং মহারাজার ঘরও এই তলাতেই। একেবারে দক্ষিণে। শেষ প্রান্তে। ওদিকটাতে রক্ষীরা আছে নিশ্চয়ই। সতর্ক হল রাকিব। কেউ দেখতে পেলে সর্বনাশ। তখন অতিথি বলে আর ক্ষমা মিলবে না। এই রাজ্যের আইন কানুন ভীষণ কঠোর। ভিতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। এবার কিছুটা নিশ্চিন্তি। দেরি না করে কাজে লেগে পড়ল দ্রুত।
একঝলক দেখেই বোঝা যায়, ধীরেন্দ্র প্রতাপের ঘরের জিনিস পত্র বিশেষ পরিবর্তন করা হয়নি। চারদিকে গুছিয়ে রাখা তার খেলার সরঞ্জাম। দেওয়ালে টাঙানো তার একটা মস্ত ওয়েল পেইন্টিং। পঁচিশ ছাব্বিশের এক ঝকঝকে যুবক। যেমন সুন্দর মুখশ্রী তেমনি দেহ সৌষ্ঠব। কষ্ট হল রাকিবের। কী মারণ নেশাই না ধরেছিল মানুষটাকে… শেষ পর্যন্ত জীবনটাই চলে গেল। ভীষণ জীবন্ত ছবি, মনে হয় যেন সশরীরে দাঁড়িয়ে আছেন! ছবিটির নীচের ডানদিকের কোনায় “ পিটার “ কথাটা লেখা। সম্ভবত পিটার নামের কোন আর্টিস্ট ছবিটি একেঁছিলেন। হাত বটে লোকটার!
তন্ন তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল রাকিব। খুব সামান্য হলেও একটা কিছু ক্লু তার দরকার। অন্তত একটা খড়কুটো, যেটা ধরে এগোনো যায়। বেশ বড়সড় ঘর। খুঁজতে খুঁজতে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল রাকিব। এদিকে সময়ও বয়ে চলেছে আপন গতিতে। কিছু না পেয়ে একটা সময় মনে হল, হয় যারা তাকে খুন করেছে তারা সমস্ত তথ্য প্রমাণ লোপাট করেছে, নতুবা ধীরেন্দ্র প্রতাপ সেসব এমন কোন গোপন স্থানে রেখে গেছেন যা খুঁজে বের করা অত সহজসাধ্য নয়।
হঠাৎ রাকিবের মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। হীরুদার মুখে শোনা একটা শব্দ মনে পড়ে গেল… . “শয়তান”। ধীরেন্দ্র প্রতাপ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে যে তিনটি শব্দ বলেছিল তার একটি। এই ঘরেই কোন একটা জায়গায় ইংরেজীতে “শয়তান” শব্দটি খোদাই করা দেখেছে একটু আগেই। উত্তেজিত হয়ে উঠল রাকিব। দ্বিগুণ উদ্যমে আবার কাজ শুরু করে দিল। কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করতেই মনে পড়ে গেল। লেখাটা রয়েছে একটা পাথরের সেলফের নীচের দিকে। এমন জায়গায় যেখানে হঠাৎ করে কারও নজরে পড়বে না। কী আছে ঐ শয়তান শব্দটির মধ্যে? রাকিব মন দিয়ে পরীক্ষা করল। আপাত দৃষ্টিতে সেরকম কোন বিশেষত্ব চোখে পড়ল না। একটু জোরে লেখাটার ওপর চাপ দিতেই অদ্ভুত এক কান্ড ঘটে গেল। সেলফের মধ্যে আরও একটা গুপ্ত সেলফ বেড়িয়ে এল। সেলফের মধ্যে গোল করে মোড়ানো কতকগুলি হলদেটে কাগজ এবং একটা পুরানো লাল মলাটের ডায়েরি। এক নিমেষে বুঝে গেল রাকিব, এসব কাগজ পত্র ও ডায়েরি ধীরেন্দ্র প্রতাপের একান্ত ব্যক্তিগত এবং গুপ্তধন সংক্রান্ত হওয়াই স্বাভাবিক।
রাকিব আর দেরি করল না। এখানে আর অপেক্ষা করে ঝুঁকি নেওয়ার কোন মানে হয় না। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। আর তর সইছে না তার। এক্ষুনি ঘরে গিয়ে দেখতে হবে জিনিস গুলো। মনে মনে আশান্বিত হল রাকিব, কে জানে এর মধ্যেই হয়তো আছে গুপ্তধনের আসল ম্যাপ, যেটা ওর হত্যাকারীরা এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি। চলবে…
সুজিত বসাক। দিনহাটা, কুচবিহার
-
গল্প//উপন্যাস
-
06-06-2020
-
-