রহস্যের মায়াজাল (পাঁচ) - সুজিত বসাক
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের অন্ধকার নামতেই বেড়িয়ে পড়ল রাকিব। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে বোঝার চেষ্টা করল, কেউ অনুসরণ করছে না তো? হাতে একটা টর্চ, কাঁধে মহারাজার দেওয়া রাইফেল ঝোলানো। সকালে রাইফেলটা নেওয়ার সময় মহারাজাকে বলেছিল, আজ সে রাজ্যের দক্ষিণের বনাঞ্চলে ঘুরতে যাবে। মহারাজা কোন আপত্তি করেননি। সাথে একজন লোক দিতে চেয়েছিলেন, রাকিব নেয়নি। শুধু রাইফেলটা নিজেই চেয়ে নিয়েছিল। দিনের বেলা সত্যি সত্যি একবার দক্ষিণের বন ঘুরে এসেছে। কিন্তু ওর রাইফেল নেওয়ার আসল উদ্দেশ্য এই রাতের অভিযান। এ ব্যাপারে কাউকেই কিছু জানায়নি।
অতি সন্তর্পণে রাকিব দীপঝিলের ঘাটে এসে দাঁড়াল। এদিকটা ভীষণ নির্জন। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। রাকিব ঘাটে বাধা ছোট নৌকাটাতে উঠে বসল। গ্রাম বাংলার ছেলে সে, নৌকা চালাতে ভালই পারে। নৌকা চলল মৃত্যু বনের দিকে। রকিবের মন কেন যেন বারবার বলছে ঐ মৃত্যু বনে অনেক রহস্যের সমাধান আছে। ব্যাপারটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে, বুঝতে পারছে রাকিব। সেই সাথে এটাও বুঝতে পারছে, ধীরে ধীরে সেও ঢুকে পড়ছে রহস্যের মধ্যে। এই রহস্যের সমাধান করতে পারলে কী হবে সে জানে না। কিন্তু রহস্যের আকর্ষণ এতটাই অমোঘ হয়ে উঠেছে যে, নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারছে, এই অবস্থায় ফিরে গিয়েও শান্তি পাবে না।
ঝিলটা বেশ বড়। মাঝ বরাবর চলেছে রাকিব। তার গন্তব্য, আগের রাতে যেদিকে লাইট দেখেছিল সেদিকটাতে। হীরুদার মুখে যা শুনেছে তাতে অনেক কিছুই এলোমেলো মনে হয়েছে তার। কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি আছে হীরুদার কথায়। অনেক কিছুই সরজমিনে না গেলে বোঝা যায় না। জায়গাটা একবার দেখে আসাই ঠিক বলে মনে হয়েছে রাকিবের। জঙ্গলের দিকে যখন এসে পৌঁছুল তখন অন্ধকার আরও ঘণীভূত। নিকষ কালো দানবের মতো জঙ্গলের অবয়ব। এগিয়ে চলল রাকিব। নৌকাটা একটা গাছের গুড়ির সাথে বেধে রেখে জঙ্গলের পথ ধরল। জঙ্গলের মধ্যে পথ চলা ভীষণ কষ্ট সাধ্য কাজ। তবে রাকিব একসময় আফ্রিকার দূর্গম বনাঞ্চল চষে বেড়িয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগল।
অনেকটা সামনের দিকে চলে এসেছে রাকিব। হঠাৎ নজরে পড়ল সামনে একটি প্রাচীন অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ। সে শুনেছে একসময় এখানে একটি প্রাচীন নগরীর সীমান্ত প্রদেশ ছিল। হেতমগড় রাজ্য। যদিও সে রাজ্য বহুকাল আগেই ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল দুর্ধর্ষ আরাকানরা। নতুন করে আর সেই রাজ্য গড়ে উঠতে পারেনি। হেতমগড়ের মানুষ জন পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। জনমানবশূন্য হেতমগড়ের বেশির ভাগই জঙ্গলে পরিনত হয়। রাকিব অনুমান করল, এই অট্টালিকা সম্ভবত সীমান্তবর্তী কোন সরকারি দপ্তর ছিল।
সাবধান হল রাকিব। এইসব পুরানো অট্টালিকা বিষধর সাপের আদর্শ বাসস্থান। ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকল। সদর গেট পেড়িয়ে প্রসস্ত উঠোন। হয়তো একটা সময় মানুষের সমাগমে ভেতরটা গমগম করত। উঠোন পেড়িয়ে ইংরেজি “ইউ” প্যাটার্নের বারান্দা যুক্ত ঘরের সারি। জরাজীর্ণ দৈন্য দশা এখন। একটা নিশাচর পাখি মানুষের পায়ের শব্দ পেয়ে বিকট আওয়াজ তুলে কী যেন জানান দিল। আক্রোশ….. নাকি কোন সতর্ক সংকেত? ঠিক বুঝে উঠতে পারল না রাকিব।
একের পর এক ঘরগুলো ভাল করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল রাকিব। দরজা, জানালা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বন্য লতা পাতা, অর্কিড, আরও কত অজানা গাছ নিজের জগৎ তৈরি করেছে ঘরের মধ্যেই। কত না কীটপতঙ্গ স্থায়ীভাবে বাসা বেধেছে! টর্চের আলো পড়তেই তারা দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল।
একটা ঘরে টর্চের আলো ফেলতেই ভীষণ অবাক হয়ে গেল রাকিব। কিন্তু অবাক ভাবটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই মাথার পিছনে বেশ জোরে একটা আঘাত অনুভব করল। সংজ্ঞা হীন হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। চোখের সামনে গাঢ় ঘন কালো অন্ধকার নেমে এল।
কতক্ষণ এভাবে পড়েছিল কে জানে। যখন জ্ঞান ফিরল, দেখল চোখের সামনে সামনে একটা টিমটিমে লম্ফ জ্বলছে। রকিবের গোঙানি শুনেই বোধহয় দুজন লোক ঘরের মধ্যে ঢুকল। রাকিব ভীষণ অবাক হল। এরা কারা? এই জঙ্গলে কী করছে?
অস্পষ্ট ভাবে রাকিব দেখল, দুজনের মুখই ঘন দাড়িতে আবৃত। পোশাক পরিচ্ছদও মলিন। উঠে বসল রাকিব। মাথার পিছন দিকটা ব্যথায় টনটন করছে। ওদের মধ্যে যে বয়স্ক সে বলল – “আপনি কী বাঙালি?”
রাকিব অস্ফুট স্বরে বলল – “হ্যা।”
সে বলল - “এখানে এসেছেন কেন? আপনি জানেন না এটার নাম মৃত্যু বন….এখানে এলে কেউ আর ফিরে যেতে পারে না। কে গোয়েন্দা গিরি করতে পাঠিয়েছে আপনাকে? সত্যি করে বলুন।”
রাকিব আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল –“কেউ পাঠায়নি। আমি একাই এসেছি। আমার নাম রাকিব।”
পাশের অল্প বয়স্ক লোকটার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল –“আপনিই রাকিব? মায়া আপনার কথা বলেছিল। আফ্রিকার দূর্গম জঙ্গলে যে ভাবে আপনি কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন….সব শুনেছি আমি।”
মায়া নামটা শুনেই রাকিব অনুমান করল, মেয়েটা এদের কাছেই আসে রাতে। এরা এই মৃত্যু বনে থেকে কী করে? রাকিবের কৌতূহল বেড়ে গেল।
রাকিব অকপটে বলল – “দেখুন, আমি আপনাদের কোন ক্ষতি করতে আসিনি। নেহাত কৌতূহল বশেই চলে এসেছি। আসলে কাল রাতে আমি মায়াকে এখান থেকে ফেরার পথে দেখে ফেলেছিলাম কিনা… তারপর থেকেই কৌতূহল দানা বাঁধে। সেটার নিরসন না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না।”
এবার বয়স্ক দাড়িওয়ালা কিছুটা বিশ্বাস করল যেন।
গম্ভীর মুখে বলল – “যদি বলি আমরা গুপ্তধনের সন্ধানে এখানে আছি… বিশ্বাস করবেন?”
রাকিব একটু থতমত খেল। সামলে নিয়ে বলল – “আপনারাই কী তবে ধীরেন্দ্র প্রতাপকে হত্যা করেছেন?”
-“না। এসব কথা কে বলল আপনাকে?”
-“না মানে… হীরুদা বলছিল … ধীরেন্দ্র প্রতাপ মারা যাওয়ার আগে গুপ্তধন নিয়ে চর্চা করতেন। তাই… ধীরেন্দ্র প্রতাপকে কে খুন করেছে আপনারা জানেন?”
সে কথার জবাব না দিয়ে দাড়িওয়ালা বলল - “আপনি কিন্তু একটু বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন। এই বনে অন্য কারো অস্তিত্ব আমাদের পক্ষে সুখকর নয়। তাই আপনাকে মেরে ফেলতেও আমাদের হাত কিন্তু কাঁপবে না। আপনার পরিচয় পেলাম… বাইরের লোক আপনি… এখান থেকে চলে যান… সেটাই ভাল হবে আপনার পক্ষে।”
-“আপনাদের পরিচয়টা জানতে পারি কি?”
-“এসব না জানাই ভাল। আর একটা কথা, এখান থেকে ফিরে গিয়ে এই সাক্ষাতের কথা ঘূণাক্ষরেও কাউকে বলবেন না। তাহলে আমাদের জীবন সংশয় তৈরি হয়ে যাবে। এটুকু বিশ্বাস নিশ্চয়ই আপনাকে করতে পারি?”
-“বেশ তাই হবে। তখন বললেন, আপনারা গুপ্তধনের সন্ধান করছেন… কিসের গুপ্তধন? কোন গুপ্তধন?”
-“সে অনেক কথা। আমরা অনেকটা এগিয়েও ছিলাম। কিন্তু ধীরেন্দ্র প্রতাপের মৃত্যু সব হিসেব গোলমাল করে দিল। কারণ ধীরেন্দ্র প্রতাপের কাছেই বোধহয় সেই চোরাকুঠুরির আসল ম্যাপটা ছিল। সে মারা যাওয়াতে আমাদের কাজটা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। যে ধীরেন্দ্র প্রতাপকে হত্যা করেছে, ম্যাপ এখন তার জিম্মায়। গুপ্তধন আদৌ আছে কিনা জানিনা… চেষ্টা তো করতেই হবে।”
রাকিব বলল – “তার মানে গুপ্তধনের ব্যাপারটা আরও অনেকে জানে।”
-“হ্যাঁ।”
রাকিবের মনে হল, সামনের লোক দুটো ঠিক ঐ ধরনের গুন্ডা বদমাশ নয়। কথাবার্তায় এত পরিপক্কতা, শালীনতাবোধ, শিক্ষার ছাপ… এসব কোন পাতি গুন্ডা বদমাশের হতে পারে না।
রাকিব মরিয়া ভাবে বলল – “মহারাজা যদি জানতে চান?”
-“তিনি এসব জানেন না। এখন আপনি গিয়ে যদি বলে দেন তাহলে আলাদা কথা।”
-“তাহলে আমি তো সত্যি সত্যি আপনাদের পক্ষে বিপজ্জনক… আমাকে মেরে ফেলাই আপনাদের পক্ষে সেফটি।”
হাসল দুজনেই। অল্প বয়স্ক দাড়িওয়ালা বলল – “আপনাকে মেরে আমাদের কোন লাভ নেই আমরা কোন খুনি নই। বাকিটুকু আপনার বিবেকের ওপরেই ছেড়ে দিলাম।”
রাকিব অবাক হল। এই বিশ্বাস টুকু ওদের আসছে কোথা থেকে? এরা কী শুধু মাত্র গুপ্তধনের সন্ধানেই এখানে এরকম জীবন যাপন করছে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এরা নিজের মুখে আর কিছু বলবে না বুঝতে পারল রাকিব। তাই আর জোর করল না। শুধু বলল -“আপনাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার চেষ্টা করব। তবে আপনাদেরকেও একটা কথা দিতে হবে।”
-“কী কথা?”
-“মহারাজা বীরেন্দ্র প্রতাপের যেন কোন ক্ষতি না হয়। মনে হয় মানুষটি বিপদগ্রস্ত।”
বয়স্ক দাড়িওয়ালা হাসল – “ঐ রাজবাড়ি একটা রহস্যের কারখানা। ওখানকার মানুষগুলোও রহস্যে ঘেরা। কে ভাল কে মন্দ তার বিচার আপনি দুদিনেই করতে পারবেন না রাকিব। আমরাও মহারাজের কোন ক্ষতি চাই না। তবে চেষ্টা করেও সবসময় সফল হওয়া যায় না। যেমন, ধীরেন্দ্র প্রতাপের কথাই ধরুন। তাকে আমরা সবসময় চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করতাম… তবুও পারলাম না তাকে বাঁচাতে। যাকগে… এবার আপনি আসুন… অনেক রাত হয়ে গেল।” চলবে…
সুজিত বসাক। দিনহাটা, কুচবিহার
-
গল্প//উপন্যাস
-
27-04-2020
-
-