অটোয়া, সোমবার ৪ নভেম্বর, ২০২৪
আবেদ, আমার সবচে বড় আবেগের নাম – বজলুস শহীদ

বেদ, তুই কি জেগে আছিস? 
আজ ১৬ ডিসেম্বর, মনে আছে তোর,   
একাত্তর এর এই দিনে আমরা কোথায় ছিলাম? 
মনে পড়ে, সেদিনের সেই ভোরটার কথা? 
কেমন কুয়াশায় ঢাকা ছিল ভোরের আকাশ, কনকনে শীতে। চাদরে মাথা কান জড়িয়ে, মুখ ঢেকে, ভোরে আমাদের দলটা আগদিঘা থেকে আলেক মাস্টারের নেতৃত্বে নাটোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কুয়াশা ঠেলে, শিশির মাড়িয়ে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সাথে আমরা পৌঁছে গেলাম ছাতনি ইউনিয়নে। সেখানেই তোদের দলের সাথে দেখা। আফাজ ভাই, তুই, সাহেব আলী দেওয়ান। আমাকে দেখে সেদিন সে কী তোর আনন্দ!ঘর ভর্তি মুক্তিযোদ্ধার দল সবাই তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। মন্জু ভাইকে পেয়ে আফাজ ভাইয়ের কে কী উচ্ছ্বাস, বাঁধ ভাংগা আনন্দ! 
আজকের দিনের মত স্মার্ট ফোন থাকলে কতই না মজা হত। আমাদের বিজয়ের মিলন মেলাকে আমরা ধরে রাখতাম চির দিনের জন্য। 
কিন্তু তোরাত ছবি হোয়ে বেঁচে আছিস আমার বুকে, তোদের সেই স্মৃতি গুলোই আমার ভিডিও,  ছবি গুলো চোখের সামনে ভেসে যায়। 

তুই আর আফাজ ভাই যুদ্ধে মারা যাসনি, তোদেরকে মেরে ফেলা হলো যুদ্ধের পর। কেন মেরে ফেলা হোয়েছিল তোদের দু'জনকে, সাহেব আলী একদিন সব আমাকে ভরা যমুনাকে স্বাক্ষী রেখে বলে গিয়েছে। তোদের মৃত্যুর দিন আমি ছিলাম না, কিন্তু ফেরির এক ধারে আমি আর সাহেব আলী কেঁদে ছিলাম তোদের জন্য। নৃশংস হত্যার বর্ণণা সাহেব আলী যখন দিচ্ছিল,  আমি আহ্ বলে এমন চিৎকার দিয়েছিলাম,  ডেকের উপরের লোকেরা অবাক হোয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। এক জন ছুটে এসে জিজ্ঞেস করেছিল,  আমি অসুস্হ কী না!   
সেই সাহেব আলীও নেই, চলে গেছে তোদের কাছে। আমাদের দলের আলেক মাস্টার, মন্জু ভাই, ফরজ মোল্লা, কুদ্দুস ফকির সবাই চলে গিয়েছে। 
বেঁচে আছি আমি, জিল্লুর চাচা, বাবলু, মকছেদ ফকির আজও। জানিনা, তারা তোদেরকে ভুলে গিয়েছে কী না, আমি কিন্তু ভুলি নি৷ মাঝে মধ্যে কাইউমভাই, সামাদ,  ছাত্তারের কথা মনে পড়ে। জানি না ওরা বেঁচে  আছে কি -না! 

আবার মাঝে মধ্যে মাঝে মধ্যে-  নানা অবিচার অনাচার দেখে মনে হয়, তোরা ভাল আছিস, আমি ভাল নেই। ভেবেছিলাম, দূর প্রবাসে যেয়ে সব ভুলে যাব, কষ্ট ভুলে যাব, কিন্তু কেন জানি তা হয় না, আরও বেড়ে গিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করি, কি হবে এসব ভেবে, আর ভাববো না! কষ্টগুলো  ভুলবার  জন্য মেডিটেশন করি, কিন্তু মেডিটেশনের মাঝেও ৭১এর দিনগুলোকে ভুলতে পারি না, সেই স্বপ্নের  বাংলাদেশ ফিরে এসে করোটিতে ধাক্কা  মারতে থাকে।
কতটা বছর চলে গিয়েছে, ইতিহাসের খেরোপাতায় জমা হোয়েছে কত কাহিনী, কিন্তু যে দেশটার জন্য তোদের সাথে যুদ্ধে গিয়েছিলাম, সে দেশটা আজও পেলাম না অধরাই থেকে গেলো। তাই মনে হয়,  তোরা ফিরে আয়, আবারও আমাদের স্বপ্নের ফুলটাকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করি। 

আবেদ, তুই ছিলি ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চি,  কোনদিন বই খুলতিস না। আজকে তোর জন্য কবিতাটা লেখলাম- ছোট্ট কবিতা, পড়তে ভুল করিস নাঃ

আমাদের বিজয় লুন্ঠন করে 
ঠক দস্যুর দল,
কোথায় তোরা সহযোদ্ধারা
আবার যুদ্ধে চল।। 

হাজারো মানুষ আজ অসহায়,
স্বাধীনতা আজ পথ নাহি পায়
অসহায় শিশু ধর্ষিত হয়
আমার এ বাঙলায়, 
আয়, আবেদেরা ছুটে আয়।

১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯
বজলুস শহীদ 
অটোয়া, কানাডা।