মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকায় নারী : পরিপ্রেক্ষিত সিলেট(১ম পর্ব)-অপূর্ব শর্মা
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ১৯৪৭ সালের গণভোট, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থান, অসহযোগ আন্দোলন, সবকিছুতেই বাঙালি নারীদের অংশগ্রহণ ছিল। সেই প্রবাহের সাথে যুক্ত ছিলেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নারীরাও। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পুরুষের পাশাপাশি সিলেটের নারীরাও পরাধীনতার শৃংখল মুক্তির আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন। মুক্তিসংগ্রামে ত্যাগের, সহ্যের, সাহসের এক অকৃত্রিম তুলনাহীন ভূমিকা পালন করেন তারা। নানাভাবে নানা মাত্রায় তাদের অংশগ্রহণ মুক্তিযুদ্ধকে করেছিল বেগবান। এসব নারীদের কেউ অস্ত্র হাতে ঝাপিয়ে পড়েছেন শত্রুর উপর, কেউবা পালন করেছেন সংগঠকের ভূমিকা। কি দেশে, কি প্রবাসে, সবখানেই গতিশীল ছিলেন তারা। তাদের সেই অবদানের কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তারপরও তারা থেকে গেছেন আড়ালে! মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের অবদান যেভাবে উঠে এসেছে, ঠিক সেভাবে উঠে আসেনি নারীদের অংশগ্রহণের কথা। বিশেষ করে সংগঠকের ভূমিকা পালন করা সেইসব নারীরা আজ যেন বিস্মৃত হতে চলেছেন। শুধু তাই নয়, তাদেরকে আমরা যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারিনি আজও। দিন বদলের দিনেও পাল্টায়নি নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি! মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ভুমিকা রাখা এ অঞ্চলের ২০ জন মহিয়সী নারীর অবদানের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে প্রবন্ধে।
জোবায়দা খাতুন চৌধুরী
১৯২৮ সালে পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে সেই যে আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, আর পিছু হটেন নি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং ১৯৪৭ সালে গণভোটের সময় সিলেটকে পাকিস্তানের সাথে অন্তভূক্ত করার আন্দোলনে অগ্রভাগে ছিলেন জোবায়দা খাতুন চৌধুরী। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার সাথে পাকিস্তান সরকারের বৈরীতা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। শোষণ ও নির্যাতনে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোল, ৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন এবং ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি ছিলেন রাজপথে। ’৭১-এর ২৫ মার্চের গণহত্যা তাঁকে বিচলিত করে তুলে। স্বাধীনতা ছাড়া গত্যন্তর নেই তা ভালোভাবেই অনুধাবন করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে শুরু হয় তাঁর তৎপরতা। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় মুক্তিযোদ্ধাদের যতরকম সহায়তা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব তা করেছেন তিনি। ক্যাম্পে ক্যাম্পে পাঠিয়েছেন খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধপত্র ইত্যাদি। প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়েরও ব্যবস্থা করেছেন। অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য নিবেদিত হতে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসে মুক্তিসংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন অনেকেই। স্বাধীনতা অর্জনের পর নতুন করে শুরু হয় তার কর্মতৎপরতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের উদ্ধারে তিনি সোচ্চার হয়ে উঠেন। গঠন করেন একটি সমিতি। এই সমিতির মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে শত শত বাঙালিকে দেশে ফেরৎ আনতে সক্ষম হন তিনি। জোবায়দা খাতুন চৌধুরীর জন্ম ১৯০১ সালে। তাঁর পৈত্রিক নিবাস গোলাপগঞ্জ থানার ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের শিলঘাট গ্রামে। পিতা সরাফত আলী চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মাতা গৃহিনী নূরজাহান বেগম। পিতার কর্মস্থল ভারতের আসাম রাজ্যের জোড়হাট জেলা শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার পানিউমদা গ্রামের আবদুর রহিম চৌধুরীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৮৫ সালের ২৫ জানুয়ারি নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ।
সিরাজুন্নেসা চৌধুরী
প্রগতির পথের অভিযাত্রী সিরাজুন্নেসা চৌধুরী মুক্তি সংগ্রামের সময় বলিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে তিনি যেভাবে সোচ্চার ছিলেন ঠিক তেমনি দেশ মাতৃকাকে রক্ষায় তিনি ছিলেন অন্তপ্রাণ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পরই পাকবাহিনীর দখলে চলে যায় সিলেট। স্বাধীনতার পক্ষের অনেকেই আটকা পড়েন শহরে। চোখে অন্ধকার দেখেন তারা। এই পরিস্থিতিতে তাদের সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দেন সিরাজুন্নেসা চৌধুরী। সিলেটে শহরে আটকে পড়া ডাক্তার ব্যাংকার, অফিসার, আত্মীয়-অনাত্মীয়দের রক্ষায় তিনি দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে তিনি বিভিন্ন পেশার বিপন্ন লোকজনদের ১৭টি গাড়ি বোঝাই করে নিজের চা বাগান মৌলভীবাজারের সিরাজ নগরে নিয়ে যান। সেখানে একশরও অধিক মানুষকে তিনি শুধু আশ্রয়দান করেননি, তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়ে পাকবাহিনীর নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেন। শুধু তাই নয়, তাঁর নির্দেশে পুত্র হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী পাক রাষ্ট্রদূতের পদ ত্যাগ করে ভারতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর আমীনূর রশীদ চৌধূরী পালন করেন সংগঠকের ভূমিকা। স্বাধীনতা উত্তরকালেও বহু দুঃস্থ নারীর পুনর্বাসনে এগিয়ে আসেন এই মহিয়সী। তাঁর সহায়তায় নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে অসহায় নারীরা।সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ১৯১০ সালের ২৭ নভেম্বর মৌলভীবাজার জেলার ইটা পরগনার রাজনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দেওয়ান আব্দুল করিম চৌধুরী, মাতা আসমাতুন্নেসা চৌধুরী। ১৯২৬ সালে সুনামগঞ্জের পাগলা এলাকার দুর্গাপাশা গ্রামের অতিরিক্ত সহকারী কমিশনার আব্দুর রশীদ চৌধুরীর সাথে বিয়ে হয় তাঁর। ১৯৭৪ সালের ২৪ জুন মৃত্যু হয় এই মহিয়সীর।
................চলবে
(সূত্রঃ বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ এবং সংবাদ পত্র)
সিলেট, বাংলাদেশ
-
মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিববর্ষ
-
04-08-2017
-
-